বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল কাদের
বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ঢাকার মিরপুর এলাকা তখনো মুক্ত হয়নি।
বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ঢাকার মিরপুর এলাকা তখনো মুক্ত হয়নি।
স্বাধীনতার পর প্রায় দেড় মাস ওই এলাকা সশস্ত্র বিহারিদের দখলে ছিল। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনাও পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়। ১৬ ডিসেম্বর থেকে মিত্রবাহিনী ওই এলাকা ঘেরাও করে রেখেছিল।
বাংলাদেশ সরকার বারবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও বিহারিরা আত্মসমর্পণ করেনি। এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে অভিযান পরিচালনার। ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা (তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) সেখানে অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে গিয়ে আবদুল কাদেরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা বিহারিদের পাল্টা আক্রমণে শহীদ হন।
স্বল্প পরিসরে এ ঘটনার বর্ণনা আছে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রমের (১৯৭১ সালে মেজর, পরে বাষ্ট্রদূত ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘...২৯ তারিখে ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক কোম্পানি সেনা মিরপুরে যায়। তারা ১ নম্বর সেকশনের মাজারের পার্শ্ববর্তী স্কুলঘরে এবং ২ নম্বর সেকশনের বায়তুল আমান হাউস নামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেয়।
‘সন্ধ্যায় হাবিলদার ওয়াজেদ আলী বারকির (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে এক প্লাটুন সেনা সাড়ে ১১ নম্বর সেকশনে পুলিশ পোস্টের কাছে মোতায়েন করা হয়। রাতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই স্থান ছেড়ে যান। রাত শেষে ৩০ জানুয়ারি সকালে পুলিশ এসে সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তারা ১২ নম্বর সেকশনে যায় এবং বিভিন্ন পয়েন্টে সেনা মোতায়েন করে। উদ্দেশ্য ছিল, পুলিশ বাড়িঘরে তল্লাশি করে চিহ্নিত লোকজনকে গ্রেপ্তার করবে এবং সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করবে।
‘আনুমানিক (বেলা) ১১টার দিকে চতুর্দিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে মোরশেদের নেতৃত্বাধীন সেনা ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
‘চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যে পড়ে পুলিশ ও সেনারা হতাহত হয়। তাঁরা পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগই পাননি। অনেকে ঘটনাস্থলে নিহত হন। কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোরশেদও আহত হন।’
মিরপুর অভিযানে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয়, চতুর্থ ও নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়। নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ক্ষুদ্র দলে ছিলেন আবদুল কাদের। পরে শহীদ আবদুল কাদেরের মরদেহ উদ্ধার করে সমাহিত করা হয় ঢাকা সেনানিবাস কবরস্থানে। সেখানে তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
আবদুল কাদের শিক্ষার্থী ছিলেন। এসএসসি পাস করে ১৯৭১ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধের পর ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। ২ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রপুর-লাতুমুড়ার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
২২ নভেম্বর চন্দ্রপুর-লাতুয়ামুড়ায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর-লাতুয়ামুড়া। আবদুল কাদেরসহ মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে রাতে আক্রমণ করেন। সারা রাত যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল কাদেরকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৭।
আবদুল কাদেরের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লতিফ সিকদার গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম কাজী মমতাজ উদ্দিন, মা লুৎফুন নেছা।
সূত্র: প্রথম আলোর চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি এম এ কুদ্দুস, কাজী মনির উদ্দিন (শহীদ আবদুল কাদের বীর প্রতীকের ভাই) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
বাংলাদেশ সরকার বারবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও বিহারিরা আত্মসমর্পণ করেনি। এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে অভিযান পরিচালনার। ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা (তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) সেখানে অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে গিয়ে আবদুল কাদেরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা বিহারিদের পাল্টা আক্রমণে শহীদ হন।
স্বল্প পরিসরে এ ঘটনার বর্ণনা আছে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রমের (১৯৭১ সালে মেজর, পরে বাষ্ট্রদূত ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘...২৯ তারিখে ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক কোম্পানি সেনা মিরপুরে যায়। তারা ১ নম্বর সেকশনের মাজারের পার্শ্ববর্তী স্কুলঘরে এবং ২ নম্বর সেকশনের বায়তুল আমান হাউস নামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেয়।
‘সন্ধ্যায় হাবিলদার ওয়াজেদ আলী বারকির (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে এক প্লাটুন সেনা সাড়ে ১১ নম্বর সেকশনে পুলিশ পোস্টের কাছে মোতায়েন করা হয়। রাতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই স্থান ছেড়ে যান। রাত শেষে ৩০ জানুয়ারি সকালে পুলিশ এসে সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তারা ১২ নম্বর সেকশনে যায় এবং বিভিন্ন পয়েন্টে সেনা মোতায়েন করে। উদ্দেশ্য ছিল, পুলিশ বাড়িঘরে তল্লাশি করে চিহ্নিত লোকজনকে গ্রেপ্তার করবে এবং সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করবে।
‘আনুমানিক (বেলা) ১১টার দিকে চতুর্দিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে মোরশেদের নেতৃত্বাধীন সেনা ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
‘চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যে পড়ে পুলিশ ও সেনারা হতাহত হয়। তাঁরা পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগই পাননি। অনেকে ঘটনাস্থলে নিহত হন। কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোরশেদও আহত হন।’
মিরপুর অভিযানে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয়, চতুর্থ ও নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়। নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ক্ষুদ্র দলে ছিলেন আবদুল কাদের। পরে শহীদ আবদুল কাদেরের মরদেহ উদ্ধার করে সমাহিত করা হয় ঢাকা সেনানিবাস কবরস্থানে। সেখানে তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
আবদুল কাদের শিক্ষার্থী ছিলেন। এসএসসি পাস করে ১৯৭১ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধের পর ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। ২ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রপুর-লাতুমুড়ার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
২২ নভেম্বর চন্দ্রপুর-লাতুয়ামুড়ায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর-লাতুয়ামুড়া। আবদুল কাদেরসহ মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে রাতে আক্রমণ করেন। সারা রাত যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল কাদেরকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৭।
আবদুল কাদেরের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লতিফ সিকদার গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম কাজী মমতাজ উদ্দিন, মা লুৎফুন নেছা।
সূত্র: প্রথম আলোর চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি এম এ কুদ্দুস, কাজী মনির উদ্দিন (শহীদ আবদুল কাদের বীর প্রতীকের ভাই) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments