চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে 'নদীমাতৃক' পরিচয়! by শাহ মতিন টিপু

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, ক্রমেই বাংলাদেশের এই পরিচয়টি হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদী মরে গেছে। আবার অনেক নদী মৃতপ্রায়। নদীর এই দুরবস্থায় দেশে একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদনের ধারা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশের জাতীয় সমস্যার মধ্যে এটা অন্যতম প্রধান সমস্যা।


অথচ এ ব্যাপারে কার্যত যে ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হওয়া দরকার, তার বড়ই অভাব। অপরিকল্পিত নদীশাসন, বাঁধ নির্মাণ, শাখানদীগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রধান নদীতে ডুবোচর সৃষ্টি, অতিরিক্ত পলির স্তর জমে যাওয়া, নদী দখল, সর্বোপরি নদীর দুরবস্থা রোধ ও গতি উন্নয়নে দায়িত্বশীল মহলের নিস্পৃহতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো প্রচণ্ড হুমকির মুখে। দেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডবি্লউটিএ), নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বেশ কয়েকটি নদীসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান যে মোটেই কিছু করছে না, তা নয়। কিন্তু যেটুকু করছে, তা যেন একেবারেই দায়সারা গোছের। যতটা দায়িত্বশীল হওয়া দরকার, ততটা দায়িত্বপূর্ণ নয়। নদীর বর্তমান দুরবস্থায় তাদের চিৎকার যেভাবে কানে লাগার কথা ছিল, সেভাবে কানে লাগছে না। অথচ পরিস্থিতি তাদের জন্য চরম উদ্বেগের হওয়ার কথা ছিল। তাদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাকে সামনে এনে দাঁড় করানো হচ্ছে। কখনো কখনো তাৎক্ষণিক স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা কোনোক্রমেই নদীর দুরবস্থা প্রতিরোধে যথার্থ হয়ে উঠছে না। বলা হয়, নদীর ভাঙা-গড়া, গতিপথ বদলে যাওয়া এবং নদীর মরে যাওয়া প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে থাকে। যতই বলা হোক, সময় অনেক পাল্টেছে। দুনিয়া এখন প্রযুক্তিময়। প্রযুক্তির ওপর ভর করে পৃথিবী অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে পরিকল্পিতভাবে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়া দরকার। দেশে মোট নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদী ১১৭টি। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে। এ তথ্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপেরই। প্রতি বছর কোনো না কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আশার কথা, সম্প্রতি দেশের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা ও গভীরতা বাড়াতে সরকার দুই হাজার ৯৫ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিগগিরই ৫৩টি নদী খননে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু হওয়ার কথা এবং ২০১২ সালের মাঝামাঝি প্রকল্প দুটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। এর আওতায় নদীপথের পাঁচ হাজার ৩৩৯ কিলোমিটার পথ খনন হবে। প্রত্যাশা করব, এ কাজটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক। পাশাপাশি আরো পদক্ষেপ নেওয়া হোক। কারণ, আমাদের দেশে যে প্রকল্পই হাতে নেওয়া হয়, তার অধিকাংশই সফল হয় না। নদী-খালের ক্ষেত্রে এ অভিযোগটি আরো গুরুতর। যাহোক, অন্তত নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিচয়টুকু টিকিয়ে রাখতে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ দেখতে চাই।
শাহ মতিন টিপু

No comments

Powered by Blogger.