দেশে ৫০ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি by শেখ সাবিহা আলম
সরকারের দাবি, গত চার বছরে দেশের পুষ্টি-পরিস্থিতির কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পুষ্টিবৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অপুষ্টির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোতে ক্ষুধা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
দেশের সামগ্রিক পুষ্টি-পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ ২০১১ সালে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রকাশ পায়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) পরিচালিত এ জরিপে বলা হয়, গত চার বছরে বাংলাদেশের পুষ্টি-পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ৪১ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির, ২০০৭ সালে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। তবে বিডিএইচএস ২০১১-এর প্রতিবেদনেই দেখা যাচ্ছে, সিলেটে খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা এখন ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত। আর যেসব পরিবারের মায়েরা অশিক্ষিত, সেসব পরিবারে খর্বাকৃতির শিশুর হার ৫১ শতাংশ পর্যন্ত।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মো. মহসীন আলী বলেন, বাংলাদেশে যত শিশু মারা যায়, তাদের প্রায় ৫০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা শারীরিকভাবে বেশি ভোগে, তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ণ বয়সে কর্মক্ষমতা কম হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে না।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউএসএআইডি পরিচালিত সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ প্রোফাইল এবং পুষ্টিমান নির্ণয়ক কারিগরি প্রতিবেদনে’ বলা হয়, অপুষ্টিজনিত কারণে বছরে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। ২৩ জুন সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ বলছে, গ্রামের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু মাছ-মাংস, দুধ ও দুধের তৈরি খাবার গ্রহণের দিক থেকে এগিয়ে আছে শহরের বিত্তবান লোকেরা।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাকের ‘ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স’ ২০১০-১১-তে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে ক্ষুধা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দুই-ই বেড়েছে।
১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে জাতীয় পুষ্টি জরিপ পরিচালিত হয়েছিল। সে সময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পুষ্টিবিষয়ক পরিচালক ছিলেন একজন বাঙালি। প্রথমবারের মতো কাগজে-কলমে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এ অঞ্চলের পুষ্টি-পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এখন স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও পুষ্টিবিদেরা বলছেন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আফ্রিকার কিছু দেশের চেয়ে এ দেশের শিশুরা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। ১৯৯৫ সালে সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প (বিআইএনপি), পরে দুই দফায় জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প (এনএনপি) ও জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি (এনএনপি) পরিচালনা করে সরকার। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় পরিচালিত এসব কর্মসূচির দৃশ্যমান কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সব সময় কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল পিছিয়ে থাকছে কেন, তা খতিয়ে দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে পুষ্টিবিদেরা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা বছর স্বল্প মূল্যে চাল সরবরাহের সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১১ অনুযায়ী, অপুষ্টির অঞ্চল ও অবস্থানভেদে তারতম্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের শিশু এবং অশিক্ষিত মা আছেন এমন পরিবার ও দরিদ্র পরিবারে শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা, উচ্চতার তুলনায় ওজন এবং বয়সের তুলনায় ওজন কম।
বিডিএইচএস ২০১১-এর প্রতিবেদনে শিশুর পুষ্টি-পরিস্থিতি বোঝাতে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিষয়গুলো হলো, বয়সের তুলনায় উচ্চতা, উচ্চতার তুলনায় ওজন এবং বয়সের তুলনায় ওজন। বিডিএইচএস ২০১১ অনুযায়ী, শহরাঞ্চলের শিশুদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিশুরা খর্বাকৃতির সমস্যায় বেশি ভুগছে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে খুলনায় খর্বাকৃতির শিশুর হার কম, ৩৫ শতাংশ। ২০০৭ সালের বিডিএইচএস প্রতিবেদনের তথ্যও ছিল একই রকম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খুরশীদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, পুষ্টিজ্ঞান থাকা জরুরি। তবে মূল বিষয় হলো, পুষ্টিকর খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা আছে কি না, মানুষের পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আছে কি না। এ ছাড়া শিশুরা টিকা পাচ্ছে কি না, পরিবেশ যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কি না, রান্না করার পদ্ধতি কী ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও পুষ্টি-পরিস্থিতি নির্ভর করে।
খুরশীদ জাহান আরও বলেন, ‘জাতীয় পুষ্টি জরিপে আমরা দেখেছি, ছেলেশিশুরা প্রোটিনজাতীয় খাবার পায় ১৯ থেকে ২৩ গ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েশিশুরা পায় সাড়ে ১৭ থেকে ১৮ গ্রাম পর্যন্ত।’
বিডিএইচএস ২০০৭-এ বলা হয়েছিল, গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাকের ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স ২০১০-১১-তে জরিপের আওতায় নেওয়া হয়েছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন অঞ্চলগুলো। মোট চারটি ধাপে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও, খরাপ্রবণ এলাকা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও জয়পুরহাট, উত্তরাঞ্চলীয় চর বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর, হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং উপকূলীয় অঞ্চল চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ১০ হাজার ৯৮০টি পরিবারের ওপর গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত জরিপে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে রুগ্ণ শিশুর সংখ্যা ছিল ১২ দশমিক ৫, জুন থেকে আগস্টে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশে।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২৭ জুনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যতালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের এই দিনের তুলনায় এ বছরের ২৭ জুন ভোজ্যতেলের দাম ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রুই মাছের দাম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ, ইলিশ মাছ ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ব্রয়লারের মুরগি ২৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ও দেশি মুরগির দাম ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
শহর ও গ্রামে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতার, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যে বৈষম্য, তার উল্লেখ আছে বাংলাদেশ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০১০-এ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণের হার বেড়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে ভাত খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে জনপ্রতি ভাত খাওয়ার পরিমাণ ৪৪১ দশমিক ৬ গ্রাম, শহরাঞ্চলে ৩৪৪ দশমিক দুই গ্রাম।
বৈষম্য দূর করতে বাণিজ্যিকীকরণের আশঙ্কা: জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং জাতীয় পুষ্টি সেবা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর এখলাছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর শিশুরা চলমান কর্মসূচিতে আলাদা গুরুত্ব পাবে। যেসব অঞ্চলের বা পরিবারের শিশুরা মারাত্মক খর্বাকৃতির, কৃশকায় অথবা বয়সের তুলনায় কম ওজনের, তাদের অণুপুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে কী ধরনের খাবার দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে সরকার কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। দেশের বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ এম কিউ কে তালুকদার ২৩ জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানান, দাতা সংস্থাগুলো বিদেশ থেকে এক ধরনের পথ্য আনতে চায়, যেটাকে বলে রেডি টু মেক থেরাপিউটিক ফুড। ভারতেও এ চেষ্টা হয়েছিল। ভারত তীব্রভাবে এতে বাধা দেয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, দাতা সংস্থাগুলো বিদেশ থেকে খাবার কিনে দেশের অপুষ্টি সমস্যা সমাধানের যে কথা বলছে, তা যুক্তিযুক্ত নয়। তাঁর মতে, দেশীয় পদ্ধতিতে এর সমাধান খোঁজা উচিত।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মো. মহসীন আলী বলেন, বাংলাদেশে যত শিশু মারা যায়, তাদের প্রায় ৫০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা শারীরিকভাবে বেশি ভোগে, তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ণ বয়সে কর্মক্ষমতা কম হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে না।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউএসএআইডি পরিচালিত সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ প্রোফাইল এবং পুষ্টিমান নির্ণয়ক কারিগরি প্রতিবেদনে’ বলা হয়, অপুষ্টিজনিত কারণে বছরে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। ২৩ জুন সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ বলছে, গ্রামের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু মাছ-মাংস, দুধ ও দুধের তৈরি খাবার গ্রহণের দিক থেকে এগিয়ে আছে শহরের বিত্তবান লোকেরা।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাকের ‘ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স’ ২০১০-১১-তে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে ক্ষুধা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দুই-ই বেড়েছে।
১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে জাতীয় পুষ্টি জরিপ পরিচালিত হয়েছিল। সে সময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পুষ্টিবিষয়ক পরিচালক ছিলেন একজন বাঙালি। প্রথমবারের মতো কাগজে-কলমে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এ অঞ্চলের পুষ্টি-পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এখন স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও পুষ্টিবিদেরা বলছেন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আফ্রিকার কিছু দেশের চেয়ে এ দেশের শিশুরা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। ১৯৯৫ সালে সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প (বিআইএনপি), পরে দুই দফায় জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প (এনএনপি) ও জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি (এনএনপি) পরিচালনা করে সরকার। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় পরিচালিত এসব কর্মসূচির দৃশ্যমান কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সব সময় কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল পিছিয়ে থাকছে কেন, তা খতিয়ে দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে পুষ্টিবিদেরা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারা বছর স্বল্প মূল্যে চাল সরবরাহের সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১১ অনুযায়ী, অপুষ্টির অঞ্চল ও অবস্থানভেদে তারতম্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের শিশু এবং অশিক্ষিত মা আছেন এমন পরিবার ও দরিদ্র পরিবারে শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা, উচ্চতার তুলনায় ওজন এবং বয়সের তুলনায় ওজন কম।
বিডিএইচএস ২০১১-এর প্রতিবেদনে শিশুর পুষ্টি-পরিস্থিতি বোঝাতে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিষয়গুলো হলো, বয়সের তুলনায় উচ্চতা, উচ্চতার তুলনায় ওজন এবং বয়সের তুলনায় ওজন। বিডিএইচএস ২০১১ অনুযায়ী, শহরাঞ্চলের শিশুদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিশুরা খর্বাকৃতির সমস্যায় বেশি ভুগছে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে খুলনায় খর্বাকৃতির শিশুর হার কম, ৩৫ শতাংশ। ২০০৭ সালের বিডিএইচএস প্রতিবেদনের তথ্যও ছিল একই রকম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খুরশীদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, পুষ্টিজ্ঞান থাকা জরুরি। তবে মূল বিষয় হলো, পুষ্টিকর খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা আছে কি না, মানুষের পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আছে কি না। এ ছাড়া শিশুরা টিকা পাচ্ছে কি না, পরিবেশ যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কি না, রান্না করার পদ্ধতি কী ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও পুষ্টি-পরিস্থিতি নির্ভর করে।
খুরশীদ জাহান আরও বলেন, ‘জাতীয় পুষ্টি জরিপে আমরা দেখেছি, ছেলেশিশুরা প্রোটিনজাতীয় খাবার পায় ১৯ থেকে ২৩ গ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েশিশুরা পায় সাড়ে ১৭ থেকে ১৮ গ্রাম পর্যন্ত।’
বিডিএইচএস ২০০৭-এ বলা হয়েছিল, গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাকের ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিল্যান্স ২০১০-১১-তে জরিপের আওতায় নেওয়া হয়েছিল খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন অঞ্চলগুলো। মোট চারটি ধাপে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও, খরাপ্রবণ এলাকা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও জয়পুরহাট, উত্তরাঞ্চলীয় চর বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর, হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং উপকূলীয় অঞ্চল চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ১০ হাজার ৯৮০টি পরিবারের ওপর গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত জরিপে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে রুগ্ণ শিশুর সংখ্যা ছিল ১২ দশমিক ৫, জুন থেকে আগস্টে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশে।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২৭ জুনের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যতালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের এই দিনের তুলনায় এ বছরের ২৭ জুন ভোজ্যতেলের দাম ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, রুই মাছের দাম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ, ইলিশ মাছ ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ব্রয়লারের মুরগি ২৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ও দেশি মুরগির দাম ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
শহর ও গ্রামে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতার, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যে বৈষম্য, তার উল্লেখ আছে বাংলাদেশ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০১০-এ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণের হার বেড়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে ভাত খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে জনপ্রতি ভাত খাওয়ার পরিমাণ ৪৪১ দশমিক ৬ গ্রাম, শহরাঞ্চলে ৩৪৪ দশমিক দুই গ্রাম।
বৈষম্য দূর করতে বাণিজ্যিকীকরণের আশঙ্কা: জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং জাতীয় পুষ্টি সেবা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর এখলাছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর শিশুরা চলমান কর্মসূচিতে আলাদা গুরুত্ব পাবে। যেসব অঞ্চলের বা পরিবারের শিশুরা মারাত্মক খর্বাকৃতির, কৃশকায় অথবা বয়সের তুলনায় কম ওজনের, তাদের অণুপুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে কী ধরনের খাবার দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে সরকার কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। দেশের বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ এম কিউ কে তালুকদার ২৩ জুন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানান, দাতা সংস্থাগুলো বিদেশ থেকে এক ধরনের পথ্য আনতে চায়, যেটাকে বলে রেডি টু মেক থেরাপিউটিক ফুড। ভারতেও এ চেষ্টা হয়েছিল। ভারত তীব্রভাবে এতে বাধা দেয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, দাতা সংস্থাগুলো বিদেশ থেকে খাবার কিনে দেশের অপুষ্টি সমস্যা সমাধানের যে কথা বলছে, তা যুক্তিযুক্ত নয়। তাঁর মতে, দেশীয় পদ্ধতিতে এর সমাধান খোঁজা উচিত।
No comments