মনের কোণে হীরে-মুক্তো-বাজেট বিচিত্রার প্রথাগত ধারায় একই ফলোদয় by ড. সা'দত হুসাইন
১৯১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। বাজেট-উত্তর নৈশভোজও সম্পন্ন হয়েছে। আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি। নির্বিঘ্নে দ্রুতগতিতে বাজেট পাস হওয়ার অর্থ হলো, শাসক দলের প্রতি সংসদের পূর্ণ আস্তা রয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বলে এর অন্যথা হওয়ার উপায় নেই, কারণ সংসদে শাসক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
বাজেট পাসের মাধ্যমে আগামী এক বছরের জন্য সরকারের আয়-ব্যয়ের অনুমোদিত রূপরেখা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। এ রূপরেখা অনুসরণ করে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একমাত্র সংসদই বাজেট অনুমোদন করতে পারে। এর দার্শনিক যৌক্তিকতা হৃদয়গ্রাহ্য। বাজেটে আয়ের যে বৃত্তান্ত দেওয়া হয় তা ট্যাঙ্ বা করনির্ভর। কর আদায় করেই সরকারকে তার আয় সংগ্রহ করতে হয় এবং ব্যয় সংস্থান করতে হয়। জনগণ বা নাগরিকদের কাছ থেকে এ ট্যাঙ্ আদায় করতে হবে। নাগরিকদের আয়ের একাংশ অর্থাৎ তাদের পকেটের টাকার একাংশ ট্যাঙ্রে মাধ্যমে সরকার তার পকেটে বা কোষাগারে নিয়ে যায়। এর জন্য যদি জনগণের সম্মতি বা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না থাকে, তবে তা লুণ্ঠনের পর্যায়ে পড়ে যাবে। যেহেতু এ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে প্রত্যেক নাগরিকের মত নেওয়া সম্ভব নয়, তাই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মতি নিয়ে ট্যাঙ্ ধার্যকরণ প্রক্রিয়াকে নৈতিক ও আইনানুগভাবে গ্রহণযোগ্য করা হয়। ট্যাঙ্রে মাধ্যমে আহরিত অর্থ কোন মন্ত্রণালয় বা সংস্থার মাধ্যমে কী কাজে ব্যয় করা হবে, তার রূপরেখাও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুশাসন বলে সংসদকে অনুমোদন করতে হয়। ব্যাপারটি খুবই যৌক্তিক।
সংসদে বাজেট উপস্থাপন একটি বড় মাপের বার্ষিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের অর্থবছর যেহেতু জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত, তাই অর্থবছর শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণত ১০ জুনের মধ্যে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হয় এবং ১ জুলাইয়ের আগে তা পাস করা হয়, সংসদে পাস হওয়া বাজেটের অনুসরণে ১ জুলাই থেকে ব্যয় নির্বাহ শুরু করা হয়। তবে বাজেট ঋতু শুরু হয় মধ্য এপ্রিল থেকে, চিঠিপত্র লেখালেখি এবং বিভিন্ন মহলের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে। কিছু আলোচনা হয় এনবিআরের উদ্যোগে মূলত সম্ভাব্য কর প্রস্তাবের ওপর। কিছু আলোচনা হয় অর্থ বিভাগে, বাজেটের সামগ্রিক আকার, আঙ্গিক ও দিকনির্দেশনার ওপর। জুন যতই ঘনিয়ে আসে, আলোচনার কলেবর ও রং তত দ্রুত বদলাতে থাকে। বাজেটসংক্রান্ত নিবন্ধ এবং আলোচনা সভার সারসংক্ষেপ প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে থাকে। এরপর যুক্ত হয় ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একদিকে বিভিন্ন আলোচনার তথ্যচিত্র, অন্যদিকে বাজেটের ওপর টক শো ও সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়।
সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এসব আলোচনা ও লেখালেখির একটি ছকবদ্বূ ধারা বা প্যাটার্নর্ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৭-১৮ বছর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি দল বা গোষ্ঠীভিত্তিক আলোচনার যে ধারা দেখেছিলাম, আজও সে ধারার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। নির্দিষ্ট সময় দিয়ে এনবিআর বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিশেষ করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে কর ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক এবং সম্ভাব্য কর প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনায় মিলিত হতো। আলোচনার সারবস্তু ও সুপারিশগুলো যথারীতি লিপিবদ্বূ করা হতো। বাজেটের সাধারণ বিষয় সম্পর্কে অর্থ বিভাগের কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো, তবে তার সংখ্যা ছিল নিতান্তই সীমিত। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না বললেই চলে। টিভিতে বাজেটের ওপর অনুষ্ঠানের সংখ্যা এবং কলেবর খুব সীমিত ছিল। আজকের তুলনায় বাজেটের বিষয়বস্তুও অনেকটা গোপনীয়তায় ঢাকা ছিল। এ কারণে হয়তোবা বাজেটের চমক এবং অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার আকর্ষণ আজকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শোনার জন্য দর্শক গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত।
বাজেটে এখন আর কোনো চমক থাকে না। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে সম্মত ফর্মুলা অনুযায়ী নির্মিত কর কাঠামো আগেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের তথ্য বাজেট পেশের বেশ আগেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে দেশের মানুষ জেনে যায়। এমনকি কোন কোন পণ্যের ওপর নতুন কর বসবে, করের সীমা কী হবে_এসব তথ্য দু-একটি ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে আগেভাগে প্রকাশ হয়ে পড়ে। বাকি থাকে শুধু তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা। তবে দেখেশুনে মনে হয় আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ধারা ও বিষয়বস্তু যেন আগে থেকেই সাজানো থাকবে। কারা কী বলবে, কারা কী করবে তা সন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরলে আগে থেকেই বলে দেওয়া যেতে পারে।
আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান থাকে। বিভিন্ন নামে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বহু সংগঠন রয়েছে। এর প্রায় সব প্রতিষ্ঠান হয় নিজেরাই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অথবা অন্য সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বক্তব্যের মূলসুর মোটামুটি একই রকম : যে করের ভার কোনো না কোনোভাবে তাদের ওপর পড়ে সেই করের হার কমাতে হবে, সুদের হার কমাতে হবে, কর প্রদান পদ্ধতি আরো সহজ করতে হবে, সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ কোনো কর সুবিধা দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর শক্তিশালী সেক্রেটারিয়েট রয়েছে বিধায় তারা দৃষ্টিনন্দন সংলেখ ও শ্রুতিমধুর বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। ব্যবসায়ী ছাড়া আরো যেসব গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে সোচ্চার থাকে তাঁরা হচ্ছেন অর্থনীতিবিদ, গবেষক, এনজিও সংগঠক, সাংবাদিক, সাধারণ বুদ্বিূজীবী ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপস্থাপকরা। বাজেট ঋতুতে এসব গোষ্ঠীর ব্যস্ততা এবং অল্প স্বল্প অর্থ উপার্জনের সুযোগ দৃশ্যমান হয়। রাজনীতিবিদরাও নিজস্ব উপায়ে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপনে সোচ্চার থাকেন। সব মিলে একটা সরগরম ভাব। কথা আর কথা। বক্তব্য আর বিবৃতি চারপাশ ছেয়ে ধরে।
রাজনীতিবিদদের বক্তব্য মূলত পার্টি লাইনে প্রবাহিত হয়। নতুন কোনো কর প্রচলিত হবে এ রকম কথা শোনা গেলে বিরোধী দলের সদস্যরা তাঁর বিরুদ্বেূ অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দেন। সরকারি দলের সদস্যরা এ ক্ষেত্রে সাধারণত চুপ থাকেন। দল কর্তৃক আদিষ্ট হলে প্রস্তাবের পক্ষে দু-চারটি কথা বলেন। বাজেট উপস্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের ছাত্র বা যুব সংগঠন বাজেটের পক্ষে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রা করে, স্লোগান তোলে। বাজেটকে উন্নয়ন রাজনীতির মহা দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিপরীত দিকে বিরোধী দলের সমরূপ অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরা বাজেটকে গরিব মারার মহাস্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে ফেস্টুন-ব্যানার সহযোগে শোভাযাত্রা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাস্তবে হয়তো তখনো এরা কেউ বাজেট দলিল দেখেনি। দেখার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। স্লোগান শোভাযাত্রা বিশ্বাসের ব্যাপার, অতএব বিশ্বাসের ওপর ভর করেই তারা এ কাজটা সম্পন্ন করে।
পার্লামেন্টের বক্তৃতা এবং সভা-সেমিনারে রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে একই ধারা পরিলক্ষিত হয়। সরকারি দলের সদস্যরা বাজেটের সমর্থনে জোরালো বক্তব্য দেন, বিরোধীদলীয় সদস্যরা বাজেট প্রস্তাবকে উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তবায়নযোগ্য ঘোষণা করেন, কর প্রস্তাবগুলো নাগরিকদের সর্বনাশ হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এ সুযোগে তাঁরা সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতা তুলে ধরেন, সফলতাগুলো সতর্কতার সঙ্গে ঢেকে রাখেন। কেউ কেউ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কালো টাকা সাদা করার বিপক্ষে বক্তব্য দেন। তবে এরূপ বক্তব্যে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের চেয়ে তীব্রতা বেশি আছে বলে মনে হয় না। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, শুধু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে। কালো টাকার বিরুদ্ধে গবেষণা সংস্থাগুলো এবং সিভিল সোসাইটির লোকরাই বেশি সোচ্চার।
নানা আলোচনা, নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে একদিন নির্বিঘ্নে সম্পূরক বাজেট-১২ পাস হয়ে গেল। এ নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে অর্থবহ কোনো বিতর্ক বা আলোচনা হলো না। তুমুল হৈচৈ হলো না। অথচ সম্পূরক বাজেটের প্রতিটি বরাদ্দ প্রস্তাবের ওপর বিশদ আলোচনা, বিতর্ক ও জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ সম্পূরক বরাদ্দ মানে মূল বাজেটে অনুমোদিত বরাদ্দের সীমা অতিক্রম করা। অননুমোদিত খরচ। কেন এই সীমাবহির্ভূত খরচ, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে সম্পূরক বরাদ্দের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবে এবং সীমা লঙ্ঘনকারী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এত আলোচনার মধ্যে সম্পূরক বাজেটের তেমন একটা উল্লেখ থাকে না বললেই চলে। এ বাজেট পাস হয়ে যায় দ্রুতগতিতে, সবচেয়ে নির্বিঘ্নে। বাজেট অনুষ্ঠানের একটি রং-বর্ণর্হীন অঙ্কের যবনিকা পতন হয় এমনিভাবে।
অবশেষে মূল বাজেটের ওপর সংসদে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্যরা। তবে বাজেটের আলোচনার চেয়ে নিজ এলাকার সমস্যার কথাই তাঁরা বলেন বেশি, এলাকার ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখার এটি এক বিরাট সুযোগ, যা তারা কখনো হাতছাড়া করেন না। এখানেও বক্তব্য নির্ধারিত ধারায় প্রবাহিত। সরকারি দলের সদস্যরা প্রশংসার স্রোত বইয়ে দেন, বিরোধী দলের সদস্যরা (যদি সংসদে উপস্থিত থাকেন) বাজেটের কঠোর সমালোচনা করেন। স্বতন্ত্র সদস্য মাঝামাঝি অবস্থানে থাকেন। সব আলোচনা ও বিতর্ক শেষে বাজেট, প্রস্তাবিত অর্থবিল সব ভোটে দেওয়া হয়। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সহজেই তা পাস হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্বা রেখে সরকারি দল ও অর্থমন্ত্রী নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আমরা সবার কথা শুনলাম, সবার মত জানলাম এবং সবশেষে শুধু নিজেদের মত মানলাম। বিজনেস এজ ইউজুয়াল।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একমাত্র সংসদই বাজেট অনুমোদন করতে পারে। এর দার্শনিক যৌক্তিকতা হৃদয়গ্রাহ্য। বাজেটে আয়ের যে বৃত্তান্ত দেওয়া হয় তা ট্যাঙ্ বা করনির্ভর। কর আদায় করেই সরকারকে তার আয় সংগ্রহ করতে হয় এবং ব্যয় সংস্থান করতে হয়। জনগণ বা নাগরিকদের কাছ থেকে এ ট্যাঙ্ আদায় করতে হবে। নাগরিকদের আয়ের একাংশ অর্থাৎ তাদের পকেটের টাকার একাংশ ট্যাঙ্রে মাধ্যমে সরকার তার পকেটে বা কোষাগারে নিয়ে যায়। এর জন্য যদি জনগণের সম্মতি বা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না থাকে, তবে তা লুণ্ঠনের পর্যায়ে পড়ে যাবে। যেহেতু এ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে প্রত্যেক নাগরিকের মত নেওয়া সম্ভব নয়, তাই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মতি নিয়ে ট্যাঙ্ ধার্যকরণ প্রক্রিয়াকে নৈতিক ও আইনানুগভাবে গ্রহণযোগ্য করা হয়। ট্যাঙ্রে মাধ্যমে আহরিত অর্থ কোন মন্ত্রণালয় বা সংস্থার মাধ্যমে কী কাজে ব্যয় করা হবে, তার রূপরেখাও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুশাসন বলে সংসদকে অনুমোদন করতে হয়। ব্যাপারটি খুবই যৌক্তিক।
সংসদে বাজেট উপস্থাপন একটি বড় মাপের বার্ষিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের অর্থবছর যেহেতু জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত, তাই অর্থবছর শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণত ১০ জুনের মধ্যে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হয় এবং ১ জুলাইয়ের আগে তা পাস করা হয়, সংসদে পাস হওয়া বাজেটের অনুসরণে ১ জুলাই থেকে ব্যয় নির্বাহ শুরু করা হয়। তবে বাজেট ঋতু শুরু হয় মধ্য এপ্রিল থেকে, চিঠিপত্র লেখালেখি এবং বিভিন্ন মহলের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে। কিছু আলোচনা হয় এনবিআরের উদ্যোগে মূলত সম্ভাব্য কর প্রস্তাবের ওপর। কিছু আলোচনা হয় অর্থ বিভাগে, বাজেটের সামগ্রিক আকার, আঙ্গিক ও দিকনির্দেশনার ওপর। জুন যতই ঘনিয়ে আসে, আলোচনার কলেবর ও রং তত দ্রুত বদলাতে থাকে। বাজেটসংক্রান্ত নিবন্ধ এবং আলোচনা সভার সারসংক্ষেপ প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে থাকে। এরপর যুক্ত হয় ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একদিকে বিভিন্ন আলোচনার তথ্যচিত্র, অন্যদিকে বাজেটের ওপর টক শো ও সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়।
সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এসব আলোচনা ও লেখালেখির একটি ছকবদ্বূ ধারা বা প্যাটার্নর্ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৭-১৮ বছর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি দল বা গোষ্ঠীভিত্তিক আলোচনার যে ধারা দেখেছিলাম, আজও সে ধারার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। নির্দিষ্ট সময় দিয়ে এনবিআর বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিশেষ করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে কর ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক এবং সম্ভাব্য কর প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনায় মিলিত হতো। আলোচনার সারবস্তু ও সুপারিশগুলো যথারীতি লিপিবদ্বূ করা হতো। বাজেটের সাধারণ বিষয় সম্পর্কে অর্থ বিভাগের কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো, তবে তার সংখ্যা ছিল নিতান্তই সীমিত। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না বললেই চলে। টিভিতে বাজেটের ওপর অনুষ্ঠানের সংখ্যা এবং কলেবর খুব সীমিত ছিল। আজকের তুলনায় বাজেটের বিষয়বস্তুও অনেকটা গোপনীয়তায় ঢাকা ছিল। এ কারণে হয়তোবা বাজেটের চমক এবং অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার আকর্ষণ আজকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শোনার জন্য দর্শক গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত।
বাজেটে এখন আর কোনো চমক থাকে না। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে সম্মত ফর্মুলা অনুযায়ী নির্মিত কর কাঠামো আগেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের তথ্য বাজেট পেশের বেশ আগেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে দেশের মানুষ জেনে যায়। এমনকি কোন কোন পণ্যের ওপর নতুন কর বসবে, করের সীমা কী হবে_এসব তথ্য দু-একটি ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে আগেভাগে প্রকাশ হয়ে পড়ে। বাকি থাকে শুধু তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা। তবে দেখেশুনে মনে হয় আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের ধারা ও বিষয়বস্তু যেন আগে থেকেই সাজানো থাকবে। কারা কী বলবে, কারা কী করবে তা সন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরলে আগে থেকেই বলে দেওয়া যেতে পারে।
আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান থাকে। বিভিন্ন নামে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বহু সংগঠন রয়েছে। এর প্রায় সব প্রতিষ্ঠান হয় নিজেরাই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অথবা অন্য সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বক্তব্যের মূলসুর মোটামুটি একই রকম : যে করের ভার কোনো না কোনোভাবে তাদের ওপর পড়ে সেই করের হার কমাতে হবে, সুদের হার কমাতে হবে, কর প্রদান পদ্ধতি আরো সহজ করতে হবে, সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ কোনো কর সুবিধা দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর শক্তিশালী সেক্রেটারিয়েট রয়েছে বিধায় তারা দৃষ্টিনন্দন সংলেখ ও শ্রুতিমধুর বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। ব্যবসায়ী ছাড়া আরো যেসব গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে সোচ্চার থাকে তাঁরা হচ্ছেন অর্থনীতিবিদ, গবেষক, এনজিও সংগঠক, সাংবাদিক, সাধারণ বুদ্বিূজীবী ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপস্থাপকরা। বাজেট ঋতুতে এসব গোষ্ঠীর ব্যস্ততা এবং অল্প স্বল্প অর্থ উপার্জনের সুযোগ দৃশ্যমান হয়। রাজনীতিবিদরাও নিজস্ব উপায়ে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপনে সোচ্চার থাকেন। সব মিলে একটা সরগরম ভাব। কথা আর কথা। বক্তব্য আর বিবৃতি চারপাশ ছেয়ে ধরে।
রাজনীতিবিদদের বক্তব্য মূলত পার্টি লাইনে প্রবাহিত হয়। নতুন কোনো কর প্রচলিত হবে এ রকম কথা শোনা গেলে বিরোধী দলের সদস্যরা তাঁর বিরুদ্বেূ অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দেন। সরকারি দলের সদস্যরা এ ক্ষেত্রে সাধারণত চুপ থাকেন। দল কর্তৃক আদিষ্ট হলে প্রস্তাবের পক্ষে দু-চারটি কথা বলেন। বাজেট উপস্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের ছাত্র বা যুব সংগঠন বাজেটের পক্ষে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রা করে, স্লোগান তোলে। বাজেটকে উন্নয়ন রাজনীতির মহা দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিপরীত দিকে বিরোধী দলের সমরূপ অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরা বাজেটকে গরিব মারার মহাস্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে ফেস্টুন-ব্যানার সহযোগে শোভাযাত্রা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাস্তবে হয়তো তখনো এরা কেউ বাজেট দলিল দেখেনি। দেখার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। স্লোগান শোভাযাত্রা বিশ্বাসের ব্যাপার, অতএব বিশ্বাসের ওপর ভর করেই তারা এ কাজটা সম্পন্ন করে।
পার্লামেন্টের বক্তৃতা এবং সভা-সেমিনারে রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে একই ধারা পরিলক্ষিত হয়। সরকারি দলের সদস্যরা বাজেটের সমর্থনে জোরালো বক্তব্য দেন, বিরোধীদলীয় সদস্যরা বাজেট প্রস্তাবকে উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তবায়নযোগ্য ঘোষণা করেন, কর প্রস্তাবগুলো নাগরিকদের সর্বনাশ হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এ সুযোগে তাঁরা সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতা তুলে ধরেন, সফলতাগুলো সতর্কতার সঙ্গে ঢেকে রাখেন। কেউ কেউ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কালো টাকা সাদা করার বিপক্ষে বক্তব্য দেন। তবে এরূপ বক্তব্যে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের চেয়ে তীব্রতা বেশি আছে বলে মনে হয় না। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, শুধু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে। কালো টাকার বিরুদ্ধে গবেষণা সংস্থাগুলো এবং সিভিল সোসাইটির লোকরাই বেশি সোচ্চার।
নানা আলোচনা, নানা অনুষ্ঠানের ফাঁকে একদিন নির্বিঘ্নে সম্পূরক বাজেট-১২ পাস হয়ে গেল। এ নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে অর্থবহ কোনো বিতর্ক বা আলোচনা হলো না। তুমুল হৈচৈ হলো না। অথচ সম্পূরক বাজেটের প্রতিটি বরাদ্দ প্রস্তাবের ওপর বিশদ আলোচনা, বিতর্ক ও জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ সম্পূরক বরাদ্দ মানে মূল বাজেটে অনুমোদিত বরাদ্দের সীমা অতিক্রম করা। অননুমোদিত খরচ। কেন এই সীমাবহির্ভূত খরচ, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে সম্পূরক বরাদ্দের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবে এবং সীমা লঙ্ঘনকারী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এত আলোচনার মধ্যে সম্পূরক বাজেটের তেমন একটা উল্লেখ থাকে না বললেই চলে। এ বাজেট পাস হয়ে যায় দ্রুতগতিতে, সবচেয়ে নির্বিঘ্নে। বাজেট অনুষ্ঠানের একটি রং-বর্ণর্হীন অঙ্কের যবনিকা পতন হয় এমনিভাবে।
অবশেষে মূল বাজেটের ওপর সংসদে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্যরা। তবে বাজেটের আলোচনার চেয়ে নিজ এলাকার সমস্যার কথাই তাঁরা বলেন বেশি, এলাকার ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখার এটি এক বিরাট সুযোগ, যা তারা কখনো হাতছাড়া করেন না। এখানেও বক্তব্য নির্ধারিত ধারায় প্রবাহিত। সরকারি দলের সদস্যরা প্রশংসার স্রোত বইয়ে দেন, বিরোধী দলের সদস্যরা (যদি সংসদে উপস্থিত থাকেন) বাজেটের কঠোর সমালোচনা করেন। স্বতন্ত্র সদস্য মাঝামাঝি অবস্থানে থাকেন। সব আলোচনা ও বিতর্ক শেষে বাজেট, প্রস্তাবিত অর্থবিল সব ভোটে দেওয়া হয়। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সহজেই তা পাস হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্বা রেখে সরকারি দল ও অর্থমন্ত্রী নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আমরা সবার কথা শুনলাম, সবার মত জানলাম এবং সবশেষে শুধু নিজেদের মত মানলাম। বিজনেস এজ ইউজুয়াল।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments