ঈদ-উল-ফিতরের মর্মবাণী by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
প্রতিবছর মাহে রমাদানের মাসব্যাপী সিয়াম পালনের পর ১ শাওয়াল পালিত হয় ঈদ-উল-ফিতর অর্থাৎ সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব। সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা অর্থাৎ যাবতীয় কামাচার, পানাহার, মিথ্যাচার ও পাপাচার থেকে দৃঢ় সঙ্কল্পের সাথে বিরত থাকাটাই হচ্ছে সিয়াম।
সুবিহ্্ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একমাস ধরে সিয়াম পালন করা রীতিমতো নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ করা আর এরই মধ্য দিয়ে সায়িম তাকওয়ার প্রশিক্ষণ লাভ করে।
ঈদ শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘আউদ যার অর্থ হচ্ছে ফিরে ফিরে আসা, পুনরাবৃত্ত, পুনরানুষ্ঠিত রীতি প্রত্যাবর্তন করা। ঈদ মানে আনন্দ যা প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষ গণনার হিসেবে ফিরে আসে। ঈদ-উল-ফিতর মানে যেমন সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব হয় তেমনি এর মানে দানের উৎসব হয়। কারণ এই ঈদে দরিদ্রজনদের মধ্যে সাদাকাতুল ফিত্্রা বা ফিতরা বিলাতে হয় যাতে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মানুষ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না এই অসম নীতিকে উৎখাত করে একটা আদল ও ইনসাফ ভিত্তিক সমতার সমাজ বিন্যাসিত হয়। ধনী-নির্ধনের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ব্যবধান ও বৈষম্য দূর করে এমন এক সমাজ গড়ে তোলার তাগিদ দেয় ঈদ-উল-ফিতর ।
প্রিয় নবী সরকারে দো আলম নূরে মুজাস্্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হিস্্ সালাম প্রথম ওহীপ্রাপ্ত হন ৬১০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি আল্লাহ্্র নির্দেশে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু তাঁকে প্রদত্ত নির্দেশে ইরশাদ করেন : আপনি আপনার রব-এর পথে আহ্বান করুন হিকমতের মাধ্যমে এবং সুন্দর সুন্দর উপদেশ দ্বারা আর ওদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবে সৎভাবে। (সূরা নহল : আয়াত ১২৫)।
মক্কা মুকাররমে তিনি ১২ বছর ধরে মানুষকে আলোর পথে দাখিল হবার জন্য আহ্বান করেন। মক্কার কাফির-মুশরিকরা নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্র াবাড়াতে বাড়াতে চরম পর্যায় উঠল। তারা বনূ হাশিমের লোকজনকে তিন বছর বয়কট অবস্থায় রাখল। তবুও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্্র দেয়া দায়িত্ব পালন করে চললেন। তারা তাঁকে নানা প্রলোভন দেখাতে লাগলা তিনি বললেন, আমার এক হাতে চাঁদ আরেক হাতে যদি সূর্য এনে দেয়া হয় তবু আল্লাহ্্ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করা থেকে একটুও পিছ্্পা হব না। তিনি ইসলাম প্রচার করতে তায়েফ গেছেন। সেখানকার মানুষ তাঁকে পাথর মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে তবুও তিনি তাদের জন্য বদ দু’আ করেননি বরং মুনাজাত করেছেন এই বলে : আল্লাহ্্ গো! আমার দুর্বলতা, আমার নিরুপায়তা এবং মানব দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হেয়তার জন্য আপনার মহান দরবারে এই ফরিয়াদ করছি : হে রহমানুর রহীম! সমস্ত দুর্বলের রব্্ আপনি। আপনিই আমার রব্। আপনি যদি আমার ওপর রাগ না করে থাকেন তাহলে আমি কারও পরওয়া করি না। আপনার শান্তি, আপনার আফিয়াত আমার আসমান-যমীন রওশন হয়েছে- যে নূরের ছটায় অন্ধকার দূর হয়ে যায়। এবং যে নূরের ছটায় দুনিয়া ও আখিরাতের কর্ম সম্পাদন হয় সেই নূর মোবারকের ওসিলায় আপনি আপনার গজব নাজিল করবেন না। একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি সাধন করাই আমার কর্তব্য, যতক্ষণ না আপনি সন্তুষ্ট হন।
তিনি আল্লাহ্্র নির্দেশে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করেছেন। মদীনায় এসে সুন্দর শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করেছেন, যাকাত, কিবলা পরিবর্তন, উত্তরাধিকার আইন প্রভৃতি বিধান নাজিল হয়েছে, প্রায় দেড় বছরের মাথায় রমাদানকে সিয়ামের জন্য নির্ধারণ করে দিয়ে বিধান নাজিল হয়েছে। কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের হুকুম নাজিল হয়েছে। সেই রমাদানে প্রথম সিয়াম পালিত হয়েছে রমাদান মাসব্যাপী আর সেই রমাদানের ১৭ তারিখে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ মুকাবিলা করে সুদূরপ্রসারী বিজয় এনেছেন এবং সেই রমাদান শেষে ১ শাওয়ালের চাঁদ উদিত হয়েছে সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসবের বা ঈদ-উল-ফিতরের বারতা নিয়ে। ১ শাওয়াল সর্বপ্রথম পালিত হলো ঈদ। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ উৎসব আছে, আমাদের আনন্দ উৎসব ঈদ।
সর্বপ্রথম ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল মুতাবিক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ শুক্রবার মদীনা মনওয়ারার মসজিদুন্নবী থেকে ৩০৫ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটা ময়দানে। ইমামতি করেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম। এই ঈদের ১৩ দিন আগে বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভের আনন্দ স্বাভাবিকভাবেই অনুরণিত ছিল। সেই ঈদের মাঠে পরবর্তীতে বহু গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ নির্মিত হয়েছে। গম্বুজগুলো ছাতার মতো দেখতে। এই মসজিদের নাম মসজিদে গামামা। যতদূর জানা যায়, মক্কা মুকাররমায় প্রথম ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয় ৮ম হিজরী মুতাবিক ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের প্রায় ১১ দিন পর।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রাদিআল্লাহুতা‘আলা আন্্হুর খিলাফত কালের (৬৩৪-৬৪৪ খৃঃ) মধ্যভাগ নাগাদ অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, অবশ্য ৭ম শতাব্দীর বিশেষ দশক থেকে বিশেষ করে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হুদায়রিয়ার সন্ধির পর থেকে বাংলাদেশে ইসলাম এসে যায় ক্ষুদ্র পরিসরে। বাংলাদেশে কোথায় ঈদের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে এটা বলা যায় হয়ত সেই প্রথম জামা‘আত অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের তদানীন্তন সমুদ্র বন্দর এলাকায়।
ঈদ-উল-ফিতর বা সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ সৌকর্যম-িত যা মানবতার বিজয় বারতা ঘোষণার পাশাপাশি আল্লাহ্্র কুরবত বা নৈকট্য ও রিযামন্দী বা সন্তুষ্টি অর্জনের পথ নির্দেশ করে। আল্লাহ্্র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করাটাই সব মানুষের একান্ত কাম্য হওয়াটাই উচিত।
আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কেবল তাঁরই ইবাদতের জন্য। মানুষ পৃথিবীতে আসার বহু পূর্বে সব মানুষের রূহ সমবেত করে তাদের কাছ থেকে সেই আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে আল্লাহ্্ জাল্লাশানুহু শপথ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সমস্ত রূহ্্ বা আত্মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন : আমি কি তোমাদের রব্্ নই? সব আত্মাই একবাক্যে বলেছিল : হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব্। এই অঙ্গীকারাবদ্ধ মানব রূহ্্ বিশেষ আকৃতির দৈহিক কাঠামোতে অবস্থান নিয়ে আল্লাহর বিধান মুতাবিক পৃথিবীতে আসে মাতৃগর্ভরূপী জাহাজে করে আল্লাহ্্র খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর এই পৃথিবীতে আগমন ঘটে। আল্লাহ্্র কাছে সে যে অঙ্গীকার করেছিল পৃথিবীতে এসে তা রক্ষা করার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা। ঈদ-উল-ফিতর সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সকল বিশ্ববাসী মিলে একটি দেহ, মাথায় ব্যথা হলে যেমন সারা শরীর তা অনুভব করে, চোখে জ্বালা হলে যেমন সারা শরীর অনুভব করে, তেমন একটা দেহ। এই বিখ্যাত হাদীসখানির একটা সুন্দর প্রতিফলন ঈদ-উল-ফিতরে দেখা যায়। এই ঈদের দিনে সকালে ঈদগাহ্্ বা মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করতে যাবার পূর্বেই গরিব-মিসকিনরা যাতে ঈদের আনন্দে শরি হতে পারে সেজন্য ফিতরা দিতে হয়। এই ফিতরা দেয়াটা ওয়াজিব। ঈদের দু’রাক‘আত সালাত যেমন ওয়াজিব তেমনি গরিব-মিসকিনদের মধ্যে ফিতরা দেয়াটাও ধনিক শ্রেণীর জন্য ওয়াজিব।
এখানে লক্ষণীয় যে, ঈদ-উল-ফিতরে হক্কুল্লাহ্্ বা আল্লাহর হক আদায় করার পাশাপাশি হক্কুল ‘ইবাদ বা বান্দার হক আদায়ের বিধানও বলবত করা হয়েছে। ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব মানুষ মিলে একই আনন্দ অনুভবে এক মহা ঐক্যের মিলন মোহনায় একত্রিত হবার এক অনন্য ব্যবস্থা এই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর ।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক তাকওয়া অবলম্বনকারী। আল্লাহ সব জানেন, সব খবর রাখেন। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)।
তাকওয়া হচ্ছে ভাল-মন্দ বেছে বেছে চলা, ভালকে গ্রহণ করা এবং মন্দকে বর্জন করা এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ও রসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। যুগশ্রেষ্ঠ সূফী কুতবুল আলম হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি বলেছেন : তাকওয়া ব্যতিরেকে আল্লাহর ওলী হওয়া যায় না। মাহে রমাদানে রোযাদার তাকওয়া অবলম্বনের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং সিয়াম পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বনে অভ্যস্ত হয়। ঈদ-উল-ফিতর মাহে রমাদানে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ বছরের বাকি এগারোটা মাসে কাজে লাগানোর শপথে বলীয়ান হবার দিন।
লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
No comments