কালের আয়নায়-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে কবে এবং কখন? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সংবিধানে ক্ষমতা ত্যাগের আগে বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুতর বিকৃতি সৃষ্টি করার ব্যাপারটি হয় বিচারপতির চোখে পড়েনি অথবা চোখে পড়লেও তাকে আমল দিতে চাননি। ফলে তার চড়া মাশুল দিতে হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এবং এখনও সেই মাশুল গুনতে হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার শুরুতেই বিএনপি তাতে ক্ষত সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছিল। এই ক্ষত থেকেই ব্যবস্থাটিতে পচনের শুরু
প্রাচীনকালে হিন্দু তান্ত্রিকদের মধ্যে শব সাধনা বা প্রেত সাধনা নামে একটি সাধনার প্রচলন ছিল। এ সাধনার দ্বারা শবকে তারা জীবিত করে তুলতেন অথবা দেওয়া হতো প্রেতকে দেহ ধারণের ক্ষমতা। এই শব বা প্রেতের দ্বারা তান্ত্রিকরা নিজেদের ইচ্ছামতো অসম্ভব সব কাজ করতে পারতেন। এই শব বা প্রেতেরা থাকত তাদের বশীভূত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মনে হয় অধুনা এই প্রেত সাধনা শুরু হয়েছে। এই সাধনার তান্ত্রিক হচ্ছে বিএনপি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ব্যবস্থাটিকে, যেটি এখন বাংলাদেশে মৃত এবং পরিত্যক্ত ব্যবস্থা বলা চলে, সেটিকে আবার তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছাপূরণের জন্য জীবিত করে তোলার চেষ্টা শুরু করেছে। আমাদের এলিটশ্রেণীর একটি সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী অংশ তাতে তালিয়া বাজিয়ে সমর্থন দিচ্ছে।
বিএনপি তাদের এই শব সাধনা দ্বারা মৃতদেহ জীবিত করে তুলতে পারবে কি-না বা আওয়ামী লীগও তাদের প্রতিপক্ষের এই শব সাধনার কাছে মাথা নোয়াবে কি-না তা আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় এই শব সাধনা দ্বারা শব জাগ্রত হলেও ভূতের দ্বারা যেমন উজ্জ্বল বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায় না, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিও যে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে একটি মৃত ও পরিত্যক্ত ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা দ্বারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না এই প্রসঙ্গটি।
অনেকেই বলেন, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলে নব্বই দশকের গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। এখন তারা কোন মুখে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবির বিরোধিতা করেন?
এই সরল প্রশ্নের একটি সরল জবাব হলো, আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন চেয়েছিল বিএনপির চক্রান্তে মাতৃগর্ভ থেকেই তা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং মৃত্যুর আগেই তার সর্বাঙ্গে পচন ধরে। এই পচনও ধরিয়েছিল বিএনপিই। এখন ক্ষমতায় যাওয়ার আর কোনো সোজা রাস্তা না দেখে বিএনপি এবং তাদের কোহর্টরা গতায়ু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে তাদের প্রেত সাধনার দ্বারা আবার জীবিত করে তুলতে চাইছেন। তাদের মনের ইচ্ছা, এই বশীভূত প্রেত তাদের অভীষ্ট সিদ্ধি সম্ভব করে দেবে।
দেশের সুস্থ, স্বাভাবিক, দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রেরই এই শব সাধনার বিরোধিতা করা উচিত। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান আরও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী সাধারণ নির্বাচন যদি সব পক্ষের সম্মতিক্রমে কোনো ধরনের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নিদেন সর্বদলীয় ও সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু মৃত এবং যে ব্যবস্থাটির শরীরে মৃত্যুর আগেই পচন ধরেছিল, সেই ব্যবস্থাটিকে কোনো কারণেই আর দেশের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা নয়, ফিরিয়ে আনা হলে বিএনপির চক্রান্তের রাজনীতি সফল হতে পারে, কিন্তু একটি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
আওয়ামী লীগ যে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ঘোর বিরোধিতা করছে, তা মূলত এ কারণেই। তারাও এটাকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে চাননি। চেয়েছিলেন অ্যান্টিবায়োটিকের মতো অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিকে রোগমুক্ত করার পর ব্যবস্থাটি বাতিল হবে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্ব ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে, এটাই ছিল সংবিধানের নির্দেশ।
বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতও ব্যবস্থাটি বহাল রাখার পক্ষে রায় দেননি। তার কারণ, যে উদ্দেশ্যে ব্যবস্থাটি প্রবর্তন করা হয়েছিল, চক্রান্ত ও অসাধু হস্তক্ষেপের ফলে ব্যবস্থাটিতে পচন ধরায় সেই উদ্দেশ্য সর্বতোভাবে সফল হয়নি এবং ব্যবস্থাটি বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল, পরবর্তীকালে একাধিকবার সেই সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত চেহারা এবং দেশের রাজনীতিতে তার কার্যকলাপ দেখার পর শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা সম্পর্কে মত বদলাতে বাধ্য হয়েছেন এবং বর্তমান পার্লামেন্টও এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে।
বিএনপি যে এখন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রেতযোনি-সাধনা শুরু করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান করা নয়। তাদের উদ্দেশ্য, অতীতে যেমন তারা ব্যবস্থাটিকে একাধিকবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে বিকৃত করতে পেরেছেন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার ও থাকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনেও তা পারার চেষ্টা করা, নইলে ক্ষমতা প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন।
এ জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য তাদের এত হাহুতাশ এবং আন্দোলনের নামে শব সাধনা। একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় জন্মলগ্ন থেকেই এই ব্যবস্থাটিকে বিকৃত ও ব্যর্থ করার জন্য কারা দায়ী? ১৯৯৬ সালে দেশব্যাপী প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার আগে নিজেদের তত্ত্বাবধানে ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা তারা দেশে এবং বিদেশেও নিন্দিত ও ধিক্কৃত হয়।
আওয়ামী লীগ তখন সংসদে নেই। কারণ, তারা ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচন বর্জন করেছিল। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির জন্য বিএনপি মধ্যরাতে সংসদের অধিবেশন ডাকে এবং সকলের অগোচরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সামরিক বাহিনীর মন্ত্রক/রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার বিধান করে। রাষ্ট্রপতির পদে তখন ছিলেন বিএনপিদলীয় রাজাকার নামে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাস। এটা মিডনাইটস কনস্পিরেসি বা মধ্যরাত্রির ষড়যন্ত্র নামে পরে পরিচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের তখন আন্দোলনের বিজয় গর্বে মাথা এত মোটা হয়ে গেছে যে, বিএনপির ক্ষমতা ছাড়ার আগের এই সূক্ষ্ম চালটি ধরতে পারেনি। কথায় বলে, 'পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ'। আওয়ামী লীগের তখন সেই অবস্থা। নইলে তারা তখনই অন্যান্য দফতরের মতো দেশরক্ষা দফতরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে থাকবে_ এই দাবিতে চাপ সৃষ্টি করে বিএনপিকে তা মানতে বাধ্য করতে পারতেন। বিএনপিকে সংবিধানে ওই উদ্দেশ্যমূলক ধারাটি গণআন্দোলনের ভয়েই বদলাতে হতো। কিন্তু বিজয়গর্বে স্ফীত মাথা আওয়ামী লীগ হয় বিএনপির চালটি ধরতে পারেনি অথবা ধরার মতো বুদ্ধি তাদের ছিল না।
বিএনপির এই সূক্ষ্ম চালটি কি ধরতে পেরেছিলেন ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মনোনীত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও? কাগজেই খবর বেরিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর তিনি পদটি গ্রহণ করবেন কি-না তা বিবেচনার জন্য দু'দিন সময় চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানগুলো ভালোভাবে অবহিত হওয়া।
এই দু'দিনের বিচার-বিবেচনার পর তিনি তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদটি গ্রহণে সম্মতি দেন। কিন্তু তার মতো তীক্ষষ্ট বুদ্ধি ও মেধার অধিকারী বিচারপতির দৃষ্টিও কেমন করে দেশরক্ষা মন্ত্রক সংক্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক বিধিটি এড়িয়ে গেল? আমি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে এক সময় খুবই শ্রদ্ধা করতাম এবং শেলী ভাই ডাকতাম (এখনও ডাকি)। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শেলী ভাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে দু'দিন সময় নিলেন এ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধি পর্যালোচনার জন্য। এই পর্যালোচনার সময় বিএনপি সরকার কর্তৃক সংবিধানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সনি্নবেশিত দেশরক্ষা বাহিনী সংক্রান্ত ধারাটি কি আপনার চোখে পড়েনি? তিনি আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেননি।
সংবিধানে ক্ষমতা ত্যাগের আগে বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুতর বিকৃতি সৃষ্টি করার ব্যাপারটি হয় বিচারপতির চোখে পড়েনি অথবা চোখে পড়লেও তাকে আমল দিতে চাননি। ফলে তার চড়া মাশুল দিতে হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এবং এখনও সেই মাশুল গুনতে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার শুরুতেই বিএনপি তাতে ক্ষত সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছিল। এই ক্ষত থেকেই ব্যবস্থাটিতে পচনের শুরু। এই পচনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি ২০০১ সালে সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, যার পরিণতি ২০০৬-০৭ সালে বিএনপিরই হাতের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার শোচনীয় মৃত্যুতে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতা থেকে সামরিক বাহিনীকে মুক্ত রেখে রাষ্ট্রপতির একক হস্তে তাদের দায়িত্ব রাখার বিধানের সুযোগ নিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের যোগসাজশে সামরিক বাহিনীর একাংশ দ্বারা ক্যু ঘটানোর খেলা সাজানো হয়। দেশবাসীর সতর্কতায় এই খেলা সফল করা যায়নি। কিন্তু বিএনপি অনুগত জেনারেল মাহবুবুর রহমান রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেনাপ্রধানের পদ পান। এই মাহবুবুর রহমান এখন বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা।
একই সঙ্গে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃত্বকে খর্ব ও ব্যর্থ করার জন্য জাতির উদ্দেশে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ প্রচার অর্ধপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে দেখা গেল সরকারি মিডিয়ায় উচ্চপদে নিয়োজিত বিএনপির অনুগ্রহভোগী এক সাংবাদিক অফিসার এ কাজটি করেছেন। তাকে অন্য পদে বদলি করা ছাড়া কোনো শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
যা হোক বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো রকমে বিএনপির পাতা ফাঁদ তখন উতরে গেছে। কিন্তু ২০০১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই ফাঁদ আর উতরাতে পারেনি। যদিও তারা ছিলেন আওয়ামী সরকার কর্তৃক মনোনীত। কিন্তু অনেকের ধারণা, তারা 'মায়াবিনীর মায়াজালে' বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো তখন নিরপেক্ষ বলে সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিকেও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে বিএনপি সায় দেয়নি। তার সংসদ উদ্বোধনী ভাষণও তারা বয়কট করেছেন। পরে দেখা গেল, সেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই চা-পান বৈঠকে ঘন ঘন যোগ দিতে যাচ্ছেন বিএনপি নেত্রী, এমনকি তার অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন।
কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের অনেক কনসাস-কিপার জুটে গেছেন। তারা আমাদের এলিটশ্রেণী, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার এমন সব সদস্য, যারা নামিদামি হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ঘোর বিরোধী। কেউ কেউ হাসিনা-ফোবিয়ায় ভোগেন। এবারও রাষ্ট্রপতির হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব থাকার ব্যবস্থাটির সুযোগ নিয়ে এই বাহিনীর একাংশের পক্ষপাতিত্ব দ্বারা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ভোটদাতা, সমর্থক ও প্রার্থীদের ওপর কী নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল, তা এখন ইতিহাস। পূর্ণিমা শীলদের গণধর্ষণের শিকার হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনীও এই সময়ের।
ইয়াজউদ্দিনের আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাহিনী নতুন করে আর না লেখাই ভালো। নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার; কিন্তু ইয়াজউদ্দিন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বনিযুক্ত অবৈধ প্রধান। তিনি চালিত হয়েছেন হাওয়া ভবন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে আসা টেলিফোনের নির্দেশে। তার উপদেষ্টারা সদলে পদত্যাগ করেন। তিনি নিজেই নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। নির্বাচন কমিশন তখন জাল ভোটার তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত। ইয়াজউদ্দিন বিএনপি নেত্রীর অবৈধ নির্দেশ পালনে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত এক-এগারোর আবির্ভাব। তত্ত্বাবধায়ক নামের খোলস ধারণ করে আবার দুই বছরের আধা সামরিক শাসন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ব্যবস্থাটির বেঁচে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকে কি?
১৯৯৬ সাল থেকে বিএনপির ক্রমাগত অপচেষ্টা ও চক্রান্তের দরুন যে ব্যবস্থাটির মৃত্যু হয়েছে, সর্বাঙ্গে বিকৃতের চিহ্ন ধারণ করে যে ব্যবস্থাটি গতায়ু, তার শবদেহে প্রাণ সঞ্চারের জন্য এবং ক্ষমতা দখলে আবার তাকে ব্যবহার করার জন্য বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিএনপির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের সতর্ক হওয়া উচিত। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর যে কোনো ব্যবস্থার কথাই বিবেচনা করা হোক, কিন্তু একটি বিকৃত দেহ মৃত ব্যবস্থায় যেন প্রাণ সঞ্চারের ব্যবস্থা করা না হয়। বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতিতে শব সাধনার স্থান থাকতে পারে না।
লন্ডন, ২৯ জুন ২০১২, শুক্রবার
প্রাচীনকালে হিন্দু তান্ত্রিকদের মধ্যে শব সাধনা বা প্রেত সাধনা নামে একটি সাধনার প্রচলন ছিল। এ সাধনার দ্বারা শবকে তারা জীবিত করে তুলতেন অথবা দেওয়া হতো প্রেতকে দেহ ধারণের ক্ষমতা। এই শব বা প্রেতের দ্বারা তান্ত্রিকরা নিজেদের ইচ্ছামতো অসম্ভব সব কাজ করতে পারতেন। এই শব বা প্রেতেরা থাকত তাদের বশীভূত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মনে হয় অধুনা এই প্রেত সাধনা শুরু হয়েছে। এই সাধনার তান্ত্রিক হচ্ছে বিএনপি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ব্যবস্থাটিকে, যেটি এখন বাংলাদেশে মৃত এবং পরিত্যক্ত ব্যবস্থা বলা চলে, সেটিকে আবার তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছাপূরণের জন্য জীবিত করে তোলার চেষ্টা শুরু করেছে। আমাদের এলিটশ্রেণীর একটি সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী অংশ তাতে তালিয়া বাজিয়ে সমর্থন দিচ্ছে।
বিএনপি তাদের এই শব সাধনা দ্বারা মৃতদেহ জীবিত করে তুলতে পারবে কি-না বা আওয়ামী লীগও তাদের প্রতিপক্ষের এই শব সাধনার কাছে মাথা নোয়াবে কি-না তা আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় এই শব সাধনা দ্বারা শব জাগ্রত হলেও ভূতের দ্বারা যেমন উজ্জ্বল বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায় না, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিও যে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে একটি মৃত ও পরিত্যক্ত ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা দ্বারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না এই প্রসঙ্গটি।
অনেকেই বলেন, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলে নব্বই দশকের গোড়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। এখন তারা কোন মুখে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবির বিরোধিতা করেন?
এই সরল প্রশ্নের একটি সরল জবাব হলো, আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন চেয়েছিল বিএনপির চক্রান্তে মাতৃগর্ভ থেকেই তা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং মৃত্যুর আগেই তার সর্বাঙ্গে পচন ধরে। এই পচনও ধরিয়েছিল বিএনপিই। এখন ক্ষমতায় যাওয়ার আর কোনো সোজা রাস্তা না দেখে বিএনপি এবং তাদের কোহর্টরা গতায়ু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে তাদের প্রেত সাধনার দ্বারা আবার জীবিত করে তুলতে চাইছেন। তাদের মনের ইচ্ছা, এই বশীভূত প্রেত তাদের অভীষ্ট সিদ্ধি সম্ভব করে দেবে।
দেশের সুস্থ, স্বাভাবিক, দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রেরই এই শব সাধনার বিরোধিতা করা উচিত। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান আরও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী সাধারণ নির্বাচন যদি সব পক্ষের সম্মতিক্রমে কোনো ধরনের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নিদেন সর্বদলীয় ও সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু মৃত এবং যে ব্যবস্থাটির শরীরে মৃত্যুর আগেই পচন ধরেছিল, সেই ব্যবস্থাটিকে কোনো কারণেই আর দেশের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা নয়, ফিরিয়ে আনা হলে বিএনপির চক্রান্তের রাজনীতি সফল হতে পারে, কিন্তু একটি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
আওয়ামী লীগ যে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ঘোর বিরোধিতা করছে, তা মূলত এ কারণেই। তারাও এটাকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে চাননি। চেয়েছিলেন অ্যান্টিবায়োটিকের মতো অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিকে রোগমুক্ত করার পর ব্যবস্থাটি বাতিল হবে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্ব ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে, এটাই ছিল সংবিধানের নির্দেশ।
বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতও ব্যবস্থাটি বহাল রাখার পক্ষে রায় দেননি। তার কারণ, যে উদ্দেশ্যে ব্যবস্থাটি প্রবর্তন করা হয়েছিল, চক্রান্ত ও অসাধু হস্তক্ষেপের ফলে ব্যবস্থাটিতে পচন ধরায় সেই উদ্দেশ্য সর্বতোভাবে সফল হয়নি এবং ব্যবস্থাটি বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল, পরবর্তীকালে একাধিকবার সেই সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত চেহারা এবং দেশের রাজনীতিতে তার কার্যকলাপ দেখার পর শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা সম্পর্কে মত বদলাতে বাধ্য হয়েছেন এবং বর্তমান পার্লামেন্টও এই ব্যবস্থা বাতিল করেছে।
বিএনপি যে এখন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রেতযোনি-সাধনা শুরু করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান করা নয়। তাদের উদ্দেশ্য, অতীতে যেমন তারা ব্যবস্থাটিকে একাধিকবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে বিকৃত করতে পেরেছেন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার ও থাকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনেও তা পারার চেষ্টা করা, নইলে ক্ষমতা প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন।
এ জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য তাদের এত হাহুতাশ এবং আন্দোলনের নামে শব সাধনা। একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় জন্মলগ্ন থেকেই এই ব্যবস্থাটিকে বিকৃত ও ব্যর্থ করার জন্য কারা দায়ী? ১৯৯৬ সালে দেশব্যাপী প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার আগে নিজেদের তত্ত্বাবধানে ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা তারা দেশে এবং বিদেশেও নিন্দিত ও ধিক্কৃত হয়।
আওয়ামী লীগ তখন সংসদে নেই। কারণ, তারা ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচন বর্জন করেছিল। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তির জন্য বিএনপি মধ্যরাতে সংসদের অধিবেশন ডাকে এবং সকলের অগোচরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সামরিক বাহিনীর মন্ত্রক/রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার বিধান করে। রাষ্ট্রপতির পদে তখন ছিলেন বিএনপিদলীয় রাজাকার নামে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাস। এটা মিডনাইটস কনস্পিরেসি বা মধ্যরাত্রির ষড়যন্ত্র নামে পরে পরিচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের তখন আন্দোলনের বিজয় গর্বে মাথা এত মোটা হয়ে গেছে যে, বিএনপির ক্ষমতা ছাড়ার আগের এই সূক্ষ্ম চালটি ধরতে পারেনি। কথায় বলে, 'পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ'। আওয়ামী লীগের তখন সেই অবস্থা। নইলে তারা তখনই অন্যান্য দফতরের মতো দেশরক্ষা দফতরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে থাকবে_ এই দাবিতে চাপ সৃষ্টি করে বিএনপিকে তা মানতে বাধ্য করতে পারতেন। বিএনপিকে সংবিধানে ওই উদ্দেশ্যমূলক ধারাটি গণআন্দোলনের ভয়েই বদলাতে হতো। কিন্তু বিজয়গর্বে স্ফীত মাথা আওয়ামী লীগ হয় বিএনপির চালটি ধরতে পারেনি অথবা ধরার মতো বুদ্ধি তাদের ছিল না।
বিএনপির এই সূক্ষ্ম চালটি কি ধরতে পেরেছিলেন ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মনোনীত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও? কাগজেই খবর বেরিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর তিনি পদটি গ্রহণ করবেন কি-না তা বিবেচনার জন্য দু'দিন সময় চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানগুলো ভালোভাবে অবহিত হওয়া।
এই দু'দিনের বিচার-বিবেচনার পর তিনি তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদটি গ্রহণে সম্মতি দেন। কিন্তু তার মতো তীক্ষষ্ট বুদ্ধি ও মেধার অধিকারী বিচারপতির দৃষ্টিও কেমন করে দেশরক্ষা মন্ত্রক সংক্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক বিধিটি এড়িয়ে গেল? আমি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে এক সময় খুবই শ্রদ্ধা করতাম এবং শেলী ভাই ডাকতাম (এখনও ডাকি)। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শেলী ভাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে দু'দিন সময় নিলেন এ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধি পর্যালোচনার জন্য। এই পর্যালোচনার সময় বিএনপি সরকার কর্তৃক সংবিধানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সনি্নবেশিত দেশরক্ষা বাহিনী সংক্রান্ত ধারাটি কি আপনার চোখে পড়েনি? তিনি আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেননি।
সংবিধানে ক্ষমতা ত্যাগের আগে বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুতর বিকৃতি সৃষ্টি করার ব্যাপারটি হয় বিচারপতির চোখে পড়েনি অথবা চোখে পড়লেও তাকে আমল দিতে চাননি। ফলে তার চড়া মাশুল দিতে হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এবং এখনও সেই মাশুল গুনতে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার শুরুতেই বিএনপি তাতে ক্ষত সৃষ্টি করে রেখে গিয়েছিল। এই ক্ষত থেকেই ব্যবস্থাটিতে পচনের শুরু। এই পচনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি ২০০১ সালে সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, যার পরিণতি ২০০৬-০৭ সালে বিএনপিরই হাতের পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার শোচনীয় মৃত্যুতে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতা থেকে সামরিক বাহিনীকে মুক্ত রেখে রাষ্ট্রপতির একক হস্তে তাদের দায়িত্ব রাখার বিধানের সুযোগ নিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের যোগসাজশে সামরিক বাহিনীর একাংশ দ্বারা ক্যু ঘটানোর খেলা সাজানো হয়। দেশবাসীর সতর্কতায় এই খেলা সফল করা যায়নি। কিন্তু বিএনপি অনুগত জেনারেল মাহবুবুর রহমান রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেনাপ্রধানের পদ পান। এই মাহবুবুর রহমান এখন বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা।
একই সঙ্গে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃত্বকে খর্ব ও ব্যর্থ করার জন্য জাতির উদ্দেশে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ প্রচার অর্ধপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে দেখা গেল সরকারি মিডিয়ায় উচ্চপদে নিয়োজিত বিএনপির অনুগ্রহভোগী এক সাংবাদিক অফিসার এ কাজটি করেছেন। তাকে অন্য পদে বদলি করা ছাড়া কোনো শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
যা হোক বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো রকমে বিএনপির পাতা ফাঁদ তখন উতরে গেছে। কিন্তু ২০০১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই ফাঁদ আর উতরাতে পারেনি। যদিও তারা ছিলেন আওয়ামী সরকার কর্তৃক মনোনীত। কিন্তু অনেকের ধারণা, তারা 'মায়াবিনীর মায়াজালে' বন্দি হয়ে গিয়েছিলেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো তখন নিরপেক্ষ বলে সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিকেও রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে বিএনপি সায় দেয়নি। তার সংসদ উদ্বোধনী ভাষণও তারা বয়কট করেছেন। পরে দেখা গেল, সেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই চা-পান বৈঠকে ঘন ঘন যোগ দিতে যাচ্ছেন বিএনপি নেত্রী, এমনকি তার অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন।
কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের অনেক কনসাস-কিপার জুটে গেছেন। তারা আমাদের এলিটশ্রেণী, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার এমন সব সদস্য, যারা নামিদামি হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ঘোর বিরোধী। কেউ কেউ হাসিনা-ফোবিয়ায় ভোগেন। এবারও রাষ্ট্রপতির হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব থাকার ব্যবস্থাটির সুযোগ নিয়ে এই বাহিনীর একাংশের পক্ষপাতিত্ব দ্বারা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ভোটদাতা, সমর্থক ও প্রার্থীদের ওপর কী নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল, তা এখন ইতিহাস। পূর্ণিমা শীলদের গণধর্ষণের শিকার হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনীও এই সময়ের।
ইয়াজউদ্দিনের আমলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাহিনী নতুন করে আর না লেখাই ভালো। নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার; কিন্তু ইয়াজউদ্দিন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বনিযুক্ত অবৈধ প্রধান। তিনি চালিত হয়েছেন হাওয়া ভবন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে আসা টেলিফোনের নির্দেশে। তার উপদেষ্টারা সদলে পদত্যাগ করেন। তিনি নিজেই নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। নির্বাচন কমিশন তখন জাল ভোটার তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত। ইয়াজউদ্দিন বিএনপি নেত্রীর অবৈধ নির্দেশ পালনে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত এক-এগারোর আবির্ভাব। তত্ত্বাবধায়ক নামের খোলস ধারণ করে আবার দুই বছরের আধা সামরিক শাসন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক ব্যবস্থাটির বেঁচে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকে কি?
১৯৯৬ সাল থেকে বিএনপির ক্রমাগত অপচেষ্টা ও চক্রান্তের দরুন যে ব্যবস্থাটির মৃত্যু হয়েছে, সর্বাঙ্গে বিকৃতের চিহ্ন ধারণ করে যে ব্যবস্থাটি গতায়ু, তার শবদেহে প্রাণ সঞ্চারের জন্য এবং ক্ষমতা দখলে আবার তাকে ব্যবহার করার জন্য বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিএনপির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের সতর্ক হওয়া উচিত। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর যে কোনো ব্যবস্থার কথাই বিবেচনা করা হোক, কিন্তু একটি বিকৃত দেহ মৃত ব্যবস্থায় যেন প্রাণ সঞ্চারের ব্যবস্থা করা না হয়। বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতিতে শব সাধনার স্থান থাকতে পারে না।
লন্ডন, ২৯ জুন ২০১২, শুক্রবার
No comments