কালের পুরাণ- দিল্লিতে ‘জাতীয় ঐক্য’, ঢাকায় বিভেদ! by সোহরাব হাসান
বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সদ্য সমাপ্ত ভারত সফর নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের মধ্যে যে বাহাস চলছে, তাকে এককথায় বলা যায় মূর্খতা।
কোনো দেশের দায়িত্বশীল নেতা ও মন্ত্রীরা এ রকম বালখিল্য আচরণ করতে পারেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এঁরাই আমাদের দেশ ও রাজনীতির চালক। এসব গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল নেতা গলাবাজিতে যতটা বলীয়ান, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিদেশিদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ততটাই ম্রিয়মাণ। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলায় বিজয় ছাড়া গত এক দশকে দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই।
খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি যদি কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের আমন্ত্রণে বিদেশে যান, সেখানে লালগালিচা সংবর্ধনা পান, তাতে ক্ষমতাসীনদের বিচলিত হওয়ার কী আছে? বন্ধুত্ব কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয় যে সেখানে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ভারতে কী কী ওয়াদা করে এসেছেন, তার রেকর্ড তাঁদের কাছে আছে। সময়মতো ফাঁস করে দেওয়া হবে।’ কেবল খালেদা জিয়া কেন, আমাদের প্রত্যেক নেতা-মন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের স্বার্থে কী করেছেন, সেসব জানার অধিকার জনগণের আছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের গোপন তথ্য ফাঁস করার আগে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থান জানালে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারত।
খালেদা জিয়ার ভারত সফর থেকে সরকার সহজে যে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারত, জনগণকে বোঝাতে পারত সরকারের তৈরি পথেই খালেদা জিয়া হাঁটছেন, তারা সেটি না করে নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয় দিয়েছে। সরকার বলতে পারত টিপাইমুখ ইস্যুতে যৌথ সমীক্ষা দল গঠনের কথা তারা আগেই বলেছিল। খালেদা জিয়া এত দিন এর বিরোধিতা করলেও এখন দিল্লিতে গিয়ে রাজি হয়ে এসেছেন। তারা বলতে পারত যে, সরকার কানেকটিভিটির আওতায়ই ভারতকে ট্রানজিট দিতে চেয়েছে, বিনিময়ে বাংলাদেশও নেপাল ও ভুটানে একই সুবিধা পাবে। এত দিন বিএনপি ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিরোধিতা করলেও খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমদ এখন বলছেন, বিএনপি কখনোই ট্রানজিটের বিপক্ষে ছিল না। সরকার বলতে পারত, আওয়ামী লীগ সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমেই দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো সমাধান করতে আগ্রহী, তাদের আমলেই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে, পার্বত্য সমস্যার সমাধান হয়েছে। তখন বিএনপি গঙ্গার পানি বণ্টন ও পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। বিএনপির নেত্রী বলেছিলেন, পার্বত্য চুক্তি হলে ফেনীর ওপারের ভূখণ্ড ভারতের হয়ে যাবে। এখন তিনি বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।
ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা স্বীকার করবেন, ভারত তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরে যায়নি, যাবে না। তাদের নীতি হলো, দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ আছে, বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে তাদের মধ্যে বাগিবতণ্ডা হয়। কিন্তু তাই বলে এক দল আরেক দলকে পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের দালাল বলে না। দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও সরকার ও বিরোধী দল বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে না, যেটি দেশের জন্য ভালো মনে করে; আলোচনার মাধ্যমেই তারা সেটি গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তারা সংসদের ভেতর ও বাইরেও আলোচনা করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশে কি এটি কখনো ভাবা যায় যে বিদেশে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন! কিংবা বিরোধী দল সরকারের কোনো সাফল্যকে স্বীকার করে নিয়েছে। সমুদ্রসীমার মামলায় বিজয়ের পর বিএনপি প্রথমে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েও পরে তা ফিরিয়ে নিয়েছিল।
খালেদা জিয়া এখন দিল্লিতে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে এসেছেন যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেননি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এসব জরুরি ছিল। অথচ দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগেই বিএনপির নেত্রী বলেছিলেন, ‘দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে ফুলের মালা দেব, না পারলে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখব।’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনি ‘গোপন নিরাপত্তা চুক্তি’ সই করার অভিযোগ এনেছিলেন, বলেছিলেন ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এরপর মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ার জন্যও তিনি সরকারের নতজানু নীতিকে দায়ী করেছিলেন। এবার দিল্লিতে গিয়ে খালেদা বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব চাই, আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা হবে।’ শেখ হাসিনার ওয়াদা ছিল বর্তমানের। খালেদা জিয়ার ওয়াদাটি ভবিষ্যতের। এ রকম আগাম প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অতীতে ঘটেছে বলে মনে হয় না।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখেই ভারত বিএনপি নেত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, বাংলাদেশের মানুষ নয়—ভারত, আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো দেশই অলৌকিক শক্তিবলে একবার আওয়ামী লীগকে, আরেকবার বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তাঁরা ক্ষমতার মূল যে শক্তি জনগণকে খাটো করে দেখেন, ভাবেন নির্বাচনটি উপলক্ষ মাত্র। ক্ষমতায় বসানোর মালিকেরা বসে আছেন ওয়াশিংটনে, দিল্লিতে, ইসলামাবাদে কিংবা রিয়াদে। এই পরনির্ভরশীল মানসিকতার কারণেই বাংলাদেশের যত দুর্গতি। ভারত বা কোনো দেশই কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে না, যদি জনগণ তাদের না চায়।
ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার নিরিখে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে দেখে নয়। যে কারণে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় না। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রিরও অভিযোগ আনে না। আরও অনেক বিষয়ের মতো আমরা দেশ বিক্রির ব্যাধিটি পাকিস্তানের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকেরা খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। মওদুদ আহমদের মন্তব্য, ‘ভারত তাদের ভুল বুঝতে পেরে খালেদা জিয়াকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়েছে।’ কারও কারাও মতে, নয়াদিল্লি নীতি পরিবর্তন করেছে। আসলে ভারতের নীতি একটুও বদলায়নি। তারা যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে এমনকি ভবিষ্যতে পাওয়ার ওয়াদাও আদায় করে নিয়েছে। এখন আর টিপাইমুখ নিয়ে, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কিংবা ট্রানজিট নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। সবাই একমত হয়ে এসেছেন। কয়েক মাস আগে জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দিল্লিতে রাজসিক অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। তিনিও সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছেন। এখানেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জয়। তারা সব ডিম যে এক ঝুড়িতে রাখতে চায় না, তা সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য সব ঝুড়িকে নিজের পক্ষে নিতে পেরেছে। মাস দুই আগে টাইমস অব ইন্ডিয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছিল, ‘বাংলাদেশে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় ভারত উদ্বিগ্ন’। খালেদা জিয়ার সফর সেই উদ্বেগ অনেকখানি দূর করলেও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্তবিরোধ ও সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ, তা দূর করবে কে? দিল্লি থেকে ফিরে খালেদা জিয়াও আগের মতো জোশ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না।
এবারে তাঁর দিল্লি সফর যতটা না নিজের আগ্রহে, তার চেয়ে বেশি অতীতের দায় শোধের কারণে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের মাটি যে কেবল ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল তাই নয়, দেশ পরিণত হয়েছিল জঙ্গিবাদের অভয়াশ্রমে। তখন বাংলাদেশের নাম যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সুদান ও সোমালিয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশের ব্যাপারে তখন কেবল ভারতই উদ্বিগ্ন ছিল না, উদ্বিগ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি বিএনপি সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত চীন কিংবা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গেও টানাপোড়েন বেড়েছিল। ওআইসিতে মহাসচিব পদে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত) প্রার্থী করায় কট্টর ও উদার দুই শ্রেণীর মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়। তিন প্রার্থীর মধ্যে তাঁর সর্বনিম্ন ভোট পাওয়াও জোট সরকারের বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। সোজা কথায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিল বিএনপি।
খালেদার দিল্লি সফরের প্রেক্ষাপটে কেবল আমাদের আন্তদলীয় রাজনীতিই উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। ভারত প্রশ্নে দলটি দ্বিধাবিভক্ত। দলের একাংশ মনে করছে, ভারতের (আরও পরিষ্কার করে বললে ভারত ও আমেরিকা) সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতায় আসা যাবে না, অতএব এই মুহূর্তে ভারতকে তোয়াজ করাটাই বাঞ্ছনীয়। আর কট্টরপন্থী অংশের ধারণা, ভারত কখনোই বিএনপিকে ছাড় দেবে না (সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা না হওয়াকেই তারা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে)। সে ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে খালেদা জিয়া সরে এলে আওয়ামী লীগই লাভবান হবে। দেশে ভারতবিরোধী যে বিশাল ভোটব্যাংক আছে, বিএনপি তা হারাবে। ১৮ দলীয় জোটেও সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়বে। কেননা, এই জোটের ছোট শরিকদের রাজনীতির প্রধান পুঁজিই হলো ভারতবিরোধিতা।
বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক কূটতর্কে লাভবান হয়েছে ভারত; শেখ হাসিনার সমর্থন তারা অনেক আগেই পেয়েছে। আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বরাবরই তাদের পছন্দের লোক। এখন খালেদা জিয়াও ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দেশের তিনটি প্রধান দলের তিন প্রধানের এ রকম নিঃশর্ত সমর্থন যখন দিল্লিওয়ালাদের ঝুলিতে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো বিষয়েই আর তাদের দর-কষাকষির প্রয়োজন হবে না।
ভারতে আমাদের তিন শীর্ষনেতার বক্তৃতা-বিবৃতি পাঠ করে দেখুন, ভাষাভঙ্গি প্রায় অভিন্ন। যদিও দেশের ভেতরে তাঁরা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেন না, নয়াদিল্লিতে গিয়ে সব ব্যাপারে ঐকমত্য ঘোষণা করে আসেন, সহযোগিতার হাত বাড়ান। কিন্তু যত বিভেদ ঢাকায়। এই হলো আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চরিত্র!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net
খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি যদি কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের আমন্ত্রণে বিদেশে যান, সেখানে লালগালিচা সংবর্ধনা পান, তাতে ক্ষমতাসীনদের বিচলিত হওয়ার কী আছে? বন্ধুত্ব কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয় যে সেখানে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ভারতে কী কী ওয়াদা করে এসেছেন, তার রেকর্ড তাঁদের কাছে আছে। সময়মতো ফাঁস করে দেওয়া হবে।’ কেবল খালেদা জিয়া কেন, আমাদের প্রত্যেক নেতা-মন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের স্বার্থে কী করেছেন, সেসব জানার অধিকার জনগণের আছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের গোপন তথ্য ফাঁস করার আগে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থান জানালে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারত।
খালেদা জিয়ার ভারত সফর থেকে সরকার সহজে যে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারত, জনগণকে বোঝাতে পারত সরকারের তৈরি পথেই খালেদা জিয়া হাঁটছেন, তারা সেটি না করে নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয় দিয়েছে। সরকার বলতে পারত টিপাইমুখ ইস্যুতে যৌথ সমীক্ষা দল গঠনের কথা তারা আগেই বলেছিল। খালেদা জিয়া এত দিন এর বিরোধিতা করলেও এখন দিল্লিতে গিয়ে রাজি হয়ে এসেছেন। তারা বলতে পারত যে, সরকার কানেকটিভিটির আওতায়ই ভারতকে ট্রানজিট দিতে চেয়েছে, বিনিময়ে বাংলাদেশও নেপাল ও ভুটানে একই সুবিধা পাবে। এত দিন বিএনপি ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিরোধিতা করলেও খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমদ এখন বলছেন, বিএনপি কখনোই ট্রানজিটের বিপক্ষে ছিল না। সরকার বলতে পারত, আওয়ামী লীগ সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমেই দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো সমাধান করতে আগ্রহী, তাদের আমলেই গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে, পার্বত্য সমস্যার সমাধান হয়েছে। তখন বিএনপি গঙ্গার পানি বণ্টন ও পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। বিএনপির নেত্রী বলেছিলেন, পার্বত্য চুক্তি হলে ফেনীর ওপারের ভূখণ্ড ভারতের হয়ে যাবে। এখন তিনি বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।
ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা স্বীকার করবেন, ভারত তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরে যায়নি, যাবে না। তাদের নীতি হলো, দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ আছে, বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে তাদের মধ্যে বাগিবতণ্ডা হয়। কিন্তু তাই বলে এক দল আরেক দলকে পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের দালাল বলে না। দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও সরকার ও বিরোধী দল বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে না, যেটি দেশের জন্য ভালো মনে করে; আলোচনার মাধ্যমেই তারা সেটি গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তারা সংসদের ভেতর ও বাইরেও আলোচনা করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশে কি এটি কখনো ভাবা যায় যে বিদেশে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন! কিংবা বিরোধী দল সরকারের কোনো সাফল্যকে স্বীকার করে নিয়েছে। সমুদ্রসীমার মামলায় বিজয়ের পর বিএনপি প্রথমে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েও পরে তা ফিরিয়ে নিয়েছিল।
খালেদা জিয়া এখন দিল্লিতে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে এসেছেন যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেননি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এসব জরুরি ছিল। অথচ দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগেই বিএনপির নেত্রী বলেছিলেন, ‘দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারলে ফুলের মালা দেব, না পারলে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখব।’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনি ‘গোপন নিরাপত্তা চুক্তি’ সই করার অভিযোগ এনেছিলেন, বলেছিলেন ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এরপর মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ার জন্যও তিনি সরকারের নতজানু নীতিকে দায়ী করেছিলেন। এবার দিল্লিতে গিয়ে খালেদা বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব চাই, আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা হবে।’ শেখ হাসিনার ওয়াদা ছিল বর্তমানের। খালেদা জিয়ার ওয়াদাটি ভবিষ্যতের। এ রকম আগাম প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অতীতে ঘটেছে বলে মনে হয় না।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখেই ভারত বিএনপি নেত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, বাংলাদেশের মানুষ নয়—ভারত, আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো দেশই অলৌকিক শক্তিবলে একবার আওয়ামী লীগকে, আরেকবার বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তাঁরা ক্ষমতার মূল যে শক্তি জনগণকে খাটো করে দেখেন, ভাবেন নির্বাচনটি উপলক্ষ মাত্র। ক্ষমতায় বসানোর মালিকেরা বসে আছেন ওয়াশিংটনে, দিল্লিতে, ইসলামাবাদে কিংবা রিয়াদে। এই পরনির্ভরশীল মানসিকতার কারণেই বাংলাদেশের যত দুর্গতি। ভারত বা কোনো দেশই কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে না, যদি জনগণ তাদের না চায়।
ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার নিরিখে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে দেখে নয়। যে কারণে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় না। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রিরও অভিযোগ আনে না। আরও অনেক বিষয়ের মতো আমরা দেশ বিক্রির ব্যাধিটি পাকিস্তানের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকেরা খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। মওদুদ আহমদের মন্তব্য, ‘ভারত তাদের ভুল বুঝতে পেরে খালেদা জিয়াকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়েছে।’ কারও কারাও মতে, নয়াদিল্লি নীতি পরিবর্তন করেছে। আসলে ভারতের নীতি একটুও বদলায়নি। তারা যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে এমনকি ভবিষ্যতে পাওয়ার ওয়াদাও আদায় করে নিয়েছে। এখন আর টিপাইমুখ নিয়ে, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কিংবা ট্রানজিট নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। সবাই একমত হয়ে এসেছেন। কয়েক মাস আগে জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দিল্লিতে রাজসিক অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। তিনিও সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছেন। এখানেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জয়। তারা সব ডিম যে এক ঝুড়িতে রাখতে চায় না, তা সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য সব ঝুড়িকে নিজের পক্ষে নিতে পেরেছে। মাস দুই আগে টাইমস অব ইন্ডিয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছিল, ‘বাংলাদেশে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় ভারত উদ্বিগ্ন’। খালেদা জিয়ার সফর সেই উদ্বেগ অনেকখানি দূর করলেও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্তবিরোধ ও সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ, তা দূর করবে কে? দিল্লি থেকে ফিরে খালেদা জিয়াও আগের মতো জোশ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না।
এবারে তাঁর দিল্লি সফর যতটা না নিজের আগ্রহে, তার চেয়ে বেশি অতীতের দায় শোধের কারণে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের মাটি যে কেবল ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল তাই নয়, দেশ পরিণত হয়েছিল জঙ্গিবাদের অভয়াশ্রমে। তখন বাংলাদেশের নাম যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সুদান ও সোমালিয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশের ব্যাপারে তখন কেবল ভারতই উদ্বিগ্ন ছিল না, উদ্বিগ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি বিএনপি সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত চীন কিংবা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গেও টানাপোড়েন বেড়েছিল। ওআইসিতে মহাসচিব পদে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত) প্রার্থী করায় কট্টর ও উদার দুই শ্রেণীর মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়। তিন প্রার্থীর মধ্যে তাঁর সর্বনিম্ন ভোট পাওয়াও জোট সরকারের বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। সোজা কথায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিল বিএনপি।
খালেদার দিল্লি সফরের প্রেক্ষাপটে কেবল আমাদের আন্তদলীয় রাজনীতিই উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। ভারত প্রশ্নে দলটি দ্বিধাবিভক্ত। দলের একাংশ মনে করছে, ভারতের (আরও পরিষ্কার করে বললে ভারত ও আমেরিকা) সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতায় আসা যাবে না, অতএব এই মুহূর্তে ভারতকে তোয়াজ করাটাই বাঞ্ছনীয়। আর কট্টরপন্থী অংশের ধারণা, ভারত কখনোই বিএনপিকে ছাড় দেবে না (সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা না হওয়াকেই তারা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে)। সে ক্ষেত্রে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে খালেদা জিয়া সরে এলে আওয়ামী লীগই লাভবান হবে। দেশে ভারতবিরোধী যে বিশাল ভোটব্যাংক আছে, বিএনপি তা হারাবে। ১৮ দলীয় জোটেও সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়বে। কেননা, এই জোটের ছোট শরিকদের রাজনীতির প্রধান পুঁজিই হলো ভারতবিরোধিতা।
বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক কূটতর্কে লাভবান হয়েছে ভারত; শেখ হাসিনার সমর্থন তারা অনেক আগেই পেয়েছে। আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বরাবরই তাদের পছন্দের লোক। এখন খালেদা জিয়াও ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দেশের তিনটি প্রধান দলের তিন প্রধানের এ রকম নিঃশর্ত সমর্থন যখন দিল্লিওয়ালাদের ঝুলিতে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো বিষয়েই আর তাদের দর-কষাকষির প্রয়োজন হবে না।
ভারতে আমাদের তিন শীর্ষনেতার বক্তৃতা-বিবৃতি পাঠ করে দেখুন, ভাষাভঙ্গি প্রায় অভিন্ন। যদিও দেশের ভেতরে তাঁরা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেন না, নয়াদিল্লিতে গিয়ে সব ব্যাপারে ঐকমত্য ঘোষণা করে আসেন, সহযোগিতার হাত বাড়ান। কিন্তু যত বিভেদ ঢাকায়। এই হলো আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চরিত্র!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net
No comments