অসামান্য শওকত ওসমান by নাসির আহমেদ

দেশবরেণ্য কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৪ মে শনিবার। চোখের সামনে প্রাণবন্ত শওকত ওসমানের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আসে এখনও। যেন এখনই প্রতিধ্বনি হবে টেলিফোনে তার সেই বিখ্যাত সম্বোধন_ 'ভ্রাত! প্রাতঃস্মরণীয় হও।'


কথাশিল্পী শওকত ওসমান তার অনুজপ্রতিম কবি শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত সবাইকেই বড় স্নেহমাখা কণ্ঠে 'ভ্রাত' সম্বোধন করতেন। খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠতেন। সকালবেলা অনেককেই টেলিফোন করে কুশলবিনিময় করতেন, শেষ জীবনে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করতেই সম্ভবত অনেকের সঙ্গে কথা বলা তার অবলম্বন হয়ে উঠেছিল সঙ্গতার। আমার অন্তত তা-ই মনে হতো। কবি আহসান হাবীব এবং শওকত ওসমান ছিলেন ঘনিষ্ঠতম বন্ধু_ সেই তরুণ বয়সে কলকাতা থেকে, জীবন সায়াহ্নেও সেই বন্ধুত্ব ছিল অটুট। সেই সূত্রে প্রায়ই দৈনিক বাংলায় আসতেন। আশির দশকের শুরুতে সেখানে কর্মসূত্রে শওকত ভাইয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধা আর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার স্নেহে সিক্ত হয়েছি। গভীর শ্রদ্ধায় আজ সে ঋণ স্মরণ করি।
শওকত ওসমান আমাদের কথাসাহিত্যের সেই দ্রোহী প্রগতিশীল লেখক যিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন উদার মানবিক অসাম্প্রদায়িক একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার। সেই সংগ্রাম ছিল তার সৃজনশীল রচনায় যেমন, তেমনি ছিল তার মননশীল সৃষ্টিতেও। যে কাল পরিসরে পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগে (১৯১৭) অবিভক্ত বাংলার হুগলির সবলসিংহপুর গ্রামে তার জন্ম, সেই কালের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে শওকত ওসমানের দ্রোহের শক্তি, সাহস আর তীব্রতা অনুধাবন করতে সুবিধা হয় আমাদের। মুসলমানদের অধিকাংশ তখনও নিরক্ষরতাকবলিত। 'ইংরেজি শিক্ষা গোনাহের কাজ' বলে বিশ্বাস অনেকেরই। শিক্ষা নিলো মাদ্রাসামুখী। শওকত ওসমানও মাদ্রাসাতেই পাঠ নিয়েছেন প্রথম কয়েক বছর। শওকত ওসমান তো নন, শেখ আজিজুর রহমান। সেই মাদ্রাসাপড়ূয়া শেখ আজিজুর রহমান নাম বদল করে হলেন শওকত ওসমান। আলিয়া মাদ্রাসা ছেড়ে ইংরেজি মাধ্যমে প্রবেশিকা পাস করলেন (১৯৩৩) এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র হলেন। অর্থনীতিতে অনার্স করলেন, সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হয়ে দীর্ঘকাল জ্ঞানের আলো ছড়ালেন বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে এবং বাংলাদেশে।
দ্রোহী ব্যক্তিসত্তা ও লেখকসত্তায় সত্যিকার অর্থেই শওকত ওসমান অনন্য। আইয়ুবী সামরিক শাসনের তীব্র বৈরী পরিবেশে শাসক আর শাসিতের চিত্র কী অসাধারণ প্রতীকী গল্পেই না তুলে ধরেছেন 'ক্রীতদাসের হাসি' উপন্যাসে! ইতিহাসের মিথ চরিত্র আর সমকালীন বাস্তবতাকে 'ক্রীতদাসের হাসি'তে যে নৈপুণ্যে তিনি মিলিয়েছেন তা পঞ্চাশ দশকে ছিল দারুণ দুঃসাহস। 'জননী'র মতো উপন্যাস তো কেবল শওকত ওসমানের হাতেই রচিত হতে পারে। শওকত ওসমানের লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রখর সমাজ সচেতনতার মধ্যেই তিনি উইট আর হিউমারকে এমনভাবে চারিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিটি গল্প, উপন্যাস, এমনকি স্মৃতিকথা রসঘন সুখপাঠ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে শওকত ওসমান ছিলেন সদা সোচ্চার। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি পাকিস্তানি ভূতের আছর-লাগা এই প্রিয় দেশ ছেড়েই চলে যান। ১৯৮১ সালে ফিরে আসেন।
শেষ জীবনে ছন্দে অন্ত্যমিলে ৪ থেকে ৮ লাইনের মধ্যে 'শেখের শম্ভরা' নামে কিছু কবিতা তিনি লিখেছেন যেখানে স্বদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তার আত্মজীবনী 'রাহনামা'ও তাকে জানার জন্য এক চমকপ্রদ গ্রন্থ। তিনি কত ব্যথিত হতেন সাম্প্রদায়িকতায় তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ১৯৯৭ বা '৯৮ সালের কথা, শান্তিনগর মোড়ে কাশফি নামের বইয়ের দোকানে প্রায়ই শওকত ভাই আসতেন। তার একটি নতুন বই আমাকে উপহার দিতে গিয়ে লিখলেন, 'শ্রী শ্রী নাসির' তারপর কেটে দিয়ে বললেন, 'থুক্কু'। কিছু সময় চুপ করে থেকে লিখলেন_ 'নাসির/দুঃখ শুধু মনে এটাই জাগে/আমাদের মানুষ হবার আগে/হিন্দু কিংবা মুসলিম হওয়া লাগে_ প্রীতিসহ শওকত ওসমান'। এমন অসাধারণ উদার মানবতাবাদী মানুষটিকে কোন ভাষায় শ্রদ্ধা জানাই! সত্যি তার যোগ্য ভাষা আমার আয়ত্তে নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.