চারদিক- জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ by মশহুরুল আমিন

দেখা হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড আর সিঙ্গাপুর দলের সঙ্গে। বাংলাদেশ দলের কথা বলছি। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমি মশহুরুল আমিন ও রোনাল্ড ক্রজ দলনেতা হিসেবে এবং সেন্ট যোসেফ স্কুলের শাহরিয়ার জাহান।


ওই যে দলাদলির কথা বলছিলাম, এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের দল, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের দুবাই বিমানবন্দরে দেখা।
সবার গন্তব্য ব্রাজিলের রিও। রিও ডি জেনিরো।
২০০৬ সাল থেকেই বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমি অলিম্পিয়াডের আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিয়ে আসছে।
সদ্য কলেজপড়ুয়া শাহরিয়ারের প্রথম বিমান ভ্রমণ, আবার প্রথম বিদেশযাত্রাও! যাত্রাপথের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব মিলিয়ে তিন-চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছে সবকিছু। কৌতূহলের শেষ নেই।
আমাদের ঢাকা যখন একে একে ঘুম ভেঙে ব্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন এই রিও ব্যস্ততা কাটিয়ে ঘুমের পরশে হারিয়ে যায়। তারুণ্য বলে কথা। রাত ১২টায়ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে নাগরিকদের ঘুম ভাঙিয়ে তরুণদের উচ্চ রবে আড্ডার দেখা মেলে।
সারা বেলা রিও দর্শনেই কেটে যায়। আগস্টের ৩ তারিখেই ঢাকা থেকে যাত্রা করে ৪ তারিখে রিও। ৫ তারিখ নিজের মতো ঘুরে বেড়ানো। কোপা কাবানা সমুদ্রসৈকত ও ১৮১৩ সালে তৈরি পর্তুগিজদের কেল্লা পরিদর্শন।
একটা ইংরেজি বাক্য বানিয়ে বলতে যার জ্বর চলে আসে, সেই অধম স্থানীয় সংগঠকদের ইংরেজি বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছি! ব্রাজিলের ভাষা পর্তুগিজ।
রিও। সময়ের মাঝে থেমে যাওয়া চলমান এক শহর। দুই-তিন শ বছরের নকশা করা পুরোনো বাড়ির পাশাপাশি বর্তমান স্থাপত্যের শেষ সংযোজন, এই শহরের যে বিষয়টি আপনাদের মুগ্ধতার আবেশে রাঙিয়ে দেবে। ফুটবল খেলছে সমবয়সী তরুণ-তরুণীরা। দম আর কৌশলে কেউ কারও চেয়ে কম নয়।
‘টুকানা’ আদিবাসী স্থানীয়দের গান আর নাচের মাদকতায় হারিয়ে যেতে যেতে দেখা পাবেন তাদের পূর্বপুরুষেরা শস্য ফলানোর জন্য বীজ বপন থেকে শস্য মাড়াই পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজে আকাশের তারাদের দেখে দিনক্ষণ ঠিক করত। টুকানাদের আবাস আমাজানের গভীরে। আকাশের তারাদের নিয়ে তাদের রয়েছে নিজস্ব গল্পগুচ্ছ। সেগুলো তারা ছড়িয়ে বেড়ায় বংশপম্পরায়।
এ হচ্ছে ‘রিও প্ল্যানেটোরিয়ামে’ অ্যাস্ট্রোনমি অলিম্পিয়াডের ষষ্ঠ আসরের উদ্বোধনী দিন। ৬ আগস্ট। বিশ্বের ২৭টি দেশের ১২৪ জন প্রতিযোগী নিয়ে এবারের আয়োজন।
৭ তারিখে দলগত প্রতিযোগিতা। ৮-এ তাত্ত্বিক পর্ব। ৯ আগস্ট পর্যবেক্ষণ আর ১০ তারিখে ডেটা পর্যালোচনা।
আকাশের জেনিথ বিন্দুতে বৃশ্চিকের পদচারণে ঢাকার আকাশ থেকে না দেখতে পাওয়া একাধিক নক্ষত্রের সঙ্গে আপনাদেরও দেখা হয়ে যাবে। স্থানীয় ব্যক্তিদের অগ্নি সর্প, আপনাদের পরিচিত বৃশ্চিক। আর শিকারি বীর কালপুরুষ এই দক্ষিণ গোলার্ধে হয়ে গেছে কচ্ছপ।
এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের দলনেতারা কেউবা সিহলি, পর্তুগিজ, কোরিয়ান, ইরানি বা রুশে অনুবাদ করছে তাত্ত্বিক পর্বের প্রশ্নপত্র। কোনো এক উটকো ঘড়ি জানান দেয়, তখন রাত তিনটা।
সকাল নয়টায় শুরু হয় আন্তর্জাতিক বোর্ড মিটিং। সংক্ষেপে ‘আইবিএম’। দেখতে দেখতে ঢাকা ছাড়ার পাঁচ রাত অতিক্রান্ত হয়। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগেই দলনেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিযোগীদের অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
দলনেতারা আইবিএমে প্রশ্নপত্র তৈরি করবে। প্রতিযোগীদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি করবে। আর প্রতিযোগীরা একে একে সেসব সমস্যাকে নাকচ করবে। করবে সমাধান। সমস্যাগুলো তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক ও পর্যবেক্ষণ—এই তিন পর্বে বিভক্ত।
‘এই যে দেখো, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত বা কোরিয়া। এরা সবাই আমাদের দেশের মতোই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। বিষয় হচ্ছে, যারা অলিম্পিয়াডে পদক পাবে, তারা চাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ভর্তি হতে পারবে, লাগবে না কোনো শিক্ষা খরচ। পুরোটাই দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যে মেধার প্রয়োজন হয়, তার অনেক কম মেধাতেই এই পদক হয়ে যায়।’ বলছিলেন রোমানীয়র দলনেতাদের একজন সৌরেন ব সোরেন। জানা হয় অন্যদের সাফল্যের মূলমন্ত্র।
১৩ আগস্ট রিও মানমন্দিরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাওয়া হয় এ প্রতিযোগিতার স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ বিজয়ীদের, আর শেষ হয় এই মিলনমেলার।
তবে শেষ হয়েও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আসর শেষ হওয়ার নয়। এবারের এশিয়া-প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, যে অনুষ্ঠান এখনো হয়নি, সে আসর বসছে আমাদের এই বাংলাদেশেই। আসছে নভেম্বর মাসে প্রথম আলো, রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকেন্দ্র ও গাইড ট্যুরের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজন করতে যাচ্ছে এবারের এশিয়া-প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো নিয়েই এই আসর।
মশহুরুল আমিন

No comments

Powered by Blogger.