ওসামা যুগের অবসানের পর by এম আবদুল হাফিজ
অবশেষে বিশ্বত্রাস ওসামা বিন লাদেন মধ্যবয়সে শ্রমসাধ্য দীর্ঘকাল ধরে সংগৃহীত মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদেরই বিশেষ কমান্ডো ফোর্স নেভি সিলসের দুঃসাহসিক অপারেশনে ৪০ মিনিটের এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেন। একটি ধনাঢ্য সৌদি পরিবারে উচ্চশিক্ষিত এই লাদেন নিজের বিচার, বুদ্ধি এবং উপলব্ধিসঞ্জাত পথে একটি কঠিন পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
তিনি কি সন্ত্রাসী? তিনি শুধু আল কায়দা বা একটি (উপলব্ধির) ভিত্তির স্রষ্টা। যা হোক, তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে এবং ভবিষ্যতেও তা চলতে থাকবে।
চূড়ান্ত তথ্য যখন বারাক ওবামার হাতে, তারও এই লোভনীয় অপারেশন নিয়ে যথেষ্টই স্নায়ু বৈকল্য ছিল। নেভি সিলসকে কী নির্দেশ দেবেন তিনি, সেও এক সমস্যা; কেননা একটি সার্বভৌম দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সে দেশের ভেতরে একটি সামরিক অভিযান চালানোর ঝুঁকি একশ' ভাগ। কিন্তু সবাই যখন অপারেশনে প্রস্তুত এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ'খানেক লোককে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে_ সে আরেক ঝুঁকি ও সমস্যা। যে কোনো সময়ে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
প্রথম ঝুঁকিটিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব না দিলেও, দ্বিতীয়টি অবশ্যই তার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকবে। পাকিস্তানের মতো মিত্র দেশকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে একটি পরনির্ভরশীল দেশের মান-মর্যাদার বিষয়টির নিষ্পত্তি করা যাবে। কিন্তু কোনোক্রমেই এ মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্য ও মার্কিন পরিকল্পনাকে নস্যাৎ হতে দেওয়া যাবে না। যদিও ১৯৮০ সালে কার্টারের তেহরানে জিম্মি উদ্ধারে তার হেলিকপ্টার প্রেরণ সুফল বয়ে আনেনি। সুতরাং অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার পরও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং সতর্কতাবাদীরা ওবামাকে আরেকটু ভাবতে অনুরোধ করেন।
পরদিন ওবামার আলবামার টের্নেডোপীড়িত অঞ্চলে যাওয়ার কথা। কূটনৈতিক অভ্যর্থনা কক্ষেও তার মস্তিষ্কে একই ভাবনা। এরই মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছেন : নেভি সিলস তার মিশনে যাবে, গিয়েছিলও। মাঝখানের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ এখন মার্কিন মিডিয়ার প্রধান উপজীব্য। নশ্বর জীবনের স্থূল আনন্দবন্যায় মার্কিনিরা এখন ভাসছে।
মার্কিনিদের লাদেন-বধের স্বপ্ন পূরণ হলেও কি যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে? যে নব্য সাম্রাজ্যবাদের পথে এই পরাশক্তি চলছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপারই নোংরা, হিংসাত্মক, সহিংস একটি ক্যাসিনোর মতো। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মার্কিনিরা অন্যায়, অনৈতিক ও বেআইনি পথে চলতেই থাকবে এবং তার একটি সহিংস প্রতিক্রিয়া দানা বেঁধে উঠতে থাকবে। ফিলিস্তিন বনাম ইসরায়েল প্রশ্নে আগের প্রতারণাই হয়তো অব্যাহত থাকবে। মুসলিম আরব বিশ্বে সম্পদের আকর্ষণে আগের মতোই তাদের অনুগতদের পুষতে থাকবে। ইরাক ছাড়লেও যে কোনো সময় সেখানে প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত রাখবে। এসবের বিরুদ্ধে কেউ না কেউ, কোনো এক গোষ্ঠী বা অন্য কোনো গোষ্ঠী সহিংস প্রতিক্রিয়ায় সহিংস হবে। তাই যে জীবনকে মার্কিনিরা ভালোবাসে আর যা-ই হোক সেই নিরাপদ জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষা বিঘি্নত হতেই থাকবে।
কিছু মহল থেকে ওসামা বিন লাদেনের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সময় থেমে নেই। সেই উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়াটিও বেশ সক্রিয়ই আছে। তবে আল কায়দার নতুন সংস্করণ হয়তো ওসামা-অনুসৃত পথ থেকে আলাদা হবে। ওসামা কিন্তু আল কায়দাকে সবসময় বিকেন্দ্রিক রেখেছিলেন। ওসামা পলাতক জীবনে তার সহকারী আয়মান আল জওয়াহিরিকেসহ আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন মূলত আশ্রয়ের খোঁজে। মার্কিনিরাই সেখানে তাদের সোভিয়েত বিতাড়নের জন্য জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে। যখন তারা তাদের ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করেছে বলে বুঝতে পারে, তখনই ওসামা তাদের এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন।
আল কায়দার উত্তরাধিকার প্রশ্নে, বিশেষ করে তার ভবিষ্যৎ শীর্ষ নেতা সম্পর্কে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আরব বিশ্বে কিন্তু ইতিমধ্যে গণজাগরণের জোয়ার বয়ে গেছে এবং সেখানেও কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়নি। তবে যে তরুণ সমাজ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল তারা অকাট্যভাবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ। একটি নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে, যারা মতাদর্শগতভাবে সৎ এবং মুসলিম বিশ্বের নিজেরও ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিতে তারা পারঙ্গম। তবে আল কায়দার সবচেয়ে অধিক সমর্থক এখন ইয়েমেন ও পাকিস্তানে। তার বাইরে আল কায়দাকে হয়তো নব-আরব গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুকাল প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
চূড়ান্ত তথ্য যখন বারাক ওবামার হাতে, তারও এই লোভনীয় অপারেশন নিয়ে যথেষ্টই স্নায়ু বৈকল্য ছিল। নেভি সিলসকে কী নির্দেশ দেবেন তিনি, সেও এক সমস্যা; কেননা একটি সার্বভৌম দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সে দেশের ভেতরে একটি সামরিক অভিযান চালানোর ঝুঁকি একশ' ভাগ। কিন্তু সবাই যখন অপারেশনে প্রস্তুত এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ'খানেক লোককে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে_ সে আরেক ঝুঁকি ও সমস্যা। যে কোনো সময়ে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
প্রথম ঝুঁকিটিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব না দিলেও, দ্বিতীয়টি অবশ্যই তার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকবে। পাকিস্তানের মতো মিত্র দেশকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে একটি পরনির্ভরশীল দেশের মান-মর্যাদার বিষয়টির নিষ্পত্তি করা যাবে। কিন্তু কোনোক্রমেই এ মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্য ও মার্কিন পরিকল্পনাকে নস্যাৎ হতে দেওয়া যাবে না। যদিও ১৯৮০ সালে কার্টারের তেহরানে জিম্মি উদ্ধারে তার হেলিকপ্টার প্রেরণ সুফল বয়ে আনেনি। সুতরাং অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার পরও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং সতর্কতাবাদীরা ওবামাকে আরেকটু ভাবতে অনুরোধ করেন।
পরদিন ওবামার আলবামার টের্নেডোপীড়িত অঞ্চলে যাওয়ার কথা। কূটনৈতিক অভ্যর্থনা কক্ষেও তার মস্তিষ্কে একই ভাবনা। এরই মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছেন : নেভি সিলস তার মিশনে যাবে, গিয়েছিলও। মাঝখানের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ এখন মার্কিন মিডিয়ার প্রধান উপজীব্য। নশ্বর জীবনের স্থূল আনন্দবন্যায় মার্কিনিরা এখন ভাসছে।
মার্কিনিদের লাদেন-বধের স্বপ্ন পূরণ হলেও কি যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে? যে নব্য সাম্রাজ্যবাদের পথে এই পরাশক্তি চলছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপারই নোংরা, হিংসাত্মক, সহিংস একটি ক্যাসিনোর মতো। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মার্কিনিরা অন্যায়, অনৈতিক ও বেআইনি পথে চলতেই থাকবে এবং তার একটি সহিংস প্রতিক্রিয়া দানা বেঁধে উঠতে থাকবে। ফিলিস্তিন বনাম ইসরায়েল প্রশ্নে আগের প্রতারণাই হয়তো অব্যাহত থাকবে। মুসলিম আরব বিশ্বে সম্পদের আকর্ষণে আগের মতোই তাদের অনুগতদের পুষতে থাকবে। ইরাক ছাড়লেও যে কোনো সময় সেখানে প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত রাখবে। এসবের বিরুদ্ধে কেউ না কেউ, কোনো এক গোষ্ঠী বা অন্য কোনো গোষ্ঠী সহিংস প্রতিক্রিয়ায় সহিংস হবে। তাই যে জীবনকে মার্কিনিরা ভালোবাসে আর যা-ই হোক সেই নিরাপদ জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষা বিঘি্নত হতেই থাকবে।
কিছু মহল থেকে ওসামা বিন লাদেনের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সময় থেমে নেই। সেই উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়াটিও বেশ সক্রিয়ই আছে। তবে আল কায়দার নতুন সংস্করণ হয়তো ওসামা-অনুসৃত পথ থেকে আলাদা হবে। ওসামা কিন্তু আল কায়দাকে সবসময় বিকেন্দ্রিক রেখেছিলেন। ওসামা পলাতক জীবনে তার সহকারী আয়মান আল জওয়াহিরিকেসহ আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন মূলত আশ্রয়ের খোঁজে। মার্কিনিরাই সেখানে তাদের সোভিয়েত বিতাড়নের জন্য জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে। যখন তারা তাদের ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করেছে বলে বুঝতে পারে, তখনই ওসামা তাদের এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন।
আল কায়দার উত্তরাধিকার প্রশ্নে, বিশেষ করে তার ভবিষ্যৎ শীর্ষ নেতা সম্পর্কে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আরব বিশ্বে কিন্তু ইতিমধ্যে গণজাগরণের জোয়ার বয়ে গেছে এবং সেখানেও কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়নি। তবে যে তরুণ সমাজ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল তারা অকাট্যভাবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ। একটি নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে, যারা মতাদর্শগতভাবে সৎ এবং মুসলিম বিশ্বের নিজেরও ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিতে তারা পারঙ্গম। তবে আল কায়দার সবচেয়ে অধিক সমর্থক এখন ইয়েমেন ও পাকিস্তানে। তার বাইরে আল কায়দাকে হয়তো নব-আরব গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুকাল প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments