সাঁওতাল বিদ্রোহ-৩০ জুন :১৮৫৫ বনাম ২০১১ by পাভেল পার্থ
বারবার আদিবাসীরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী নারীরা চরম নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন পাড়ি দিচ্ছে। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৭ বছরে তাই আমরা প্রশ্ন করছি_ এ রাষ্ট্র কি সবার? রাষ্ট্র যদি সবার হয়, তবে রাষ্ট্র সব নাগরিকের মর্যাদা, স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য
বাংলাদেশের আদিবাসী নিম্নবর্গের কাছে ৩০ জুন তারিখটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৫ সালের এ দিনে সংঘটিত হয়েছিল হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ। হুলের ঠিক ১৫৬ বছর পর ২০১১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং নিদারুণভাবে দেশের সব আদিবাসীর আত্মপরিচয় ও জাতীয়তার স্বীকৃতি সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা হয়।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার সদর শহর বারহাইতের কাছাকাছি ভাগনাডিহি গ্রামের নিপীড়িত সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু-কানু-চাদ-ভৈরব মুর্মু এবং তাদের বোন ফুলমনি মুর্মুর নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসন আর অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ গণপদযাত্রার সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ এই শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নেয় স্থানীয় আদিবাসী এবং নিপীড়িত প্রান্তিক বাঙালিরাও। ঐতিহাসিকভাবে সাঁওতালরা শ্রেণীনিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ালেও ১৮৫৫ সালের বিদ্রোহকেই শুধু সাঁওতাল জনগণ 'হুল' হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে। হুল শুধু নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এবং বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহই ছিল না; এটি একই কায়দায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ফানা ফানা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক মুক্তির আহ্বানও ছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার সিপাহি বিদ্রোহ, মণ্ডা-তেভাগা-নানকার আন্দোলনসহ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ। নিপীড়নমূলক ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে যে উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল মেহনতি প্রান্তিক শ্রেণীলড়াকুদের জীবন থেকে; আজও সেই লড়াই থামেনি। আজও সাঁওতালসহ এ দেশের প্রান্তিক মেহনতি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি আসেনি। আজও এ দেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নিশ্চিত হয়নি ভূমি-বন-পরিবেশ-প্রাণিসম্পদের নিজস্ব প্রথাগত জীবনের সার্বভৌম অধিকার।
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ নিজেদের একক আত্মপরিচয় হিসেবে 'আদিবাসী' প্রত্যয়টির সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাইলেও রাষ্ট্র বারবার তা নানা ছল ও অযুক্তিতে পাশ কাটিয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে প্রথম এ বিষয়ে আলাপ-বাহাস শুরু করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক থেকে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরে রাষ্ট্র কোনো শিক্ষা ও নৈতিকতা গ্রহণ করতে পারেনি। রাষ্ট্র তার জাত্যভিমানী একতরফা মনস্তত্ত্ব বহাল ও জাহির রেখেছে। আদিবাসী নিম্নবর্গের সঙ্গে রাষ্ট্রের বরাবরই এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
ইতিহাস গ্রন্থনের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো সাঁওতাল বিদ্রোহকে কেবল একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় অত্যাচারিত প্রজাদের সশস্ত্র লড়াই হিসেবেই পাঠ করে, যা হুলের বহুপাক্ষিক বিস্তার এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের বিরাজমানতার ঐতিহাসিকতাকে আড়াল করে ফেলে। রাষ্ট্র কি রাষ্ট্রের নানা এজেন্সি ও তথাকথিত মূলধারার বাঙালি মনস্তত্ত্ব প্রশ্নহীন কায়দায় আদিবাসী জগৎকে এক 'অপর' ও 'নিম্নশ্রেণীর' জগৎ হিসেবেই দেখে চলেছে! যার প্রতিফলন ঘটে যখন রাষ্ট্র কোনো আইন কি নীতি চাপিয়ে দেয় আদিবাসীদের ওপর কিংবা যখন বাঙালিরা দখল ও নিপীড়ন চালায় আদিবাসী বসতিতে। বারবার এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আদিবাসী জগৎ নিয়ে রাষ্ট্র ও মূলধারার বাঙালিদের চিন্তাভাবনায় বৈষম্যের বীজ রোপিত। বাংলাদেশে 'আরণ্য জনপদে' নামে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ 'নামকরা' একটি বই আছে। গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহকে তাই 'হাঙ্গামা' বলে উল্লেখ করেছেন।
১৮৫৫ সালে সংঘটিত মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের গৌরবময় ১৫৭ বছর পাড়ি দিচ্ছি আমরা। কিন্তু এখনও সুরক্ষিত হয়নি আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মাতৃভাষা-ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার। দখল-সন্ত্রাস ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও আদিবাসী নারী-পুরুষরা লড়াই করে যাচ্ছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার আদিবাসীদের কাঙ্ক্ষিত দাবি ও প্রত্যাশা পূরণে তেমন একটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। আদিবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশনের দাবি করে আসছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল_ ক্ষমতায় গেলে সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে একটি পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করবে। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে; অথচ সমতলের আদিবাসীদের জন্য কোনো পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দায়িত্ব নেয়নি সরকার। এ অবস্থা স্পষ্টত জানিয়ে দেয়_ আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের বিবেচনা ও চিন্তা কতখানি আছে। অথচ আদিবাসীরা নিজের জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। এ দেশের মাটি-বীজ-কৃষি-গ্যাস-কয়লা ও বনভূমি রক্ষায় জানবাজি রেখে দাঁড়িয়েছে বারবার। কিন্তু আদিবাসীদের কোনো স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। বারবার আদিবাসীরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী নারীরা চরম নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন পাড়ি দিচ্ছে। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৭ বছরে তাই আমরা প্রশ্ন করছি_ এ রাষ্ট্র কি সবার? রাষ্ট্র যদি সবার হয়, তবে রাষ্ট্র সব নাগরিকের মর্যাদা, স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@yahoo.com
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভারতের বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার সদর শহর বারহাইতের কাছাকাছি ভাগনাডিহি গ্রামের নিপীড়িত সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু-কানু-চাদ-ভৈরব মুর্মু এবং তাদের বোন ফুলমনি মুর্মুর নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ব্রিটিশ শাসন আর অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ গণপদযাত্রার সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ এই শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নেয় স্থানীয় আদিবাসী এবং নিপীড়িত প্রান্তিক বাঙালিরাও। ঐতিহাসিকভাবে সাঁওতালরা শ্রেণীনিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ালেও ১৮৫৫ সালের বিদ্রোহকেই শুধু সাঁওতাল জনগণ 'হুল' হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে। হুল শুধু নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এবং বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহই ছিল না; এটি একই কায়দায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ফানা ফানা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক মুক্তির আহ্বানও ছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার সিপাহি বিদ্রোহ, মণ্ডা-তেভাগা-নানকার আন্দোলনসহ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ। নিপীড়নমূলক ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে যে উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল মেহনতি প্রান্তিক শ্রেণীলড়াকুদের জীবন থেকে; আজও সেই লড়াই থামেনি। আজও সাঁওতালসহ এ দেশের প্রান্তিক মেহনতি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি আসেনি। আজও এ দেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নিশ্চিত হয়নি ভূমি-বন-পরিবেশ-প্রাণিসম্পদের নিজস্ব প্রথাগত জীবনের সার্বভৌম অধিকার।
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ নিজেদের একক আত্মপরিচয় হিসেবে 'আদিবাসী' প্রত্যয়টির সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাইলেও রাষ্ট্র বারবার তা নানা ছল ও অযুক্তিতে পাশ কাটিয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে প্রথম এ বিষয়ে আলাপ-বাহাস শুরু করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক থেকে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরে রাষ্ট্র কোনো শিক্ষা ও নৈতিকতা গ্রহণ করতে পারেনি। রাষ্ট্র তার জাত্যভিমানী একতরফা মনস্তত্ত্ব বহাল ও জাহির রেখেছে। আদিবাসী নিম্নবর্গের সঙ্গে রাষ্ট্রের বরাবরই এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
ইতিহাস গ্রন্থনের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো সাঁওতাল বিদ্রোহকে কেবল একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় অত্যাচারিত প্রজাদের সশস্ত্র লড়াই হিসেবেই পাঠ করে, যা হুলের বহুপাক্ষিক বিস্তার এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের বিরাজমানতার ঐতিহাসিকতাকে আড়াল করে ফেলে। রাষ্ট্র কি রাষ্ট্রের নানা এজেন্সি ও তথাকথিত মূলধারার বাঙালি মনস্তত্ত্ব প্রশ্নহীন কায়দায় আদিবাসী জগৎকে এক 'অপর' ও 'নিম্নশ্রেণীর' জগৎ হিসেবেই দেখে চলেছে! যার প্রতিফলন ঘটে যখন রাষ্ট্র কোনো আইন কি নীতি চাপিয়ে দেয় আদিবাসীদের ওপর কিংবা যখন বাঙালিরা দখল ও নিপীড়ন চালায় আদিবাসী বসতিতে। বারবার এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আদিবাসী জগৎ নিয়ে রাষ্ট্র ও মূলধারার বাঙালিদের চিন্তাভাবনায় বৈষম্যের বীজ রোপিত। বাংলাদেশে 'আরণ্য জনপদে' নামে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ 'নামকরা' একটি বই আছে। গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহকে তাই 'হাঙ্গামা' বলে উল্লেখ করেছেন।
১৮৫৫ সালে সংঘটিত মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের গৌরবময় ১৫৭ বছর পাড়ি দিচ্ছি আমরা। কিন্তু এখনও সুরক্ষিত হয়নি আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মাতৃভাষা-ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার। দখল-সন্ত্রাস ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও আদিবাসী নারী-পুরুষরা লড়াই করে যাচ্ছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার আদিবাসীদের কাঙ্ক্ষিত দাবি ও প্রত্যাশা পূরণে তেমন একটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। আদিবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশনের দাবি করে আসছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল_ ক্ষমতায় গেলে সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে একটি পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করবে। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে; অথচ সমতলের আদিবাসীদের জন্য কোনো পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দায়িত্ব নেয়নি সরকার। এ অবস্থা স্পষ্টত জানিয়ে দেয়_ আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের বিবেচনা ও চিন্তা কতখানি আছে। অথচ আদিবাসীরা নিজের জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। এ দেশের মাটি-বীজ-কৃষি-গ্যাস-কয়লা ও বনভূমি রক্ষায় জানবাজি রেখে দাঁড়িয়েছে বারবার। কিন্তু আদিবাসীদের কোনো স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। বারবার আদিবাসীরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী নারীরা চরম নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন পাড়ি দিচ্ছে। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৭ বছরে তাই আমরা প্রশ্ন করছি_ এ রাষ্ট্র কি সবার? রাষ্ট্র যদি সবার হয়, তবে রাষ্ট্র সব নাগরিকের মর্যাদা, স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@yahoo.com
No comments