নতুন জীবনের সন্ধানে চীনারা

চীনের অনেকের আজন্ম স্বপ্ন—একটা নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট থাকা। চেন কুর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে তিনি চাকরিও করেন। কিন্তু এর কোনো কিছুই তাঁকে টানল না।


অক্টোবরের কোনো এক মধ্যরাতে অস্ট্রেলিয়াগামী বিমানে চড়ে বসলেন। তাঁর এবারের ইচ্ছে—ক্যাঙারুর দেশে নতুন জীবন শুরু করা।
চেন কুর মতো প্রতিবছর হাজার হাজার চীনা নাগরিক দেশ ছাড়ছে। তাদের সবার একটাই প্রত্যাশা—দেশের বাইরে ভালো কিছু করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতি তরতর করে ওপরে উঠলেও তা দেশটির নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। বরং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সামাজিক সেবার নিশ্চয়তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা তাদের মোহবিষ্ট করছে।
বেইজিংয়ের অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়ার ঘণ্টা কয়েক আগে চেন বলেন, ‘চীনে প্রচণ্ড চাপ, মাঝেমধ্যে সপ্তাহে ১২৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশে আমার সন্তানদের খ্রিষ্টান হিসেবে বেড়ে উঠতে সমস্যা হবে না। অস্ট্রেলিয়ায় ধর্মীয় স্বাধীনতা অনেক।’
চেনের মতো এভাবে প্রতিবছর অনেক দক্ষ কর্মী হারাচ্ছে চীন। ২০১০ সালেই পাঁচ লাখ আট হাজার চীনা নাগরিক ৩৪টি উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়েছে, যা ২০০০ সালের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি। ২০১১ সালে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই পাড়ি জমায় ৮৭ হাজার চীনা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার।
আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেক চীনা প্রবাসী তাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুষছেন। কিন্তু বেইজিং এই উদ্বেগ আমলে নিচ্ছে না। চীন সরকারের একমাত্র লক্ষ্য, যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন। আর এ উন্নয়নের নেশাই ডুবাচ্ছে চীনকে। দেশটির পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে চীনাদের। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের পরও চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এখন অনেক অনিশ্চয়তা।
নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাও কং বলেন, ‘মধ্যবিত্ত চীনারা তাদের ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য চীনকে নিরাপদ মনে করছে না। তারা মনে করে না, চীনের রাজনীতি স্থিতিশীল।’
অনেক চীনা নাগরিক বিদেশি পাসপোর্ট থাকাটাকে তাদের রক্ষাকবচ মনে করে। স্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগ করতে তারা অনাগ্রহী। তবে পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী বিদেশে অবস্থান করতে প্রস্তুত। সাংহাই-ভিত্তিক একটি প্রকৌশল কোম্পানির ব্যবস্থাপক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডের আশায় তিনি এ বছর নিউইয়র্কে আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রিন কার্ড থাকা মানে নিরাপদ অনুভব করা। এখানকার (চীনের) ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল নয়। আপনি জানেন না ভবিষ্যতে এখানে কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি এখানে আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করব।’
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই সাধারণ চীনাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতারাই হত্যা, নির্যাতন ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে হত্যার অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা বো শিলাইয়ের স্ত্রী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এ কারণে শিলাইয়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাসী বিশেষজ্ঞ লিয়াং জাই বলেন, ‘চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, এমনকি বো শিলাই পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি কাজ করছে। মানুষ জানে না, দু-তিন বছর পর তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে।’ নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.