দুর্যোগ-পাহাড় কাটা না থামালে মৃত্যুর মিছিল থামবে না by পাভেল পার্থ

আবারও চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে টানা ভারী বর্ষণের ফলে কাটা পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড়ধসে মারা গেছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। প্রতিটি পাহাড়ধসের ঘটনাই ঘটছে মূলত জুন মাসে, টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে।


পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নেওয়া গরিব উদ্বাস্তু বাঙালিরাই প্রশ্নহীন এই পাহাড়ধসে প্রাণ হারাচ্ছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় পাহাড়ধসে প্রায় ১২৭ জনের করুণ মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলোকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর পাশে সরকারি খাসজমিতে পুনর্বাসনের সুপারিশ করেছিল। সরকারিভাবে চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য চিহ্নিত করা হলেও ২৬ জুনে ধসে যাওয়া চট্টগ্রামের আকবর শাহ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আগে থেকে চিহ্নিত ছিল না। (প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১২)
বারবার বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ধসে পড়ছে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় ও টিলাসমূহ। এসব পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ হলো, এসব পাহাড়ের বাস্তুসংস্থান উল্টেপাল্টে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ের ওপর থেকে বৃক্ষ-লতাগুল্মের আচ্ছাদন তুলে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ি বনভূমি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এলোপাতাড়ি পাহাড় কেটে পাহাড়কে মুমূর্ষু কংকাল বানানো হয়েছে। এমনকি কাটা পাহাড়গুলোতে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা না মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক অবকাঠামো ও উদ্বাস্তু বাঙালিদের মানব বসতি। যত দিন পর্যন্ত পাহাড় কাটা বন্ধ না হবে, তত দিন পর্যন্ত পাহাড়ধসে এ করুণ মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না। দেশে ইমারত নির্মাণ আইনে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও (সংশোধিত) ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারার ৬-খ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না।’ রাষ্ট্রীয় আইনে পাহাড় কাটার জন্য দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব আইন না মানছে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল, না মানছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। কেবল বসতি নয়, বাণিজ্যিক কারণেই দেশের পাহাড়গুলো হত্যা করা হচ্ছে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমেক্রী-প্রাংসা ইউনিয়নেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়গুলোর অবস্থান। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়টির যে নামটি সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছে তহজিংডং নামে, তা মারমা ভাষার শব্দ। মারমা ভাষায় ত-জিং-টং মানে সবুজ পাহাড়, বম এবং মিজো আদিবাসীদের ভাষায় এর নাম চিং চির ময় ক্লাং, বাঙালিরা একবার এর নাম দিয়েছিল ‘বিজয়’। ক্যাক-ক্রো-টং (ক্রেওক্রাডং) পাহাড়টির নামও মারমা ভাষার মানে হলো পাহাড়ের শীর্ষদেশ, বম ও মিজো ভাষায় এর নাম ক্রেওক্রক্লাং। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়সমূহের যে তালিকা তৈরি করে তাতে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি রেঞ্জের ২৯টি পাহাড়ের ভেতর পাঁচটি রেঞ্জের নয়টি পাহাড়ের নামই পাংখোয়া ভাষার। রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার একটি পাহাড়ের নাম থাংনাং। উচ্চতা প্রায় দুই হাজার ৪০৯ ফুট। থাংনাং নামের এক পাহাড়ি পোকার নামে পাংখোয়ারা এই পাহাড়ের নাম রেখেছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যকার বড় পাহাড়ের নাম সাজেক থ্লাং, পাংখোয়া ভাষায় এর অর্থ অপূর্ব সুন্দর পাহাড়। পাহাড়ের নামকরণের সঙ্গে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য, পাহাড়ের প্রতিবেশ, জাতিগত সংস্কৃতি এবং কোনো সামাজিক স্মৃতিময় ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে পাহাড়ের অধিবাসীরা। আবার হাতির নামেও গড়ে উঠেছে অনেক পাহাড়ি এলাকা।
পাহাড়ের অধিবাসীরা পাহাড়কে দেখেন জীবনযাপনের অংশ হিসেবে। অনেক আদিবাসী জনগণ নিজেদের পাহাড়ের সন্তান মনে করে। এ পর্যন্ত দেশে কোনো আদিবাসী অঞ্চলের পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, সিলেটসহ দেশের পাহাড়ি টিলায় বসবাসরত আদিবাসীদের পাহাড়ে টিকে থাকার এই বিজ্ঞান ও কারিগরিকে আমাদের কাজে লাগানো জরুরি। পাহাড়ের সঙ্গে আদিবাসী জীবনের সম্পর্ক এবং পাহাড়কে কোনোভাবে ক্ষতি না করে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসের এই অবিস্মরণীয় জ্ঞান রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত। তাহলে পাহাড়ধসে বারবার এত করুণ মৃত্যুর মিছিল হয়তো আমাদের আর দেখতে হবে না।
বারবার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে মূলত বাইরে থেকে আসা বাঙালিদের গড়ে তোলা নতুন বসতি এলাকাগুলোতেই। দেখা যাচ্ছে, মূলত নদীভাঙন, ক্ষুধা, লবণপানির আগ্রাসন, বাণিজ্যিক চিংড়িঘেরের ফলে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে আশ্রয় নিচ্ছে এসব পাহাড়ি ভূমিতে, যাদের অধিকাংশেরই পাহাড়নির্ভর জীবনের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই, যাদের রক্তস্রোত পাহাড়-বিজ্ঞান মেনে বাহিত হয়নি। এসব বঞ্চিত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এলোপাতাড়ি কাটা পাহাড়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। ইটভাটার মালিক, প্রভাবশালী নির্মাণ সংস্থা, তারাও সমানে পাহাড় কাটছে। ফালি ফালি করে কাটা পাহাড় যে কারোর জন্যই বসবাসের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষার একটানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তাই ধসে পড়ছে এসব পাহাড়। কিন্তু এই পার্বত্য চট্টগ্রামেই পাহাড়ি আদিবাসীদের মাচাং পদ্ধতির বসতি গৃহনির্মাণশৈলী গড়েই উঠেছে পাহাড়কে না কেটে সঠিক ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে। মৌলভীবাজারের খাসিয়ারা পাহাড়ি টিলা জমিতে পানজুমের সময় সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখে পাহাড়ের যাতে ক্ষতি না হয়। রাষ্ট্র কখনোই পাহাড়ের আদিবাসীদের পাহাড় সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার জায়গাকে গুরুত্ব দিয়ে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করেনি, নেয়নি কোনো পাহাড়বান্ধব উন্নয়ন উদ্যোগ।
আশা করি আর কোনো পাহাড় পাহাড়খেকো মানুষের দয়ামায়াহীন ভোগ্য বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হবে না। পাহাড় কেটে কেটে গড়ে উঠবে না আর কোনো পরিবেশ-উদ্বাস্তু মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসত। এলোপাতাড়ি পাহাড় কাটা থামালেই থামবে পাহাড়ি উদ্বাস্তু মানুষের মৃত্যুর করুণ মিছিল।
 গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.