বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৫৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মীর শওকত আলী, বীর উত্তম সাহসী এক সেক্টর অধিনায়ক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মীর শওকত আলী প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর আগস্ট মাস থেকে ৫ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


তাঁর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল সিলেটের উত্তরাংশের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের (তখন মহকুমা) সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলা (তখন থানা)।
এ অঞ্চলে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন, থাল-তোচি-খাইবার প্রভৃতি স্কাউটস গ্রুপের মিলিশিয়া। সহযোগী হিসেবে ছিল ইপিসিএএফ ও রাজাকার। এ ছাড়া ছিল শান্তি কমিটি নামধারী বিপুলসংখ্যক স্থানীয় বাঙালি দোসর।
মীর শওকত আলীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি গেরিলা ও সরাসরি যুদ্ধও সংঘটিত হয়। এর মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের সরাসরি যুদ্ধ অন্যতম।
৯ ডিসেম্বর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের সহায়তায় গণবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করেন। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানিরা গোবিন্দগঞ্জ থেকে লামাকাজিতে পালিয়ে যায়।
এবার মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা শোনা যাক মীর শওকত আলীর বয়ান (১৯৭৪) থেকে। ‘প্রথমে আমি মেজর জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে ১ নম্বর সেক্টরে তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করি। ৩০ মার্চের পর তিনি আমার সঙ্গে আর ছিলেন না। সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন। কাজেই তখন থেকে মুক্তিবাহিনীর পুরো কমান্ড আমার হাতে এসে পড়ে।
‘২ মে বিকেলে আমরা সীমান্তের ওপারে যাই। কিছুদিন পর জেনারেল (তখন কর্নেল) ওসমানী আমাকে ডেকে বললেন, সিলেট এলাকায় সেক্টর খোলা হয়নি। ওই এলাকায় অনেক ইপিআর, স্বেচ্ছাসেবক ও সেনা বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে অবিলম্বে শিলং যেতে এবং ওখানে থেকে যুদ্ধ সংগঠন করতে।
‘সেখানে গিয়ে দেখি, আমাদের লোকজন খুব বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। না ছিল রসদপত্র, না ছিল কোনো যুদ্ধ সংগঠন। পরে আমাকে ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো। এলাকাটি ছিল বেশ দুর্গম। আমি আমার এলাকা পাঁচটি সাবসেক্টরে ভাগ করি।
‘আমি বুঝলাম, বিদেশের মাটিতে বসে দেশে যুদ্ধ করা যায় না। কাজেই আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে জায়গা করে নেওয়াই আমার প্রধান কর্তব্য মনে হলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল ভেতরে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকলাম। আমরা কিছুটা সফলও হলাম। কিছু এলাকা আমাদের দখলে নিয়ে এলাম।
‘আমি নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের ভেতরে কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলি। এই এলাকার যাঁরা যুদ্ধে আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের আমরাই প্রশিক্ষণ দিতাম। আবার সীমান্তসংলগ্ন ভারতের মাটিতেও প্রশিক্ষণ-শিবির ছিল। সেখানে ভারতীয় প্রশিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ দিতেন।
‘আমাদের রণকৌশল যা হওয়া উচিত, তা-ই ছিল। গেরিলা রণকৌশলকে আমরা প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। যুদ্ধের নিয়ম হলো, কোনো বড় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর তার সঙ্গে চিরাচরিত যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করলে হারতে হবে। এ স্থলে চিরাচরিত রীতি ভঙ্গ করে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে।
‘এ পদ্ধতিতে আমরা শত্রুর (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) ওপর আক্রমণ করে পালিয়ে যেতাম। অর্থাৎ রোজ এ পদ্ধতিতে আঘাত করে তাদের শক্তি কমিয়ে দেওয়া। এতে শত্রুর অনেক ক্ষতি হতো। আমাদের তেমন কিছুই হতো না।
‘আমরা জানতাম, একটা সময় আমরা নিয়মিত বাহিনী গঠন করে আমাদের দেশ পুনরুদ্ধার করতে পারব। নভেম্বরের শেষে আমরা চিরাচরিত যুদ্ধে লিপ্ত হলাম। ৩ ডিসেম্বর আমরা টেংরাটিলা দখল করলাম। তারপর ছাতক ও সুনামগঞ্জ। এরপর আমরা সিলেটের দিকে ধাবিত হলাম। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা ঘোষিত হলো।’
মীর শওকত আলী ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। এর অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরে। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য মীর শওকত আলীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৬।
মীর শওকত আলী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের পর প্রেষণে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসর নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে মারা যান। তাঁর মরদেহ ঢাকার সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মীর শওকত আলীর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার বিবিরবাজারে (এমভিআই আহমেদস হাউস, জগন্নাথ মন্দির)। স্থায়ীভাবে বাস করতেন ঢাকায় (ঠিকানা: বাসা-২৬, সড়ক-১১৩, গুলশান)। তাঁর বাবার নাম মীর মাহবুব আলী। স্ত্রী তাহমিনা শওকত। তাঁদের তিন মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.