প্রসঙ্গ মেহেরজান : শিল্পীর স্বাধীনতা, শিল্পীর দায় by তারেক আহমেদ

'মেহেরজান' ছবিটি আর দেখার সুযোগ হলো না। অন্তত সিনেমা হলে গিয়ে দেখার সুযোগ নেই। কারণ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ছবিটির পরিবেশক গোষ্ঠী সিনেমা হল থেকে ছবিটি নামিয়ে নিতে বলেছে। যদিও নির্মাতা এ বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছেন।


অন্য সময় হলে সেন্সর বোর্ড বা সরকারের ওপরমহলের দোহাই দেওয়া যেত 'এলিট' এক নারী মুক্তিযোদ্ধা নাকি এ রকম দাবিও করেছেন। কিন্তু সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ ছবিটি নিষিদ্ধ করার কোনো আদেশ দেয়নি বলে জানা গেছে। তবে বিষয়বস্তু আর প্লট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও নির্দিষ্ট কোন অজুহাতে ছবিটি সিনেমা হল থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, তা বোঝা গেল না।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এটি একটি যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবি। সন্দেহ নেই, অনেক দর্শকই এই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হবেন। নির্মাতা তো বটেই, ছবির পরিবেশক-প্রদর্শকদের মনেও বাণিজ্যিক এই চিন্তাটি ভালোই কাজ করেছিল বলা চলে। তবে 'মেহেরজান' প্রসঙ্গে বিতর্ক উঠেছে সম্ভবত এটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের প্রচলিত ডিসকোর্স ভাঙার চেষ্টা করেছে বলে। সেই ডিসকোর্সটি কী? প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের ছবি মানেই রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তানি সেনা ইত্যাদি চরিত্র থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হবে। যুদ্ধে রাজাকার আর পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। শেষত, মুক্তিযোদ্ধারা এই উভয় শত্রুকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করবেন। শেষ দৃশ্যে দেখা যাবে, পেছনে লাল সূর্য, সামনে দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝ দিয়ে রাইফেল হাতে মুক্তি সেনারা হেঁটে চলেছেন। এসব ছবিতে রাজাকার মানেই টুপি-দাড়িওয়ালা মানুষ, হেন অপকর্ম নেই যা সে করে না। আর পাকিস্তানি সেনা_পৃথিবীর নিকৃষ্ট জীব। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট আর অগি্নসংযোগের মতো ঘটনায় যাদের তুলনা হয় না। জানি না, স্বাধীনতার চার দশক পরও মুক্তযুদ্ধবিষয়ক ছবি নির্মাণে এ-জাতীয় ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট চিন্তার ডিসকোর্স কেন আমরা ধারণ করে আছি।
'মেহেরজান' সম্ভবত এখানেই বিপত্তি ঘটিয়েছে। ছবিটি না দেখলেও নানাভাবে ছবির ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যা জানা গেছে, তাতে পাকিস্তানি এক সেনাসদস্যের সঙ্গে এক বাঙালি নারীর প্রেমই মূল বিপত্তির কারণ। যেন সৈনিকটি ভারতীয় বা বাংলাদেশি হলে আপত্তির কিছু ছিল না। এ ক্ষেত্রে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ভাইবোনেরা কিংবা ভারতের কাশ্মীরের জনগণ কী বলবেন জানি না। নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সব ধরনের আগ্রাসনের শিকার তো তারাও।
বিষয়টি এখানেই শেষ হলে কথা ছিল না। অনেকের আপত্তি, মেহেরজান এতকাল পরও কেন এই পাকিস্তানি কুলাঙ্গারকে ভুলতে পারল না। কেনই বা পাকিস্তানি সেনাটি এই অন্যায় যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্বপক্ষ ত্যাগ করতে চাইল? আর নানাজান_যে চরিত্রে অভিনয় করে প্রখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জি হয়তো অন্য রকম স্বাদ পেতে চেয়েছিলেন_তিনিও বোধ হয় এই বিতর্কে ফেঁসে গেছেন। কারণ প্রচলিত ডিসকোর্স এ-জাতীয় চরিত্রকে কেবল ট্র্যাডিশনাল মুসলিম লীগপন্থী রাজাকার হিসেবেই গণ্য করতে শেখায় আমাদের।
নিঃসন্দেহে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু বিগত চার দশকে শিল্প-সাহিত্যের অন্য শাখাগুলোর কথা বাদ রাখলেও যদি চলচ্চিত্রের কথাই কেবল ধরি, তবে সংখ্যার বিচারে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র খুব একটা কম হয়নি। কিন্তু খুব বাড়িয়ে না বললেও সচেতন দর্শক মাত্র জানেন, সত্যিকার শিল্পমানসম্পন্ন কোনো চলচ্চিত্র সৃষ্টি এখনো হয়নি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক বছর তো বটেই, আশির দশকে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বিকল্পধারার ছবি নির্মাতারা কিংবা সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তাতে চরিত্র সৃষ্টিতে, ঘটনার বয়ানে কিংবা আবহ নির্মাণে বেশির ভাগ নির্মাতাই মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে দু-একটা ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়; তবে সেই ব্যতিক্রমগুলোও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার আগে আলোচিত ডিসকোর্স অতিক্রম করতে পারেনি। অনেক নির্মাতার হাতে পড়ে রাজাকার-আলবদর কিংবা পাকিস্তানি সেনা ইত্যাদি চরিত্র রীতিমতো হাস্যরসাত্মক হয়ে উঠেছে, যা এক অর্থে এহেন ঘৃণ্য অপরাধীদের প্রকৃত অপরাধের মাত্রাও হ্রাস করার প্রয়াস পেয়েছে কখনো কখনো।
তবে ছবিটির দুর্বলতা সম্ভবত অন্যত্র। প্রত্যক্ষ দর্শনের সুযোগ না হলেও ছবি মুক্তির আগের রাতে বেসরকারি একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে 'মেহেরজান' নিয়ে যে অনুষ্ঠান হয়, তাতে পরিচালক তো বটেই, চিত্রগ্রাহক, শিল্প নির্দেশকসহ সবাইকেই ছবিটির ফটোগ্রাফি বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেল। আর নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন যখন নবধঁঃরভঁষ ঢ়যড়ঃড়মৎধঢ়যু কথটি উচ্চারণ করলেন, তখন মনে হলো যুদ্ধের ভয়াবহতাই যেন তাঁদের এই উচ্ছ্বাসে চাপা পড়ে গেল। ঝকঝকে পোশাক-পরিচ্ছদ, বাংলাদেশের গ্রামের ফকফকা ধরনের টুকরো টুকরো শটস ইত্যাদিকে অনেকেই অ্যাঙ্ােটিক প্রবণতা বলেছেন। ওরিয়েন্টালিস্ট ভঙ্গিও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, যুদ্ধ কি এ-জাতীয় কোনো সৌন্দর্য ধারণ করে? খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মার্কিনিদের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র শিকার ইরাক ও আফগানিস্তানে যে হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলা গত এক দশকে গোটা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে, তাতেও কি সন্দেহ আছে, কোনো সৌন্দর্য ধারণের ক্ষমতা যুদ্ধের আছে? আর ২০০৯-এর জানুয়ারিতে টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক আর মর্টারের গোলায় গাজায় ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষসহ শিশুরা যেভাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, তাতে গোটা দুনিয়ার মানুষই শিউরে ওঠে। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর মারণাস্ত্রের ঝনঝনানিই তো গোটা দুনিয়ার মানুষকে ক্রমাগত যুদ্ধবিরোধী করে তুলছে।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে পড়ে যায় দুই দশকেরও বেশি আগে দেখা সোভিয়েত চলচ্চিত্র 'কাম অ্যান্ড সি'র কথা। যুদ্ধের ভয়াবহতা যে কত ব্যাপক হতে পারে তা এ ছবিতে এক কিশোরের দৃষ্টিকোণ থেকে চলচ্চিত্রকার এলেম ক্লিমভ তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ ছবিতে গ্রামসুদ্ধ মানুষকে একটি ঘরে আটকে নির্মমভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে নাৎসি বাহিনী। ভয়াবহ এ হত্যাযজ্ঞ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় সেই কিশোর। এমন ভয়াবহ অসংখ্য হত্যাযজ্ঞ যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ঘটেছে, তা আমাদের অনেকেরই জানা। এসব ভয়াবহ দৃশ্যের চিত্রায়ণ কি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছবি নির্মাণে করতে সক্ষম হবেন কখনো?
'মেহেরজান', সন্দেহ নেই অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সাদা-কালো অবয়ব নির্মাণের প্রচলিত যে ডিসকোর্স আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা এযাবৎকাল ধারণ করে আছেন, তাতে এ ছবির বিষয় নির্বাচন ব্যতিক্রম ও সাহসের পরিচয় বৈকি। তবে নির্মাতার এই সৎ সাহস তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র কর্মটিকে বলি দিল কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। যদি প্রচলিত ডিসকোর্সের বাইরে যাওয়ার কারণেই দর্শকরা ছবিটি দেখার সুযোগবঞ্চিত হন, তবে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধ কেবল ভূখণ্ডগত স্বাধীনতাই দিয়েছে, আমাদের মনকে মুক্ত করতে পারেনি। চিন্তার মুক্তি আর শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য আমাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.