মুজিব আমাদের হিমালয় বাংলার এভারেস্ট by কে. এম. এনায়েত হোসেন

বঙ্গবন্ধুকে দেখলে বাংলাদেশ দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে জানলে বাংলাদেশকে জানা হয়। আমরা যারা বাংলাদেশের জন্মের প্রসব বেদনার ব্যথা কিঞ্চিত হলেও সহ্য করেছি, ’৭১-কে প্রত্যক্ষ করেছি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সঙ্গে, তাদের কাছে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এমনই, যেমনটি বলেছি শুরুতে।


এ প্রত্যয়ের ব্যতিক্রমী ধারণার লোক যে একেবারেই ছিল না তা নয়। তখনও ছিল, এখনও আছে। মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক মানুষ ধর্মের নামে যা কিছু অধর্মের, অন্যায়ের, অপরাধের তার কোনটাই করতে বাকি রাখেনি সে সময়ে। তারা বাঙালী হয়েও যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানীদের পক্ষে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছে তারা। জয় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর, বিজয় হয়েছে বাংলাদেশের, বিজয়ী হয়েছে সাড়ে সাত কোটি, আজকের ষোলো কোটি জনসংখ্যার বাঙালী জাতি।
শত সহস্র মায়ের অশ্রু আর জানা অজানা অসংখ্য বীরের রক্ত, ভালবাসা, দেশপ্রেম, ত্যাগ আর রক্তধারায় সিক্ত, কন্টকিত রাজপথ পেরিয়ে আমরা এসে উপনীত হই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। বাঙালী জাতির জন্য বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ যেমন মহাগৌরবের তেমনি মহাকলঙ্কেরও। এই সময়টাতেই অর্থাৎ ষাটের দশকে একজন শেখ মুজিব তাঁর গভীর দেশপ্রেম, অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা আর অসীম সাহসিকতার বলে হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। তার দেয়া ছয় দফায় মূর্ত হয়ে উঠল বাঙালী জাতির প্রাণের চাওয়া। সে চাওয়াকে পাওয়ায় রূপান্তরিত করতে বঙ্গবন্ধুু চষে বেড়ালেন বাংলার শহর, বন্দর, নগর, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা সব। তাঁর বজ্রকণ্ঠের তেজোদীপ্ত ভাষণ আর বিশাল হৃদয়ের আবেগ সঞ্চারিত হতে থাকল হৃদয় থেকে হৃদয়ে, ঘর থেকে ঘরে, জন থেকে জনে আর মন থেকে মনে। এমনি একটা সময়ে সত্তরের প্রাক নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুকে অতি কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার মাটিভাঙ্গা কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুর সভা। আমরা মিছিল করে থানা সদর থেকে পৌঁছেছি কলেজ মাঠে। সঙ্কীর্ণ রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ হয়ে আমরা অগুনতি মানুষ অপেক্ষা করছিলাম বঙ্গবন্ধুর আগমনের। তিনি এলেন। দীর্ঘ ঋজু দেহের বঙ্গবন্ধু কপালে হাত উঠাতে উঠাতে নামাতে নামাতে এগিয়ে চললেন মঞ্চের দিকে। মাত্র এক হাত দুরত্বের ব্যবধানে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে। ষোলো বছরের তরুণ হৃদয়ে আমার খেলে গেল যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুত শিহরণ। মিছিল আর রোদের ক্লান্তি কোথায় উবে গেল; হৃদয়ের গভীর কন্দরে অনুভব করলাম এক অভূতপূর্ব সঞ্জীবন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে জলদগম্ভীর কণ্ঠে অনেক কথা বললেন। তার মধ্যে আজও আমার কানে অনুরণন ঘটায় বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটি “আমরা ক্ষমতায় গেলে ওইসব পশ্চিমা ভুঁড়িওয়ালাদের ভুঁড়ির ওপরে ট্যাক্স বসাব।” বঙ্গবন্ধুর এই কথাটিই আমার মতো অসংখ্য হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত করে দিয়েছিল একটি বাস্তব প্রত্যয় ‘আমরা আর ওরা’- এর মধ্যেই ছিল, আমার বিশ্বাস, আমাদের বাঙালী জাতির আলাদা স্বাধীন অস্তিত্বের সুস্পষ্ট ইশারা। একজন শেখ মুজিব থেকে কোন্ জাদুমন্ত্র বলে তিনি হয়ে উঠলেন জাতির জনক? কোন্ শক্তির বলে জাতিকে উপহার দিতে পারলেন একখ- নিজস্ব আবাসভূমি? আর কেনইবা জাতির এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে সপরিবারে কারা বর্বরতম নৃশংসতায় হত্যা করল স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়? সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও আসে, স্বাধীনতার ৪১ বছর পেরিয়ে এলেও আমরা কেন পারলাম না স্বাধীন সে আবাসভূমিকে বাসযোগ্য করে তুলতে?
প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যেতে পারি স্বামী বিবেকানন্দের কাছে। যিনি বলেছেন, “যে সব মানুষ যায়, তাদের মধ্যে কতক কতক মানুষ কালের গায়ে একটা দাগ রেখে যায়।” ইংরেজ কবি একেই ঋড়ড়ঃ-ঢ়ৎরহঃং ড়হ ঃযব ংধহফং ড়ভ ঃরসব” বলেছেন, অর্থাৎ সময়ের বেলাভূমিতে পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জন ক্ষণজন্মা পুরুষ এমনি সময়ের বুকে পদচিহ্ন রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতমÑ আমাদের বন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব। যার কীর্ত্তি অমর করে রেখেছে তাঁকে। সংস্কৃত কবির ভাষায় ‘কীর্ত্তির্যস্য স জীবতি।’ প্রাসঙ্গিক বিধায় নির্যাতিত মানবতার বন্ধু কিউবান বিপ্লবের নায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ঐতিহাসিক সেই উক্তিটি মনে পড়ে যায়। ১৯৭৩ সালে আলজিরিয়ায় নির্জোট সম্মেলনে মহাকালের দুর্গম পথের ক্লান্তিহীন অভিযাত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখে তিনি বলেছিলেন, “একসময় নেপাল গিয়ে মনোরম হিমালয় দেখবার প্রবল ইচ্ছা ছিল, আজ আপনাকে স্বচক্ষে দেখে সে ইচ্ছা উবে গেল। হিমালয় দেখবার আর প্রয়োজন নেই।” এ যেন আমাদের প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী রাষ্ট্র নায়কের গেয়ে ওঠা ; মুজিবের মুখ আমি দেখিয়াছি তাই, হিমালয়ের বুক আমি খুঁজিতে যাই না আর। ... মুজিব আমাদের হিমালয়, বাংলার এভারেস্ট।
শেষ দুটি প্রশ্নের উত্তরে সংক্ষেপে এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে, বাংলার হিমালয় সুউচ্চ শিরে বাংলাকে সত্যিকার অর্থে সোনার বাংলা তৈরি করতে গিয়ে যে সব দেশী বিদেশী স্বার্থশিকারীদের কোপানলে পড়েছিলেন তারাই তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছে নির্মম পৈশাচিকতায়। আর বেগুন গাছকে বটগাছের স্থলাভিষিক্ত করায় জাতি হিসেবে আমরা হারিয়ে বসেছি আমাদের সকল মূলধন -দেশপ্রেম, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ আর সাহসিকতা। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেতে উঠেছি সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ইঁদুর দৌড়ে।
তবে মানুষ স্বভাবতই আশাবাদী। আমরাও। একদিন শেষ হতেই হবে এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থ তাড়নাজাত ইঁদুর দৌড়ের। আমরা ফিরে যাব বঙ্গবন্ধু... বাংলার এভারেস্টের কাছে। সেইভাবে, যেভাবে বলেছেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি টেনিসন তাঁর কবিতায় : “ঞযব সড়ৎঃধষ মড়বং, ফঁংঃ ঃড় ফঁংঃ; ধংযবং ঃড় ধংযবং;/ ঐব ঃযধঃ ধিং মৎবধঃ রহ যরস রং মড়হব,/ এড়হব ভড়ৎ বাবৎ; নঁঃ হড়ঃযরহম পধহ/ ইবৎবধাব যরস ড়ভ ঃযব ভড়ৎপব যব/ গধশবং যরং ড়হি ষরারহম যবৎব.”
মানুষ যায়,... কোথায়, কোন্ অনন্ত সাগরে মিলে মিশে যায়,...কিন্তু তার সবটুকু যায় না। বিশ্বমাঝে তাঁর কীর্তির মাধ্যমে যে শক্তিটুকু রেখে যায় তা চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যায় না বরং উত্তরোত্তর সে শক্তির তেজ অনুসারে ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ কথার সত্যতা পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি স্বার্থশিকারীদের অবিরাম অপপ্রচার আর বঙ্গবন্ধুর গায়ে কালিমা লেপনের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও আজকের প্রজন্মের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘রোল মডেল’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট

No comments

Powered by Blogger.