২০১২ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল- আগাম ভোটের প্রবণতা বাড়ছে by মিজানুর রহমান খান

মেরিল্যান্ডের দেয়ালগুলো নিরাপদে আছে। কোথাও নির্বাচনী প্রচারণার চিহ্নমাত্র নেই। নির্বাচন নিয়ে তথাকথিত ‘উৎসবমুখর’ পরিবেশ যে শান্তি বা অন্তত সৌন্দর্যের জন্য হুমকি, তার দৃষ্টান্ত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়া।


শুক্রবার মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের প্রিন্স জর্জেস কাউন্টির কলেজ পার্ক কমিউনিটি সেন্টারের কেন্দ্র সরেজমিনে দেখার আগ পর্যন্ত এমন কিছু চোখে পড়েনি যাতে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র ৬ নভেম্বর নির্বাচনে যাচ্ছে। বাড়িঘরের দেয়াল, সড়ক, সেতুসহ সব ধরনের স্থাপনা অক্ষত আছে। পোস্টার, ফেস্টুন ইত্যাদিতে ছেয়ে যায়নি। গত দু দিন নানা দিকে ঘুরেও কোথাও একটি দলীয় প্রতীকের দেখা পর্যন্ত মেলেনি। ট্রাকবোঝাই উন্মত্ত কর্মীদের মিছিলের তো কোনো প্রশ্নই নেই।
একটি দৃশ্যপট অবশ্য বেশ চোখে পড়ার মতো। কলেজ পার্ক কমিউনিটি সেন্টারের অদূরে রাস্তার মোড়ে এক ফালি জায়গা। সেখানে সবুজ ঘাসের ওপরে রাখা কয়েকটি বিলবোর্ড। কোনোটিরই উচ্চতা মাটি থেকে তিন ফুটের বেশি নয়। কারা এর উদ্যোক্তা তার কোনো উল্লেখ তো নেই-ই, এমনকি ওবামা বা রমনির পক্ষে ভোটও প্রার্থনা করা হয়নি তাতে। বিলবোর্ডের বিষয়বস্তু সুনির্দিষ্ট ইস্যু। যেমন, ‘৭ নম্বর প্রশ্নকে না বলুন।’
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় অঙ্গরাজ্য মেরিল্যান্ডের নির্বাচনী রাজনীতিতে এবার ওবামা-রমনির জয়-পরাজয় ছাড়া অন্য যেটি বড় হয়ে উঠেছে সেটা হলো, এই ৭ নম্বর প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন শুধু প্রেসিডেন্টই নির্বাচিত হন না। এটা কার্যত একটা গণভোট উৎসব। স্থানীয় সরকারগুলো ও অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদগুলো এদিন যার যার মতো করে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনমত যাচাই করার সুযোগ নিয়ে থাকে। যেমন ইলিনয় অঙ্গরাজ্য এবারে সংবিধান সংশোধন করা না-করার প্রশ্নে গণভোট করে নেবে ৬ নভেম্বরেই। এটি শুধু ইলিনয়ের ব্যালট পেপারে থাকবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটাররা ওবামা-রমনি শিবিরে বিভক্ত হবেন। কিন্তু তাঁরাই সাধারণত স্থানীয় ইস্যুতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকেন।
মেরিল্যান্ডের ব্যালটে ৭ নম্বর প্রশ্নটি জুয়া খেলার সম্প্রসারণবিষয়ক। এটি এখন এ অঙ্গরাজ্যের জন্য সবচেয়ে গরম রাজনৈতিক ইস্যু। গত আগস্টে এ বিষয়ে বিল পাস হয়ে গেছে। আগামীকালের ভোটে তা পাস হলে আইনে পরিণত হবে। এর পক্ষের যুক্তি: প্রস্তাবটি গণরায় পেলে প্রিন্স জর্জ কাউন্টিতে লাস ভেগাসের কায়দায় বড় ক্যাসিনো (জুয়া খেলার জায়গা) বসবে। এর ফলে ১০ হাজারের বেশি নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। লাভের টাকা সরকারি স্কুল চালাতে ব্যয় হবে। এর বিরুদ্ধ মত হচ্ছে, ক্যাসিনোর ওই লাভের টাকার ওপর হামলে পড়বেন রাজনীতিকেরা। তাঁরা তা বাজেটে ভারসাম্য আনার কাজে ব্যবহার করবেন। তা ছাড়া জুয়ার ব্যবসা করমুক্ত রাখা হবে বৈষম্যমূলক।
রোন্ডা উডলির হাতে লিফলেট। তিনি ডেমোক্র্যাট দলের কর্মী। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ওবামাই জয়ী হচ্ছেন। রোন্ডার মতে, এই এলাকায় রমনিদের ভরাডুবি ঘটবেই। প্রাপ্ত তথ্যে তাঁর বক্তব্যের সত্যতার আভাসও মিলল। শনিবারে প্রথম আগাম ভোট গণনা হয়। তখন দেখা যায়, ১৯৬৭টি ভোটের মধ্যে ১৬০৮টিই পেয়েছেন ওবামা। রমনি ১০০ এবং অন্য প্রার্থীরা ২০৮।
সবাই অবশ্য মুখ খোলার ব্যাপারে সমান আগ্রহী নন। ১ নভেম্বর ডালাস বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে কথা হলো মাইক্রোবাসচালক এডগার তুসালোর সঙ্গে। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন এডগার। জানতে চাইলাম, নির্বাচন নিয়ে তিনি কী ভাবছেন। এডগার বললেন, ‘আমি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা পছন্দ করি না। তাই আমি মুখ বন্ধ রাখব।’
প্রিন্স জর্জেস কাউন্টির নির্বাচনী পর্ষদের (নির্বাচন কমিশন) চিফ জাজ জ্যাকিউ ব্যালার্ড সৌজন্যমূলক কথা বললেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য পত্রিকায় উদ্ধৃত করব বলতেই বেঁকে বসলেন। তাই পত্রপাঠ বিদায় নিতে হলো।
চিফ জাজ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিরাট ভূমিকা রাখেন। ভোট চলার সময় আমজনতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের একমাত্র যোগসূত্র তিনি। চিফ জাজ কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরের লোক। তাঁর সহায়তাকারীদের বলা হয় নির্বাচনী জাজ। এই জাজরা স্বেচ্ছাসেবী। কোনো ভোটকেন্দ্রে নির্বিঘ্নে ভোটদান চলছে কি না, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাঁদেরই। এঁরা একধরনের নির্বাচনী এজেন্ট। প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে প্রতি দল থেকে একজন করে চিফ জাজ থাকেন। তবে ভোটের দিনটিতে তাঁরা দলের নন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবেই নিয়োজিত থাকেন। যেকোনো নির্বাচনের ১৩ সপ্তাহ আগে তাঁরা নিয়োগ পান। এঁরা কাজ করেন ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ হিসেবে।
শুক্রবার প্রিন্স জর্জেস কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে দেখলাম, আগাম ভোট দিতে আবালবৃদ্ধবনিতার বেশ ভিড়। হারিকেন স্যান্ডির কারণে এ রাজ্যে দুদিন আগাম ভোট নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে শুক্রবার শেষ বর্ধিত দিনে প্রতি কেন্দ্রে ভোটারদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এদিন রাত ১০টা পর্যন্ত চার লাখ ২৫ হাজার ৫৬৫ জন মেরিল্যান্ডবাসী আগাম ভোট দিয়েছেন। এটা এই অঙ্গরাজ্যের মোট ভোটারের ১২ শতাংশের বেশি। ভিড়ের কারণে ভোট দিতে কাউকে কাউকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ মেরিল্যান্ডের সিনেটর জেমস রোসাপিপে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘বিলম্বিত গণতন্ত্র মানে গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান।’ সিনেটর রোসাপিপে অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদে ইতিমধ্যে একটি বিল জমা দিয়েছেন। এটা পাস হলে কোনো ভোটকেন্দ্রে আর কাউকে ভোট দিতে ১৫ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে হবে না।
আগাম ভোট মার্কিন রাজনীতিতে একটি তুলনামূলক নতুন ধারণা। কিন্তু তা এর সুবিধার কারণে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। ৩৫টি অঙ্গরাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া আগাম ভোটের সুযোগ দেয়। তবে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিদেশে অবস্থানরত নাগরিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীরা আগাম ভোটের আবেদন করতে পারেন। ২০০৮ সালে ৩০ শতাংশের বেশি ভোটার আগাম ভোট দিয়েছিলেন। এবার আগাম ভোটের হার ৪০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.