কালের পুরাণ-সরকার কোথায় আছে, কী করছে? by সোহরাব হাসান
সরকার দ্বিতীয়টি আসেনি। সরকারের মেয়াদ সাড়ে তিন বছর পার হওয়ার পরও তার গৃহীত নীতি ও কাজকে কেউ তেমনভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। সেই অর্থে বিরোধী দল কোনো আন্দোলনই করতে পারেনি। ভেবে দেখুন, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল! বিভিন্ন স্থানে
সংখ্যালঘু ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চলে নির্যাতন, সন্ত্রাস। প্রায় পাঁচটি বছরই তাদের কেটেছিল মহাদুর্যোগে। মেয়াদের আড়াই বছরের মাথায় ট্রাম্পকার্ড, বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মহাজোট সরকারকে পিলখানা ট্র্যাজেডি ছাড়া কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ নমনীয় মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে দেশ চালাবেন। বিরোধী দলকে সংখ্যার বিচারে দেখবেন না। প্রধানমন্ত্রী সেই কথাগুলো মনে রাখলে মহাজোটের মহাবিজয় মহাদুশ্চিন্তার কারণ হতো না। আর সরকারকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হতো না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে মানুষ বিএনপির প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ক্ষমতায় থাকতে দলটি যেভাবে দেশকে জঙ্গি, বোমাবাজ ও গ্রেনেডবাজদের অভয়ারণ্য বানিয়েছিল, তখনো তা জনগণের মন ও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেজেগোবরে অবস্থার কারণে মানুষ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলকেই বিকল্প ভেবেছিল। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, সাড়ে তিন বছরে সরকার একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে, বিএনপির দুঃশাসন ও দুর্নীতির স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়া।
নিজে থেকে খামোখা কিছু সমস্যা তৈরি না করলে বিরোধী দলের আন্দোলনবিহীন একটি মেয়াদ পার করা এই সরকারের পক্ষে কঠিন হতো না। এই খামোখা সমস্যার নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা। সংসদের বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন রাশেদ খান মেননকে চ্যালেঞ্জ করেন, তখন নোট অব ডিসেন্ট দেননি বলে। নোট অব ডিসেন্ট না দিলেই সবকিছু জায়েজ হয়ে যায় না। বিশেষ কমিটির এজেন্ডায় কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিষয়টি ছিল? ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল, আসমান থেকে এই প্রস্তাব নাজিল হলো এবং কমিটি তা গ্রহণ করতেও বাধ্য হলো।
গণতন্ত্রের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উত্তম, এই দাবি কেউ করবে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য যেসব ধাপ পার হতে হয়, বাংলাদেশের বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল তার একটি সাময়িক দাওয়াই। আবার এ কথাও সত্য, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে দেড় দশকের ব্যবধানে এই ব্যবস্থাকে বিতর্কিত ও অকার্যকর করে ফেলেছে। এখন বিএনপির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে যতই মাঠ গরম করার চেষ্টা করুন না কেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। অতএব, একটি বিকল্প পথ বের করে নিতে হবে। সেটি যেমন প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে রীতিতে নির্বাচন হয় সেই রীতির’ হবে না, তেমনি বিরোধী দলের নেত্রীর দাবি অনুযায়ী ‘সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হুবহু পুনর্বহালও’ হবে না। দেশ ও দেশের মানুষের ভালো চাইলে নেতা-নেত্রীদের উচিত আলোচনায় বসা। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে চেষ্টা করা।
প্রথম আলোতেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের প্রশ্নে গণভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন আইনবিদ শাহ্দীন মালিকও। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দল যেখানে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে, সেখানে গণভোট কিংবা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও কাজে আসবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া আমাদের দেশে গণভোটের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। মানুষ ভোটকেন্দ্রে না গেলেও অলৌকিক কায়দায় ৯৮ শতাংশ ভোট ‘হ্যাঁ’ বাক্সে পড়েছে (স্মরণ করুন জিয়া ও এরশাদের গণভোটের কথা)। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সমস্যাটি এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যা গণভোটে সমাধান হওয়ার নয়। গণভোট তখনই কার্যকর হয়, যখন এর প্রতি দুই পক্ষের আস্থা থাকে। তাহলে মাঝামাঝি একটি পথ বের করতে হবে। দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। নির্বাচনের প্রধান যে শক্তি জনগণ, তাদের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ভোটারদের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায় কমিটি হতে পারে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম সরকারের সুখী অবস্থান নিয়ে। সরকারি দলের নেতারা এখন বেশ মৌতাতে আছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট রাজপথে নেই। সংসদে নেই। স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম একাই সরকারি দলের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করে যাচ্ছেন। বিএনপি গোস্সা করে সংসদে যাচ্ছে না। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সংসদে বিরোধী দলের যাওয়ার পরিবেশই নেই।’ কিন্তু সদস্যপদ রক্ষার জন্য ঠিকই তাঁরা সংসদে যান। বিরোধী দলের সাংসদেরা শুল্কমুক্ত গাড়ি ঠিকই আমদানি করেন। এ স্ববিরোধী নীতি পরিহার করতে হবে।
বিরোধী দল রাজপথে না থাকায় সরকারি দলের নেতারা বেশ আহ্লাদিত। আওয়ামী লীগের বাকপটু যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলনে ইস্তফা দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বিরোধী দল রাজপথ ছেড়ে দিলেও সরকার যে দেশটা ঠিকমতো চালাতে পারছে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিমান উড়ছে না, সড়কে যান চলছে না, বন্দর নড়ছে না, খুনের মামলার তদন্ত হচ্ছে না, গুম হওয়া মানুষের হদিস মিলছে না। প্রশাসনে দুর্নীতি কমছে না, শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত থামছে না, পাহাড় ধসে, জলে ডুবে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাহলে সরকার কী করছে?
এত দিন সরকারি দলের নেতারা বলে আসছিলেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। একের পর এক হরতাল ডেকে উন্নয়নকাজ ব্যাহত করছে। তাদের এই যুক্তি মানলে স্বীকার করতে হবে বিরোধী দল এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মাঠ গরম করছে না। নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ এবং প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচির বাইরে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের নেতারা কয়েক দিন আগে রিমোট কন্ট্রোলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাসে আগুন কিংবা সচিবালয়ের ভেতরে ককটেল নিক্ষেপ করলেও এখন সেসব ঘটনাও ঘটছে না।
অর্থাৎ, বিরোধী দল রাজপথে নেই। সংসদে নেই। আন্দোলনে নেই। সংগ্রামে নেই। এতে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা স্বস্তি বোধ করলেও জনমনে স্বস্তি নেই। কেননা, তাদের নিত্যদিনের যে সমস্যা, যে দুর্যোগ, যে নিরাপত্তাহীনতা, তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
এর প্রতিকারে সরকার কী করছে? তারা জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল, তা কি রক্ষা করতে পেরেছে? একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় মানুষের বেডরুম পাহারা না দিলেও রাস্তায় তো পাহারা দেবে। ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের নিরাপত্তা নেই। ঝড়, বন্যা, পাহাড়ধসের শিকার হচ্ছে গরিব ও অসহায় মানুষ। এই যে চট্টগ্রামে শতাধিক মানুষ পাহাড়ধসে মারা গেল, তার কৈফিয়ত কী? কেন তারা ঝুঁকিতে জীবনযাপন করছিল? তাদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কেন ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া হলো না? জাসদের সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেছেন, ‘কী ঘোড়ার ডিমের এক জলাবদ্ধতা, তা নিরসন করতে পারি না।’ তিনি আমলাদের দায়িত্বহীনতায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁদের লাটসাহেব বলে গাল দিয়েছেন। আমলারা তখনই লাটসাহেবের মতো আচরণ করেন, যখন মন্ত্রী-সাংসদেরা মহালাটের মতো আচরণ করেন। আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। মন্ত্রী-সাংসদেরা সৎ হলে, আইন মেনে চললে আমলারাও সমঝে চলতে বাধ্য হন। বছর দুই আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা স্যুটেট-বুটেট না থাকলেও কাজে চৌকস। কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ঠিকমতো চলছে না। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী কি জোর দিয়ে বলতে পারবেন, তাঁর কেবিনেটের সবাই সৎ?
ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার মোটা দাগে যেসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিল, মানুষ তাকে স্বাগতই জানিয়েছিল। বিশেষ করে, তাঁর দিনবদলের সনদ তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পর আমরা কী দেখি? সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-চেলাচামুণ্ডাদের দিনবদল হলেও আমজনতার দিন বদল হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। মন্ত্রীরা বলেছিলেন, তাঁরা পদ্মা সেতু করবেনই। এখনো বলছেন। কিন্তু গলায় জোর পাওয়া যাচ্ছে না। কখনো বলেন সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হবে। কখনো বলেন ফেব্রুয়ারিতে। এক মন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার টাকায় পদ্মা সেতু হবে। আরেক মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের আশা এখনো ছাড়েননি। মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে?
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পাওয়ার পর দুদক সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। একেই বলে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন!
সরকারকে এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে সরকার নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার নেই। মেট্রোরেলে সরকার নেই। চার লেন ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে সরকার নেই। প্রবল জনমত উপেক্ষা করে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ নামে ভাগ করে ফেলল। মানুষ তা-ও মেনে নিয়েছিল এই আশায় যে, তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে, তাদের কষ্ট লাঘব হবে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমবে। এখন সেই নির্বাচন কবে হবে, কেউ বলতে পারে না।
বাজারেও সরকার নেই। তারা ওয়াদা করেছিল, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখবে। পারেনি। সরকার ওয়াদা করেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। কোথাও তার প্রতিফলন নেই। সরকার ওয়াদা করেছিল ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ করবে। পারেনি। সরকার ওয়াদা করেছিল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ করবে। এখন উল্টো টেন্ডারবাজেরাই যে সবকিছু প্রতিরোধ করছে, সড়ক ভবনই তার প্রমাণ। সরকার ওয়াদা করেছিল, দলীয়করণমুক্ত গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। প্রশাসন এখন পুরোপুরি দলীয়করণ হয়ে গেছে। সরকার ওয়াদা করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখবে। তারাও পুরোপুরি দলীয় হয়ে গেছে। সরকার বলেছিল, ফসল ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে। সেখানেও সফল হয়নি। সরকার ওয়াদা করেছিল, সংসদে ৩৩ শতাংশ নারী সাংসদ থাকবে। কিন্তু ৩৩ শতাংশের স্থলে মাত্র ৫০ জন। সরকার বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। কয়েকটি জেলায় পরীক্ষামূলক ন্যাশনাল সার্ভিস চালুর পর এখন বন্ধ। তাহলে সরকার আছে কোথায়?
২০১৪ সালে যখন নির্বাচন হবে, তখন বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলনামা মানুষ শুনতে চাইবে না। দেখতে চাইবে, মহাজোট সরকার জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে, কতটা করতে পারেনি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
২০০৮ সালের নির্বাচনে মানুষ বিএনপির প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ক্ষমতায় থাকতে দলটি যেভাবে দেশকে জঙ্গি, বোমাবাজ ও গ্রেনেডবাজদের অভয়ারণ্য বানিয়েছিল, তখনো তা জনগণের মন ও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেজেগোবরে অবস্থার কারণে মানুষ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলকেই বিকল্প ভেবেছিল। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, সাড়ে তিন বছরে সরকার একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে, বিএনপির দুঃশাসন ও দুর্নীতির স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়া।
নিজে থেকে খামোখা কিছু সমস্যা তৈরি না করলে বিরোধী দলের আন্দোলনবিহীন একটি মেয়াদ পার করা এই সরকারের পক্ষে কঠিন হতো না। এই খামোখা সমস্যার নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা। সংসদের বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন রাশেদ খান মেননকে চ্যালেঞ্জ করেন, তখন নোট অব ডিসেন্ট দেননি বলে। নোট অব ডিসেন্ট না দিলেই সবকিছু জায়েজ হয়ে যায় না। বিশেষ কমিটির এজেন্ডায় কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিষয়টি ছিল? ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল, আসমান থেকে এই প্রস্তাব নাজিল হলো এবং কমিটি তা গ্রহণ করতেও বাধ্য হলো।
গণতন্ত্রের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উত্তম, এই দাবি কেউ করবে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য যেসব ধাপ পার হতে হয়, বাংলাদেশের বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল তার একটি সাময়িক দাওয়াই। আবার এ কথাও সত্য, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে দেড় দশকের ব্যবধানে এই ব্যবস্থাকে বিতর্কিত ও অকার্যকর করে ফেলেছে। এখন বিএনপির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে যতই মাঠ গরম করার চেষ্টা করুন না কেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আর আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। অতএব, একটি বিকল্প পথ বের করে নিতে হবে। সেটি যেমন প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে রীতিতে নির্বাচন হয় সেই রীতির’ হবে না, তেমনি বিরোধী দলের নেত্রীর দাবি অনুযায়ী ‘সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হুবহু পুনর্বহালও’ হবে না। দেশ ও দেশের মানুষের ভালো চাইলে নেতা-নেত্রীদের উচিত আলোচনায় বসা। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে চেষ্টা করা।
প্রথম আলোতেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের প্রশ্নে গণভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন আইনবিদ শাহ্দীন মালিকও। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দল যেখানে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে, সেখানে গণভোট কিংবা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও কাজে আসবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া আমাদের দেশে গণভোটের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। মানুষ ভোটকেন্দ্রে না গেলেও অলৌকিক কায়দায় ৯৮ শতাংশ ভোট ‘হ্যাঁ’ বাক্সে পড়েছে (স্মরণ করুন জিয়া ও এরশাদের গণভোটের কথা)। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সমস্যাটি এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যা গণভোটে সমাধান হওয়ার নয়। গণভোট তখনই কার্যকর হয়, যখন এর প্রতি দুই পক্ষের আস্থা থাকে। তাহলে মাঝামাঝি একটি পথ বের করতে হবে। দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। নির্বাচনের প্রধান যে শক্তি জনগণ, তাদের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে ভোটারদের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায় কমিটি হতে পারে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম সরকারের সুখী অবস্থান নিয়ে। সরকারি দলের নেতারা এখন বেশ মৌতাতে আছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট রাজপথে নেই। সংসদে নেই। স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম একাই সরকারি দলের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করে যাচ্ছেন। বিএনপি গোস্সা করে সংসদে যাচ্ছে না। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সংসদে বিরোধী দলের যাওয়ার পরিবেশই নেই।’ কিন্তু সদস্যপদ রক্ষার জন্য ঠিকই তাঁরা সংসদে যান। বিরোধী দলের সাংসদেরা শুল্কমুক্ত গাড়ি ঠিকই আমদানি করেন। এ স্ববিরোধী নীতি পরিহার করতে হবে।
বিরোধী দল রাজপথে না থাকায় সরকারি দলের নেতারা বেশ আহ্লাদিত। আওয়ামী লীগের বাকপটু যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া আন্দোলনে ইস্তফা দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বিরোধী দল রাজপথ ছেড়ে দিলেও সরকার যে দেশটা ঠিকমতো চালাতে পারছে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিমান উড়ছে না, সড়কে যান চলছে না, বন্দর নড়ছে না, খুনের মামলার তদন্ত হচ্ছে না, গুম হওয়া মানুষের হদিস মিলছে না। প্রশাসনে দুর্নীতি কমছে না, শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত থামছে না, পাহাড় ধসে, জলে ডুবে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাহলে সরকার কী করছে?
এত দিন সরকারি দলের নেতারা বলে আসছিলেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই রাস্তায় জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। একের পর এক হরতাল ডেকে উন্নয়নকাজ ব্যাহত করছে। তাদের এই যুক্তি মানলে স্বীকার করতে হবে বিরোধী দল এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মাঠ গরম করছে না। নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ এবং প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচির বাইরে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের নেতারা কয়েক দিন আগে রিমোট কন্ট্রোলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাসে আগুন কিংবা সচিবালয়ের ভেতরে ককটেল নিক্ষেপ করলেও এখন সেসব ঘটনাও ঘটছে না।
অর্থাৎ, বিরোধী দল রাজপথে নেই। সংসদে নেই। আন্দোলনে নেই। সংগ্রামে নেই। এতে সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা স্বস্তি বোধ করলেও জনমনে স্বস্তি নেই। কেননা, তাদের নিত্যদিনের যে সমস্যা, যে দুর্যোগ, যে নিরাপত্তাহীনতা, তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
এর প্রতিকারে সরকার কী করছে? তারা জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল, তা কি রক্ষা করতে পেরেছে? একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় মানুষের বেডরুম পাহারা না দিলেও রাস্তায় তো পাহারা দেবে। ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের নিরাপত্তা নেই। ঝড়, বন্যা, পাহাড়ধসের শিকার হচ্ছে গরিব ও অসহায় মানুষ। এই যে চট্টগ্রামে শতাধিক মানুষ পাহাড়ধসে মারা গেল, তার কৈফিয়ত কী? কেন তারা ঝুঁকিতে জীবনযাপন করছিল? তাদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কেন ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া হলো না? জাসদের সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেছেন, ‘কী ঘোড়ার ডিমের এক জলাবদ্ধতা, তা নিরসন করতে পারি না।’ তিনি আমলাদের দায়িত্বহীনতায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁদের লাটসাহেব বলে গাল দিয়েছেন। আমলারা তখনই লাটসাহেবের মতো আচরণ করেন, যখন মন্ত্রী-সাংসদেরা মহালাটের মতো আচরণ করেন। আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। মন্ত্রী-সাংসদেরা সৎ হলে, আইন মেনে চললে আমলারাও সমঝে চলতে বাধ্য হন। বছর দুই আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা স্যুটেট-বুটেট না থাকলেও কাজে চৌকস। কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ঠিকমতো চলছে না। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী কি জোর দিয়ে বলতে পারবেন, তাঁর কেবিনেটের সবাই সৎ?
ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার মোটা দাগে যেসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিল, মানুষ তাকে স্বাগতই জানিয়েছিল। বিশেষ করে, তাঁর দিনবদলের সনদ তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পর আমরা কী দেখি? সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-চেলাচামুণ্ডাদের দিনবদল হলেও আমজনতার দিন বদল হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। মন্ত্রীরা বলেছিলেন, তাঁরা পদ্মা সেতু করবেনই। এখনো বলছেন। কিন্তু গলায় জোর পাওয়া যাচ্ছে না। কখনো বলেন সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হবে। কখনো বলেন ফেব্রুয়ারিতে। এক মন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার টাকায় পদ্মা সেতু হবে। আরেক মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের আশা এখনো ছাড়েননি। মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে?
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পাওয়ার পর দুদক সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। একেই বলে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন!
সরকারকে এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে সরকার নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার নেই। মেট্রোরেলে সরকার নেই। চার লেন ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে সরকার নেই। প্রবল জনমত উপেক্ষা করে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ নামে ভাগ করে ফেলল। মানুষ তা-ও মেনে নিয়েছিল এই আশায় যে, তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে, তাদের কষ্ট লাঘব হবে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমবে। এখন সেই নির্বাচন কবে হবে, কেউ বলতে পারে না।
বাজারেও সরকার নেই। তারা ওয়াদা করেছিল, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখবে। পারেনি। সরকার ওয়াদা করেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। কোথাও তার প্রতিফলন নেই। সরকার ওয়াদা করেছিল ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ করবে। পারেনি। সরকার ওয়াদা করেছিল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ করবে। এখন উল্টো টেন্ডারবাজেরাই যে সবকিছু প্রতিরোধ করছে, সড়ক ভবনই তার প্রমাণ। সরকার ওয়াদা করেছিল, দলীয়করণমুক্ত গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। প্রশাসন এখন পুরোপুরি দলীয়করণ হয়ে গেছে। সরকার ওয়াদা করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখবে। তারাও পুরোপুরি দলীয় হয়ে গেছে। সরকার বলেছিল, ফসল ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে। সেখানেও সফল হয়নি। সরকার ওয়াদা করেছিল, সংসদে ৩৩ শতাংশ নারী সাংসদ থাকবে। কিন্তু ৩৩ শতাংশের স্থলে মাত্র ৫০ জন। সরকার বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। কয়েকটি জেলায় পরীক্ষামূলক ন্যাশনাল সার্ভিস চালুর পর এখন বন্ধ। তাহলে সরকার আছে কোথায়?
২০১৪ সালে যখন নির্বাচন হবে, তখন বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলনামা মানুষ শুনতে চাইবে না। দেখতে চাইবে, মহাজোট সরকার জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে, কতটা করতে পারেনি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments