মেডিক্যালে ভর্তির পদ্ধতি প্রসঙ্গে by ডা. এম এ করীম
দু-চার দিন আগে হঠাৎ সরকার নতুন করে আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করল (যদিও কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি)। তা হলো মেডিক্যালে ভর্তির নিয়ম কী হবে? আমাদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে হঠাৎ কোনো (ভালো নিয়ম বা পদ্ধতি হোক না কেন) জিনিস সহজভাবে মেনে নিতে পারি না।
তাই হঠাৎ যখন সিদ্ধান্ত এলো, মেডিক্যালে ভর্তির জন্য আর কোনো পরীক্ষা লাগবে না। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে জিপিএর ভিত্তিতে (এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল অনুযায়ী) ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে, তখন ভর্তির জন্য আগের নিয়ম অনুসারে যারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের মাথায় হাত পড়ল। বিক্ষোভে ঢাকা শহরকে কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে দিল। যদিও শোনা গেছে, এর পেছনে যত না ইচ্ছা ভর্তীচ্ছুদের, এর চেয়ে বেশি কোচিং সেন্টারগুলোর। একটু পেছনে ফেরা যাক। এর আগে বলা হয়েছিল, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার নম্বরের কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। তখন করা হলো এমসিকিউ পদ্ধতি। আমার এক অনুজ সহকর্মী ডা. সানীর ভাষায়- 'পেন্সিল ব্যবহার করতে হবে, কলম ব্যবহার করলে, খাতা বাদ, রোল নম্বর লেখার সঙ্গে সঙ্গে গোল্লাও দিতে হবে, কোনো ভুল হলেও নতুন কাগজ দেওয়া হবে না। তখন কিন্তু এত কোচিং সেন্টার গড়ে ওঠেনি। এখন যেভাবে সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে, সে রকম নেটওয়ার্কও ছিল না। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলো। বেশ কিছু ভুল আবিষ্কার হলো এ পদ্ধতির। সেখানেও গলদ রয়ে গেল। এক সেট প্রশ্নপত্র ও একই প্রশ্নপত্র। সময় অনেককে বেশি দেওয়া হয়েছিল, আন্দাজে ঢিল মারার সুযোগও ছিল। এতে কী হলো? পরের বছর সংশোধনী এলো। চার সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করা হলো, সময় কমিয়ে আনা হলো। সময় করা হলো এক ঘণ্টা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ভুল উত্তর হলে মার্কস কাটা যাবে। অর্থাৎ নেগেটিভ মার্কিং। এরপর কর্তৃপক্ষের মাথায় চিন্তা এলো, এতে করে এসএসসি ও এইচএসসি- সরকার কর্তৃক এ দুটি পরীক্ষাকে অবজ্ঞা বা অসম্মান করা হচ্ছে। তারা মনে করল, এটা তারা অন্যায় করছে। আবার তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। সিদ্ধান্ত নিল, এ দুই পরীক্ষার নম্বরের কিছু অংশ ভর্তি পরীক্ষার নম্বরের সঙ্গে যুক্ত করে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এর পরও সমস্যার সমাধান হলো না। মনে করা হলো, ছেলেমেয়েদের মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা কেমন। আইকিউ কেমন। এর সমাধান করতে গিয়ে মৌখিক পরীক্ষা যুক্ত করা হলো। সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরো সমস্যায় পড়ে গেল কর্তৃপক্ষ। এটা যেন ব্যাধি সারাতে গিয়ে আরো ব্যাধির সৃষ্টি করা। এ ব্যাধি হলো স্বজনপ্রীতি। দেখা গেল, চারদিক থেকে (অবশ্য যাদের ক্ষমতা আছে) ফোন ও সুপারিশ আসতে শুরু করল। এগুলো হতে লাগল কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে, কখনো বা অর্থের বিনিময়ে। যুক্ত হলো নতুন প্রজাতির আরো এক সমস্যা। এটার হাত থেকে রক্ষা পেতে পুরনো নিয়মে ফিরে এলো। সেটা সেই এমসিকিউ। সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরের অংশ যুক্ত হলো। ভর্তীচ্ছু ছেলেমেয়েরা ধরে নিয়েছিল, এসএসসি বা এইচএসসি যদি কোনো কারণে হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়ও, ভর্তি পরীক্ষায় আরেকটা সুযোগ থাকছে। এ সুযোগটা হলো প্রথমবার যদি সুযোগ না পাওয়া যায়, তবে পরেরবার আবার চেষ্টা করা যাবে। এ পদ্ধতি যখন চলছিল, তখন আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি হলো, তা হলো- প্রশ্নপত্র ফাঁস। সেটা হতো দুর্নীতি ও অর্থের বিনিময়ে। এ প্রশ্নপত্র লাখ টাকার ওপরে উঠতে লাগল। এ কাজটি করত কখনো বিজি প্রেসের কর্মচারী, কখনো ছাত্র সংগঠনের কিছু ছাত্র বা সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। এর সঙ্গে কোচিং সেন্টারের কেউ কেউ জড়িত। কিন্তু যদি কোচিং সেন্টার ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে শুধু মেডিক্যালে ভর্তির জন্য কোচিং হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যও কোচিং চালু আছে। সেগুলো বন্ধের উদ্যোগ সরকার কিভাবে নেবে? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মডেলটা কী ধরনের। সে ধরনের মডেল মেডিক্যালে চালু করা সম্ভব কি না? প্রশ্ন হলো, যেসব ছাত্রছাত্রী মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে অন্য কোনো বিষয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়নি, তাদের মধ্যে যারা মেডিক্যালে ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে না, তারা কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারে, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কী ভেবেছে? সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পরিমিত বিতর্কের মাধ্যমে একটা উপযুক্ত ভর্তি পরীক্ষার মডেল দিতে পারত। কিন্তু সরকার সে পথে না যাওয়ার কারণে যত তুঘলকি কাণ্ড ঘটছে। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এতে করে সরকার, শিক্ষার্থী, অভিভাবক- কারোরই লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। পরীক্ষার কোচিং চালু অথবা প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ অন্য কোনো কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারে। মনে হচ্ছে, সরকারি নজরদারির অবহেলায় কোচিং ও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ অসম্ভব। এ ব্যর্থতার কারণেই পদ্ধতির বদল। নতুন সিদ্ধান্ত। নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকে অনেক রকম মতামত ব্যক্ত করেছেন। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক হলেও হঠাৎ করে তা প্রয়োগ করতে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা তা সহজে মেনে নিতে পারছে না। এটা আগেই জানানো প্রয়োজন ছিল- অন্ততপক্ষে এক বছর আগে। সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি স্বচ্ছভাবে অনুসরণের মধ্য দিয়ে জিপিএর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো সম্ভব। আমার মনে হয়, প্রতিটি পদ্ধতিরই কিছু ত্রুটি আছে। কোনো পদ্ধতিই 'পারফেক্ট' নয়। প্রতিটি পদ্ধতির কিছু সুবিধা আছে আবার কিছু অসুবিধাও আছে। কিন্তু যাঁরা এ পরীক্ষা বা জিপিএ ভিত্তিতে ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের স্বচ্ছতা, সততা ও নিরপেক্ষতাই হলো চাবিকাঠি। আমার ধারণা, এ বছর ছাত্রদের নতুন পদ্ধতি (যে নিয়ম সরকার চালু করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে) না করে আগামী বছর থেকে তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিলে অহেতুক তুঘলকি কাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু ব্যাপারটি কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে, সে রায় না আসা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না। কিন্তু সরকার হয়তো তার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা হলো- নতুন পদ্ধতি (যার কথা এখন ভাবা হচ্ছে) অথবা আরো উন্নত পদ্ধতি (যা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে করা হবে) এ বছরের জন্য নয়, আগামী বছর থেকে কার্যকর হবে।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
No comments