দৈবদুর্বিপাক

রায়হান কোনো সমস্যায় পড়লে আমার শরণাপন্ন হয়। ওর ধারণা, আমার পরামর্শটা অন্য সবার চেয়ে উৎকৃষ্ট। এবারও নতুন একটা সমস্যা নিয়ে আমার কাছে হাজির হলো। রায়হানের মামার বিয়ে।


বাড়ির সবাই ঢাকার বাইরে যাবে সাত দিনের জন্য। কিন্তু রায়হান ওর মামার বিয়েতে যাবে না। আমি বললাম, ‘তুই তোর মাকে বুঝিয়ে বল, তোর যেতে ইচ্ছে করছে না।’ আমিও রায়হানকে প্রশ্ন করলাম, কেন যাবি না? বিয়েতে তো খুব মজা হয়। ঢাকায় তোর কী কাজ?
—ও তুই বুঝবি না। আমার অনেক কাজ। তোকে পরে বলব। আগে আমাকে একটু বুদ্ধি দে। যাতে আমাকে রেখে সবাই বিয়েতে যায়।
আমি ভাবুকের মতো কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, একটু অভিনয় করতে পারবি?
—অবশ্যই পারব। তুই বল।
—তোর মামাবাড়ি যাওয়ার দু-একদিন আগে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্টের অভিনয় করতে হবে। হাত-পা মচকানো বা ব্যথা পেয়েছিস এমন ভান করতে হবে, যা নিয়ে তোর ঢাকার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে গুরুতর কিছু করা যাবে না। তা হলে আন্টি তোকে একা বাড়িতে রেখে কোথাও যাবেন না। তুই বলবি, দু-তিন দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেলে আমি বিয়েতে পরে আসছি।
আমার আইডিয়া শুনে রায়হান আনন্দে চোখ বড় বড় করে বলল, দারুণ। এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল না কেন?
পরিকল্পনামাফিক রায়হানের মোটরসাইকেলটার হেডলাইট চেঞ্জ করে ভাঙা হেডলাইট লাগানো হলো অ্যাকসিডেন্টের আলামত হিসেবে। এরপর পরিচিত ফার্মেসি থেকে কনুই এবং হাঁটুতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রায়হানকে ওর বাসায় পাঠালাম। সঙ্গে আমাকে যেতে বলল দুর্ঘটনার সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে গেলাম না। কারণ, অ্যান্টি খুবই রাগী মানুষ। কখন কোন কথায় ধমক দেবেন। আমি কারও ধমক খেতে পারব না। বুদ্ধি দেওয়ার কাজ বুদ্ধি দিয়ে কেটে পড়লাম।
রায়হান চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর ফোন করে জানতে চাইলাম, কী অবস্থা?
রায়হান চাপা স্বরে জানাল, ‘উত্তপ্ত পরিস্থিতি। মা আমাকে খুব বকাঝকা করেছে, কেন অসতর্কভাবে মোটরসাইকেল চালাই। তবে কাজ হয়েছে। আমাকে মনে হয় বিয়েতে যেতে হবে না।’ রায়হানের আনন্দটা দূর থেকে মোবাইলে বুঝতে পারলাম।
তিন দিন পর। রায়হানের মোবাইলে বারবার কল দিচ্ছি কিন্তু রিসিভ করছে না। অনেকক্ষণ পর কল সিরিভ করে বলল, ‘শালা! আমাকে ফোন দিবি না।’ বলেই লাইনটা কেটে দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কাজ ফুরালেই আমি পর! আমার সন্দেহ হলো, বাড়ি ফাঁকা পেয়ে জেরিন নামক ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে হয়তো ডেটিং-ফেটিং কিছু একটা করছে। আমি ওদের হাতেনাতে ধরার উদ্দেশ্যে রায়হানের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কলবেল টিপতেই রায়হানের মা দরজা খুলে দিলেন। ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতেই ভেতরে যেতে বললেন। আমি বললাম, আন্টি রায়হানের কী অবস্থা? এখন কেমন আছে?
—আর বোলো না বাবা, কীভাবে যে হোন্ডা চালায়!
আপনাদের না ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল?
—হ্যাঁ। আমার ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গ্রামে একটা সমস্যা হয়েছে, তাই বিয়েটা এক মাস পিছিয়েছে।
—যাক ভালোই হয়েছে, না হলে তো রায়হানকে অসুস্থ অবস্থায় একা রেখে যেতে হতো।
—এবার ডিসিশন নিয়েছি, রায়হানকে হোন্ডা ইউজ করতে দেব না। ওর বাবাকে বলেছি বিক্রি করে দিতে। যেভাবে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে, কখন যে বড় কোনো অঘটন ঘটে। আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম, ‘জি আন্টি, তা ঠিক।’ পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, রায়হান এসে হাজির হয়েছে। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। রায়হান আমার পাশে এসে বসল। কষ্ট করে হাসিটা চেপে রাখলাম। আন্টি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল। রায়হান আমার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, আজ জেরিনের সঙ্গে দেখা করার কথা। মেয়েটা বারবার ফোন দিচ্ছে।
আমি মিটি মিটি হেসে বললাম, আমার মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি এসেছে। এটা অ্যাপ্লাই করলে আন্টি তোকে বাইরে যেতে দেবে।
রায়হান আঁতকে উঠে বলল, তোর বুদ্ধি! মাফ চাই; আর না। তোর এক বুদ্ধিতে গৃহবন্দী হয়েছি। এর চেয়ে জেলখানায় থাকাও ভালো ছিল।
—সত্যি। নতুন বুদ্ধিটা কিন্তু দারুণ!
—চাই না, তোর বুদ্ধি শুনলে নিশ্চিত এক মাস জেলে থাকতে হবে।
খাবারের ট্রে হাতে আন্টি ফিরে এলেন। আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, দেখো তো বাবা, সেই সকাল থেকে বারবার বাইরে যেতে চাচ্ছে।
আমি আন্টির কথায় সুর মিলিয়ে বললাম, না। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।
রায়হান আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। আমার মনে হলো, রায়হান যদি মানুষ না হয়ে অ্যানাকোন্ডা হতো তা হলে এখনই আমাকে আস্ত গিলে ফেলত। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে রায়হান নামের অ্যানাকোন্ডা আছে, সেখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।
 মো. কামরুল হাসান
আরামবাগ, পল্লবী, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.