ইতিউতি-ঈদের পর করার আছে অনেক কিছু by আতাউস সামাদ
পশ্চিমা দেশের লাখ লাখ মানুষ, যাঁরা গত বৃহস্পতিবার মার্কিন সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান এনবিসির ফটো ব্লগ দেখেছেন, তারা বাংলাদেশের একটা ছবি দেখে মাথা নাড়বেন। তাঁরা কেউ হয়তো বলবেন, 'এরা পাগল।' আবার অন্য কেউ মন্তব্য করবেন, 'এখনো এমন হয়!' ওই ব্লগে বাংলাদেশের তিনটি ছবি ছিল 'মিলিয়নস মেইক এ ক্রাউডেড (সামটাইমস
ডেঞ্জারাস) জার্নি হোম ফর ঈদুল ফিতর', অর্থাৎ 'লাখ লাখ মানুষ প্রচণ্ড ভিড় করে (কখনো কখনো বিপজ্জনকভাবে) ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাড়ি যাচ্ছে'- এই শিরোনামে। ছবিগুলোর দুটি ট্রেনের ছাদে ঝাঁক ঝাঁক মানুষের। তিন নম্বরটি ছিল একটি লঞ্চের। মনে হয় যেন যাত্রীরা লঞ্চটাকে মৌচাকের মৌমাছির মতো ঘিরে রেখেছে। চতুর্থ একটা ছবি ছিল ইন্দোনেশিয়ার। এতেও দেখা যাচ্ছে, ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য যাত্রীরা জাহাজে উঠতে মস্ত ভিড় করেছে। কিন্তু এ ছবিতে কাউকে ছাদে উঠতে দেখা যাচ্ছিল না।
আমরা বাংলাদেশের ট্রেনের ছাদে যাত্রী দেখতে অভ্যস্ত। লঞ্চবোঝাই করে অসংখ্য লোক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে- এমন ছবি আমরা প্রতিবছরই দেখছি। আমাদের দেশে লোক বেশি, তবে পথ কম, বাহন আরো কম; কাজেই আমরা পত্রিকাওয়ালারা যাকে বলি 'উপচে পড়া ভিড়', তা লেগেই থাকে। যেসব দেশে মানুষের তুলনায় জমি অনেক বেশি, তারা আমাদের এখানে লোক গিজগিজ করতে দেখে শুধু অবাকই হন না, তাদের কেউ কেউ ভয়ও পেয়ে যান, যেমনটা পেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন।
তবে এনবিসিতে প্রচারিত ছবিগুলোর প্রথমটা দেখে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়, আমার মতো অনেকেই শিউরে উঠেছেন। ছবিটার সামনের দিকেই দেখা যাচ্ছিল এক সহজ-সরল কন্যা শিশুকে। মেয়েটি একটা মাঝারি আয়তনের থলি আঁকড়ে ধরে ট্রেনের ছাদে বসে আছে তার অভিভাবকের সঙ্গে। এই ছোট্ট সরল শিশুটির চোখমুখ অবাক বিস্ময়ে ভরা। ছবির ক্যাপশনে আছে ট্রেনটি ঢাকা থেকে জামালপুর যাচ্ছে। অতটা পথ বাচ্চাটা যাবে ট্রেনের ছাদে বসে? ছুটন্ত ট্রেনের খোলা ছাদে বসে দুরন্ত বাতাসের ঝাঁপটায় যদি তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে তন্দ্রায়? যদি বৃষ্টি নামে? বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যদি সে ঢলে পড়ে? তাহলে কি মেয়েটি চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাবে? তার অভিভাবক কি তাকে ধরে রাখতে পারবেন শেষ পর্যন্ত? এরকম আতঙ্কিত একরাশ প্রশ্ন মুহূর্তের মধ্যে মনটাকে ধাক্কা দিয়ে গেল। প্রথম দৃষ্টিতে যেটাকে সাদামাটা, কিন্তু এর পরই যা দেখা দিল অসাধারণ হিসেবে- সেই ছবিটি তুলেছেন রয়টার্স বার্তা সংস্থার অ্যান্ড্রু বিরাজ (Andrew Biraj)। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু তা যদি কখনো হয় তাহলে কী করব- তাঁকে বুক-কাঁপানো ছবিটার জন্য অভিনন্দন জানাব? নাকি বাংলাদেশের রূঢ় বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ধন্যবাদ দেব? নাকি ওরকম ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য বকে দেব? বুঝতে পারছি না।
তবে এ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটিতে বর্ণিত একটা ঘটনার কথাও বারবার মনে পড়ছিল। শেখ সাহেব তখন কলেজের ছাত্র। দিল্লি গিয়েছিলেন 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ'-এর এক সম্মেলন দেখতে। সেখান থেকে কলকাতা ফেরার দিন দিল্লি স্টেশনে এসে দেখেন ট্রেনে জায়গা নেই। কোনোরকমে একটা আপার ক্লাস কামরায় তাঁদের স্যুটকেস ঠেসে দিয়ে দুই বন্ধু কামরায় কামরায় উঁকি দিচ্ছেন একটু জায়গার জন্য। হঠাৎ দেখেন ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। ব্রডগেজ গাড়ি, শক্তপোক্ত রেললাইন, পাথুরে জমিতে বসানো। তাই ট্রেইনের গতি বেড়ে যায় মুহূর্তেই। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বন্ধু লাফিয়ে একটা কম্পার্টমেন্টের দরজার হাতল ধরে এর পা-দানিতে উঠে পড়লেন। কিন্তু খানিক পরই উপলব্ধি করলেন যে ঘোর বিপদে পড়েছেন তাঁরা। ট্রেন ছুটছে খুব জোরে। বাতাসে চোখ খোলা রাখতে পারছেন না। ট্রেন যত জোরে ছোটে তত শক্ত করে ধরেন কম্পার্টমেন্টের হাতল; কিন্তু খানিকক্ষণ পর ঠাণ্ডায় হাতের আঙুলগুলো জমাট বেঁধে আসে। তিনি বন্ধুকে বুক দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। তবু মনে হয় আর পারা গেল না, এখনই মুঠো আলগা হয়ে যাবে। ট্রেন থেকে ছিটকে পড়বেন তাঁরা। এমন সময় ট্রেনের গতি কমে আসে, রেলগাড়িটা একটা স্টেশনে এসে থেমে যায়। দুই উৎসাহী ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী প্রাণে বেঁচে যান। অতঃপর তাঁরা দ্রুতই নেবে পড়ে ছুটতে ছুটতে অন্য একটা কামড়ায় জানালা দিয়ে উঠে পড়েন। বঙ্গবন্ধু হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার বেশ আগে তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম কর্মী শেখ মুজিবের যৌবনে ওই ঘটনাটি ছিল একটা অঘটন বা বিভীষিকাময় অ্যাডভেঞ্চার। তবে এখন আমাদের জন্য দুঃখের ব্যাপার হলো এই, বাংলাদেশে চলন্ত ট্রেনের ছাদে আর ট্রেনের পা-দানিতে করে মানুষ চলাচল প্রতিদিনের ঘটনা। তবুও ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য মন ছাঁৎ ছাঁৎ করছিল।
জনবাহনে (mass transport) যথেষ্ট জায়গা না থাকায় অথবা প্রয়োজনের তুলনায় জনবাহন ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ার দরুন বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই মাঝেমধ্যে অচল হয়ে পড়ে অথবা খুঁড়িয়ে চলে।
এ রকমভাবে চলছে বাংলাদেশের অনেক কিছুই। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং কমেছে, তবে বর্ষা শেষ হয়ে গেলে নতুন ফসলের আবাদের জন্য সেচের কাজে যখন আবার প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে, তখন লোডশেডিং কত ঘন ঘন হয় কে জানে? এবার খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারে কোনো রকম শৈথিল্য দেখানো যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচণ্ড খরার দরুন সে দেশে গম ও ভুট্টা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়াও বলেছে, এবার সে দেশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ লাখ টন গম কম উৎপাদন হবে। অর্থাৎ বিশ্ব খাদ্য বাজারে গম ও ভুট্টার সরবরাহ কম হবে আর দামও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যাদের রপ্তানি করার মতো চাল ও গম থাকবে খাদ্য-আমদানিকারক দেশগুলো তাদের দিকে হাত বাড়াবে। বাংলাদেশকেও প্রতিবছরই চাল আর গম আমদানি করতে হয়- তা বেশি পরিমাণে হোক বা কম। তাই বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির সময় আমাদেরও কম সরবরাহ আর বেশি দামের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এদিকে জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে ভর্তুকি, সরকারের ঋণপত্র গ্যারান্টি এবং ব্যাংকগুলোর কাছে পেট্রোবাংলা তথা সরকারের পর্বত-প্রমাণ ঋণের সমস্যা তো আছেই। সব কিছু মেলালে আরেক ধাক্কা মূল্যস্ফীতির অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি শিশু ও কিশোর। সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। কিন্তু একই সঙ্গে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার মান নিয়ে। আর তা কেবল বইপত্র বা ক্লাসে পাঠদান প্রসঙ্গেই নয়; বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় শিক্ষকদের কোন্দল, ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তাঁদের দলবাজি এমন পর্যায়ে গেছে যে লেখাপড়া করা তো দূরের কথা, ইজ্জত আর প্রাণ বাঁচানোই বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা নৈতিকতা শিখবে, যে বিদ্যাপীঠ দেশের পুরো সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, সেগুলো এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। বেশ কিছু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতে সাধারণ মানুষ ভয় পায়।
আজকাল অবশ্য প্রাণের ভয় সবখানেই, ক্রিমিনালদের বিচরণ যত্রতত্র। ছিনতাইকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পথে মানুষ খুন করে, খুনিরা শোওয়ার ঘরে মা-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খুন করে যাচ্ছে অনায়াসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর পর দু'বার স্কুল আর উপাসনালয়ে নিরীহ মানুষের ওপর ঘাতকদের নির্বিচার গুলি বর্ষণের পৈশাচিক ঘটনার পর সেই দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মন্তব্য করেছিলেন যে এ রকম হত্যাকাণ্ড জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সরকার থেকে এ রকম কথা কেউ বলেননি। কর্তৃপক্ষ, তা রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক যা-ই হোক, বলছে সব ঠিক আছে। দায়বোধ এখানে শূন্যের কোঠায়। সরকার বুঝতে পারুক আর না পারুক এসব সমস্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ জমা হয়েছে। তা জানার জন্য মাটিতে কান পাতার দরকার হয় না। আজকাল বিয়ে বাড়িতে গেলে বা ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ডাক পড়ার অপেক্ষায় বসে থাকার সময়ও পরিচিত বা অর্ধ-পরিচিতরা অন্তত একবার প্রশ্ন করেন, 'ভাই, সাগর-রুনি হত্যার রহস্য কি জানা গেল? অপরাধীদের চেনা গেছে?' বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়ি চালকের গুম হওয়া নিয়ে 'যেমন উত্থান তেমন পতন' মন্তব্যটি আইনের আশ্রয়প্রার্থী সব নাগরিকের মনে আঘাত দিয়েছে। তাহলে সরকার কি বলতে চাচ্ছে যে, যারা গুম হয়ে যাচ্ছে তারা সবাই সন্দেহভাজন। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের (যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক মামলা করেছে) ড্রাইভার (যিনি দুর্নীতি ফাঁস করে দিয়েছিলেন) যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন, তিনি কোন মানদণ্ডে পরিচিত হবেন অথবা গুম হয়ে যাওয়া মিরপুরের চার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অপরিচিত ছাত্রটি? অন্যদিকে আমরা প্রতিদিনই খুব ভালোভাবে অনুভব করছি যে আমাদের সবার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা দরকার; পলায়নী মনোবৃত্তি, দায়িত্বহীন মন্তব্য নয়। সম্প্রতি ঢাকা বসবাসের জন্য নিকৃষ্টতম রাজধানী শহর বলে চিহ্নিত হয়েছে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্লেষণে। তাতে নিরাপত্তা একটি বিবেচ্য বিষয় ছিল।
আমরা এ ক্ষেত্রে অন্য একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। রাজধানী ঢাকা এখন দেশটির প্রচণ্ড ধনবৈষম্য এবং আয় বৈষম্যের প্রতীক। ঢাকা শহরের মহাসড়কের ফুটপাতগুলো তো বটেই, এমনকি শাখা সড়ক আর অলিগলিতেও দেখা যায় দরিদ্র মানুষ একটা টুকরিতে অল্প কিছু পসরা সাজিয়ে বসেছে যৎসামান্য আয় করার আশায়। ঢাকার অনেক গলিতে, দৃষ্টির একটু আড়ালে গড়ে উঠছে হতদরিদ্র বস্তি। এগুলো সবই বৈষম্যের প্রকট চিহ্ন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরেই জাকাতের শাড়ির জন্য হাত পাততে গিয়ে যে তিন নারী পদদলিত হয়ে নিহত হলেন, তাঁরা বিত্তহীনদের মিছিলে শরিক ছিলেন। এ বৈষম্য একসময় সমাজে ও রাজনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। পাশের দেশ ভারতে দরিদ্ররা যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে কি? ভারতে তবু ভালো যে দরিদ্রের ওই বিদ্রোহ হচ্ছে একটা রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। ফলে আর যা-ই হোক না হোক বিদ্রোহীদের চেনা যায়, ইচ্ছা থাকলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনা করা যায়। কিন্তু দরিদ্র যুবক আর কিশোরদের যখন একেকটা মাফিয়াচক্র নৈরাজ্য সৃষ্টির পদাতিক হিসেবে ব্যবহার করে, তখন নীতিহীন তথা দুর্নীতিকবলিত রাজনীতি দিয়ে তাদের সামাল দেওয়া যায় না। বরঞ্চ যে রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত তাঁরা মাফিয়া-ব্যবসার বড় শরিক হয়ে যান। এই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে 'গ্রাঁ করাপশান' বা বড় আকারের দুর্নীতি হচ্ছে। এমনকি তা হচ্ছে দেশি-বিদেশি অংশীদারির ভিত্তিতে। আবার কোনো কোনো ধূর্ত ব্যক্তি জুতসই জায়গায় তৈলমর্দন করে অবলীলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব দুষ্কর্মের খবর প্রকাশ পেয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অনুসন্ধানীরাও প্রমাণ পেয়েছেন এ রকম দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও জালিয়াতির। সরকারের হাতে এখন বেশ কালি লেগে গেছে।
বাংলাদেশকে একটা নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ আর টেকসই অর্থনীতি ও উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। আমরা যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাঁদের জবাবদিহি আদায়কারী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকবে- এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এটাই কাম্য, এটাই রীতি, এটাই নিয়ম দুনিয়াজুড়ে। এ নিয়ম মেনে চললে দেশে শান্তি থাকে। নাগরিকরা উজ্জীবিত হন। জেল-জুলুম আর হটকারিতা দিয়ে না অর্জন করা যায় শান্তি, না স্থিতিশীলতা, না সুশাসন। এভাবে বিরোধী দল আর ভিন্ন মতাবলম্বীদের বাধ্য করা হয় রাজপথের আন্দোলনে নামতে। তারাও আওয়াজ তোলে, 'বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই।' আগামী সংসদ নির্বাচন কোন পন্থায় হবে, তথা কার তত্ত্বাবধানে হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিদ্যমান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন চিন্তাশীল ব্যক্তি ও বিশিষ্ট নাগরিক এ সমস্যা নিরসনের জন্য তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি একে অপরের গায়ে হাত লাগানোর মতো স্থান একটু পিছিয়ে যেত তাহলে তাদের যুক্তিপূর্ণ পরামর্শগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য জায়গা তৈরি হতো। শান্তি ফেরত আসার সুযোগ পেত আর জাতি কাজের কাজগুলোয় মনোনিবেশ করতে পারত।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আমরা বাংলাদেশের ট্রেনের ছাদে যাত্রী দেখতে অভ্যস্ত। লঞ্চবোঝাই করে অসংখ্য লোক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে- এমন ছবি আমরা প্রতিবছরই দেখছি। আমাদের দেশে লোক বেশি, তবে পথ কম, বাহন আরো কম; কাজেই আমরা পত্রিকাওয়ালারা যাকে বলি 'উপচে পড়া ভিড়', তা লেগেই থাকে। যেসব দেশে মানুষের তুলনায় জমি অনেক বেশি, তারা আমাদের এখানে লোক গিজগিজ করতে দেখে শুধু অবাকই হন না, তাদের কেউ কেউ ভয়ও পেয়ে যান, যেমনটা পেয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন।
তবে এনবিসিতে প্রচারিত ছবিগুলোর প্রথমটা দেখে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়, আমার মতো অনেকেই শিউরে উঠেছেন। ছবিটার সামনের দিকেই দেখা যাচ্ছিল এক সহজ-সরল কন্যা শিশুকে। মেয়েটি একটা মাঝারি আয়তনের থলি আঁকড়ে ধরে ট্রেনের ছাদে বসে আছে তার অভিভাবকের সঙ্গে। এই ছোট্ট সরল শিশুটির চোখমুখ অবাক বিস্ময়ে ভরা। ছবির ক্যাপশনে আছে ট্রেনটি ঢাকা থেকে জামালপুর যাচ্ছে। অতটা পথ বাচ্চাটা যাবে ট্রেনের ছাদে বসে? ছুটন্ত ট্রেনের খোলা ছাদে বসে দুরন্ত বাতাসের ঝাঁপটায় যদি তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে তন্দ্রায়? যদি বৃষ্টি নামে? বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যদি সে ঢলে পড়ে? তাহলে কি মেয়েটি চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাবে? তার অভিভাবক কি তাকে ধরে রাখতে পারবেন শেষ পর্যন্ত? এরকম আতঙ্কিত একরাশ প্রশ্ন মুহূর্তের মধ্যে মনটাকে ধাক্কা দিয়ে গেল। প্রথম দৃষ্টিতে যেটাকে সাদামাটা, কিন্তু এর পরই যা দেখা দিল অসাধারণ হিসেবে- সেই ছবিটি তুলেছেন রয়টার্স বার্তা সংস্থার অ্যান্ড্রু বিরাজ (Andrew Biraj)। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু তা যদি কখনো হয় তাহলে কী করব- তাঁকে বুক-কাঁপানো ছবিটার জন্য অভিনন্দন জানাব? নাকি বাংলাদেশের রূঢ় বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ধন্যবাদ দেব? নাকি ওরকম ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য বকে দেব? বুঝতে পারছি না।
তবে এ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটিতে বর্ণিত একটা ঘটনার কথাও বারবার মনে পড়ছিল। শেখ সাহেব তখন কলেজের ছাত্র। দিল্লি গিয়েছিলেন 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ'-এর এক সম্মেলন দেখতে। সেখান থেকে কলকাতা ফেরার দিন দিল্লি স্টেশনে এসে দেখেন ট্রেনে জায়গা নেই। কোনোরকমে একটা আপার ক্লাস কামরায় তাঁদের স্যুটকেস ঠেসে দিয়ে দুই বন্ধু কামরায় কামরায় উঁকি দিচ্ছেন একটু জায়গার জন্য। হঠাৎ দেখেন ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। ব্রডগেজ গাড়ি, শক্তপোক্ত রেললাইন, পাথুরে জমিতে বসানো। তাই ট্রেইনের গতি বেড়ে যায় মুহূর্তেই। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বন্ধু লাফিয়ে একটা কম্পার্টমেন্টের দরজার হাতল ধরে এর পা-দানিতে উঠে পড়লেন। কিন্তু খানিক পরই উপলব্ধি করলেন যে ঘোর বিপদে পড়েছেন তাঁরা। ট্রেন ছুটছে খুব জোরে। বাতাসে চোখ খোলা রাখতে পারছেন না। ট্রেন যত জোরে ছোটে তত শক্ত করে ধরেন কম্পার্টমেন্টের হাতল; কিন্তু খানিকক্ষণ পর ঠাণ্ডায় হাতের আঙুলগুলো জমাট বেঁধে আসে। তিনি বন্ধুকে বুক দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। তবু মনে হয় আর পারা গেল না, এখনই মুঠো আলগা হয়ে যাবে। ট্রেন থেকে ছিটকে পড়বেন তাঁরা। এমন সময় ট্রেনের গতি কমে আসে, রেলগাড়িটা একটা স্টেশনে এসে থেমে যায়। দুই উৎসাহী ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী প্রাণে বেঁচে যান। অতঃপর তাঁরা দ্রুতই নেবে পড়ে ছুটতে ছুটতে অন্য একটা কামড়ায় জানালা দিয়ে উঠে পড়েন। বঙ্গবন্ধু হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার বেশ আগে তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম কর্মী শেখ মুজিবের যৌবনে ওই ঘটনাটি ছিল একটা অঘটন বা বিভীষিকাময় অ্যাডভেঞ্চার। তবে এখন আমাদের জন্য দুঃখের ব্যাপার হলো এই, বাংলাদেশে চলন্ত ট্রেনের ছাদে আর ট্রেনের পা-দানিতে করে মানুষ চলাচল প্রতিদিনের ঘটনা। তবুও ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য মন ছাঁৎ ছাঁৎ করছিল।
জনবাহনে (mass transport) যথেষ্ট জায়গা না থাকায় অথবা প্রয়োজনের তুলনায় জনবাহন ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ার দরুন বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই মাঝেমধ্যে অচল হয়ে পড়ে অথবা খুঁড়িয়ে চলে।
এ রকমভাবে চলছে বাংলাদেশের অনেক কিছুই। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং কমেছে, তবে বর্ষা শেষ হয়ে গেলে নতুন ফসলের আবাদের জন্য সেচের কাজে যখন আবার প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে, তখন লোডশেডিং কত ঘন ঘন হয় কে জানে? এবার খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারে কোনো রকম শৈথিল্য দেখানো যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচণ্ড খরার দরুন সে দেশে গম ও ভুট্টা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়াও বলেছে, এবার সে দেশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ লাখ টন গম কম উৎপাদন হবে। অর্থাৎ বিশ্ব খাদ্য বাজারে গম ও ভুট্টার সরবরাহ কম হবে আর দামও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যাদের রপ্তানি করার মতো চাল ও গম থাকবে খাদ্য-আমদানিকারক দেশগুলো তাদের দিকে হাত বাড়াবে। বাংলাদেশকেও প্রতিবছরই চাল আর গম আমদানি করতে হয়- তা বেশি পরিমাণে হোক বা কম। তাই বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির সময় আমাদেরও কম সরবরাহ আর বেশি দামের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এদিকে জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে ভর্তুকি, সরকারের ঋণপত্র গ্যারান্টি এবং ব্যাংকগুলোর কাছে পেট্রোবাংলা তথা সরকারের পর্বত-প্রমাণ ঋণের সমস্যা তো আছেই। সব কিছু মেলালে আরেক ধাক্কা মূল্যস্ফীতির অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি শিশু ও কিশোর। সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। কিন্তু একই সঙ্গে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার মান নিয়ে। আর তা কেবল বইপত্র বা ক্লাসে পাঠদান প্রসঙ্গেই নয়; বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় শিক্ষকদের কোন্দল, ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তাঁদের দলবাজি এমন পর্যায়ে গেছে যে লেখাপড়া করা তো দূরের কথা, ইজ্জত আর প্রাণ বাঁচানোই বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা নৈতিকতা শিখবে, যে বিদ্যাপীঠ দেশের পুরো সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, সেগুলো এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। বেশ কিছু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতে সাধারণ মানুষ ভয় পায়।
আজকাল অবশ্য প্রাণের ভয় সবখানেই, ক্রিমিনালদের বিচরণ যত্রতত্র। ছিনতাইকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পথে মানুষ খুন করে, খুনিরা শোওয়ার ঘরে মা-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খুন করে যাচ্ছে অনায়াসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর পর দু'বার স্কুল আর উপাসনালয়ে নিরীহ মানুষের ওপর ঘাতকদের নির্বিচার গুলি বর্ষণের পৈশাচিক ঘটনার পর সেই দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মন্তব্য করেছিলেন যে এ রকম হত্যাকাণ্ড জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সরকার থেকে এ রকম কথা কেউ বলেননি। কর্তৃপক্ষ, তা রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক যা-ই হোক, বলছে সব ঠিক আছে। দায়বোধ এখানে শূন্যের কোঠায়। সরকার বুঝতে পারুক আর না পারুক এসব সমস্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ জমা হয়েছে। তা জানার জন্য মাটিতে কান পাতার দরকার হয় না। আজকাল বিয়ে বাড়িতে গেলে বা ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ডাক পড়ার অপেক্ষায় বসে থাকার সময়ও পরিচিত বা অর্ধ-পরিচিতরা অন্তত একবার প্রশ্ন করেন, 'ভাই, সাগর-রুনি হত্যার রহস্য কি জানা গেল? অপরাধীদের চেনা গেছে?' বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়ি চালকের গুম হওয়া নিয়ে 'যেমন উত্থান তেমন পতন' মন্তব্যটি আইনের আশ্রয়প্রার্থী সব নাগরিকের মনে আঘাত দিয়েছে। তাহলে সরকার কি বলতে চাচ্ছে যে, যারা গুম হয়ে যাচ্ছে তারা সবাই সন্দেহভাজন। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের (যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক মামলা করেছে) ড্রাইভার (যিনি দুর্নীতি ফাঁস করে দিয়েছিলেন) যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন, তিনি কোন মানদণ্ডে পরিচিত হবেন অথবা গুম হয়ে যাওয়া মিরপুরের চার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অপরিচিত ছাত্রটি? অন্যদিকে আমরা প্রতিদিনই খুব ভালোভাবে অনুভব করছি যে আমাদের সবার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা দরকার; পলায়নী মনোবৃত্তি, দায়িত্বহীন মন্তব্য নয়। সম্প্রতি ঢাকা বসবাসের জন্য নিকৃষ্টতম রাজধানী শহর বলে চিহ্নিত হয়েছে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্লেষণে। তাতে নিরাপত্তা একটি বিবেচ্য বিষয় ছিল।
আমরা এ ক্ষেত্রে অন্য একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। রাজধানী ঢাকা এখন দেশটির প্রচণ্ড ধনবৈষম্য এবং আয় বৈষম্যের প্রতীক। ঢাকা শহরের মহাসড়কের ফুটপাতগুলো তো বটেই, এমনকি শাখা সড়ক আর অলিগলিতেও দেখা যায় দরিদ্র মানুষ একটা টুকরিতে অল্প কিছু পসরা সাজিয়ে বসেছে যৎসামান্য আয় করার আশায়। ঢাকার অনেক গলিতে, দৃষ্টির একটু আড়ালে গড়ে উঠছে হতদরিদ্র বস্তি। এগুলো সবই বৈষম্যের প্রকট চিহ্ন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরেই জাকাতের শাড়ির জন্য হাত পাততে গিয়ে যে তিন নারী পদদলিত হয়ে নিহত হলেন, তাঁরা বিত্তহীনদের মিছিলে শরিক ছিলেন। এ বৈষম্য একসময় সমাজে ও রাজনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। পাশের দেশ ভারতে দরিদ্ররা যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে কি? ভারতে তবু ভালো যে দরিদ্রের ওই বিদ্রোহ হচ্ছে একটা রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। ফলে আর যা-ই হোক না হোক বিদ্রোহীদের চেনা যায়, ইচ্ছা থাকলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনা করা যায়। কিন্তু দরিদ্র যুবক আর কিশোরদের যখন একেকটা মাফিয়াচক্র নৈরাজ্য সৃষ্টির পদাতিক হিসেবে ব্যবহার করে, তখন নীতিহীন তথা দুর্নীতিকবলিত রাজনীতি দিয়ে তাদের সামাল দেওয়া যায় না। বরঞ্চ যে রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত তাঁরা মাফিয়া-ব্যবসার বড় শরিক হয়ে যান। এই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে 'গ্রাঁ করাপশান' বা বড় আকারের দুর্নীতি হচ্ছে। এমনকি তা হচ্ছে দেশি-বিদেশি অংশীদারির ভিত্তিতে। আবার কোনো কোনো ধূর্ত ব্যক্তি জুতসই জায়গায় তৈলমর্দন করে অবলীলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব দুষ্কর্মের খবর প্রকাশ পেয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অনুসন্ধানীরাও প্রমাণ পেয়েছেন এ রকম দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও জালিয়াতির। সরকারের হাতে এখন বেশ কালি লেগে গেছে।
বাংলাদেশকে একটা নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ আর টেকসই অর্থনীতি ও উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে এখন আমাদের বড় দায়িত্ব। আমরা যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাঁদের জবাবদিহি আদায়কারী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকবে- এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এটাই কাম্য, এটাই রীতি, এটাই নিয়ম দুনিয়াজুড়ে। এ নিয়ম মেনে চললে দেশে শান্তি থাকে। নাগরিকরা উজ্জীবিত হন। জেল-জুলুম আর হটকারিতা দিয়ে না অর্জন করা যায় শান্তি, না স্থিতিশীলতা, না সুশাসন। এভাবে বিরোধী দল আর ভিন্ন মতাবলম্বীদের বাধ্য করা হয় রাজপথের আন্দোলনে নামতে। তারাও আওয়াজ তোলে, 'বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই।' আগামী সংসদ নির্বাচন কোন পন্থায় হবে, তথা কার তত্ত্বাবধানে হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিদ্যমান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন চিন্তাশীল ব্যক্তি ও বিশিষ্ট নাগরিক এ সমস্যা নিরসনের জন্য তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি একে অপরের গায়ে হাত লাগানোর মতো স্থান একটু পিছিয়ে যেত তাহলে তাদের যুক্তিপূর্ণ পরামর্শগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য জায়গা তৈরি হতো। শান্তি ফেরত আসার সুযোগ পেত আর জাতি কাজের কাজগুলোয় মনোনিবেশ করতে পারত।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments