বহে কাল নিরবধি-অগ্নিগিরিতে কার্নিভ্যাল? by এম আবদুল হাফিজ
মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন কোনো নিয়মতান্ত্রিক পথে, শান্তিপূর্ণভাবে না এলেই শুধু তারা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা ভাবে এবং তা সহিংস এবং প্রচণ্ড হতে পারে। এমন একটি পরিবর্তনের বীজ উপ্ত হয় যখন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
শাসক শ্রেণী যখন অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও গণবিচ্ছিন্ন হয় তখনই একটি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে। শাসকরা যখন গণদুর্ভোগের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হতে থাকে প্রচণ্ড এক পরিবর্তনের ভূকম্পন অনুভূত হয়। এটাই বিপ্লব, যা তার অপ্রতিরোধ্য ধারায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
আধুনিক বিশ্বে বিপ্লব মানেই ফরাসি বিপ্লব, যা রেনেসাঁ উদ্ভাসিত ইউরোপীয় বিভাকেও ম্লান করে ধ্যান-ধারণার জগতকে অকল্পনীয়ভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপিত ফরাসিরা ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের অত্যাচারী সম্রাট ষোড়শ লুই-এর যদৃচ্ছ শাসনকে উৎখাত করে। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী দুজনেই বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয় এবং ১৭৯২ সালে বিপ্লবী তৎপরতার মধ্যেই প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। বলাবাহুল্য যে ফরাসি বিপ্লবের অংশ হিসেবেই প্রজাতন্ত্র, উদার গণতন্ত্র, একরাশ আধুনিক মতাদর্শ এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্ম ঘটে। ফরাসি বিপ্লবই এযাবৎকালের বিশ্বে শাসন পদ্ধতি ও তার শৈলীতে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। বিপ্লবকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টার দায়ে ৩০ হাজার ভিন্নপন্থী, যাদের মধ্যে অপরাধী ও নিরপরাধ দুই-ই ছিল প্রাণ হারায়।
তৎকালীন বিশ্বকে বিস্ময়াভিভূত করে এই বিপ্লব ঘটেছিল রাজতন্ত্রের পুরোদস্তুর এবং দমনমূলক আচরণের কারণে। তার সঙ্গে ছিল রাষ্ট্রের আর্থিক দেউলিয়াত্ব, যার মূলে ছিল অনর্থক যুদ্ধবিগ্রহ এবং অনিয়ম-অব্যবস্থা। সেই সময় ফ্রান্সে ফসলহানি হওয়ায় ছিল খাদ্যাভাব ও ক্ষুধা। ক্রমবর্ধমানভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজপ্রাসাদের সনি্নকটে ভুখা মিছিল হওয়ায় সম্রাজ্ঞী কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তাঁকে দেশে রুটির দুষ্প্রাপ্যতার কথা জানালে তিনি তাঁর আজও কৌতুক উদ্রেককারী উক্তিটি করেছিলেন, রুটি না থাকলে ওরা তো কেকও খেতে পারে।
আজকের অন্তত তৃতীয় বিশ্ব অঞ্চলের চালচিত্র কতকটা একই রকম, যা আমরা প্রায় প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানে না হলেও যুগে যুগে, দেশে দেশে বিপ্লবের এমন কারণগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাস। ১৯১৭ সালে রুশরা জার নিকোলাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। নিকোলাসও ছিলেন স্বেচ্ছাচারী এবং নিপীড়ক। তিনি নিজকে অন্তরঙ্গ বন্ধু-দোসর দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিলেন। এই দোসরদের প্রায় সবাই ছিল স্বার্থান্বেষী ও চাটুকার। অথচ সারা দেশে তখন বেকারত্ব, ক্ষুধা, খাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এই সব কিছুর পরিণতিতে রাশিয়ার অমন দুরবস্থা হয়েছিল। রাশিয়ায়ও বিপ্লব হয়েছিল একাধিক। ফরাসি বিপ্লবের মতো এখানেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠী এবং সময়ের পরিসরে বিপ্লব এখানেও প্রলম্বিত হয়েছিল।
১৯১৭ সালে রুশ সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির লেনিন নেতৃত্বাধীন বলশেভিকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। তার আগেই ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই যুদ্ধের একটি সরাসরি প্রভাব বিপ্লবের ওপরও পড়েছিল।
যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়, অনেক সৈন্যের প্রাণহানি এবং অর্থনীতির অবনতি বিপ্লবের সাফল্যে কার্যকরী হয়েছিল। ১৯১৭ সালেই জারের পতন হয় এবং তার মাত্র এক বছর পর জার নিকোলাসের সমগ্র পরিবারকে হত্যা করা হয়।
রাশিয়ার এই নৃশংস ঘটনার মাত্র ৩২ বছর পর চীনা বিপ্লব ঘটে। চীনে তখনকার একনায়কতন্ত্র, দমননীতি, ক্ষুধা, বেকারত্ব এবং খাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়। তৎকালীন চীনা স্বৈরশাসক জেনারেল চিয়াং-কাই-শেক তাঁর প্রতিপক্ষ চীনা কমিউনিস্টদের সমূলে ধ্বংস করতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেন। সে লক্ষ্যে তিনি একাধিক নির্মম, অনৈতিক এবং আইনবিরুদ্ধ পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। তাতে নিরীহ-নিরপরাধ চীনারাও প্রাণ হারায়। ১৯৩৫ সাল নাগাদ চিয়াংয়ের সেনাবাহিনী মাও-এর কমিউনিস্ট বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে প্রায় সফল হয়েছিল। কিন্তু মাও-জে-ডংয়ের কমিউনিস্ট আর্মি বিখ্যাত স্ট্র্যাটেজি লংমার্চের মাধ্যমে চিয়াংয়ের ছোবল থেকে রক্ষা পায়। আশির দশকে চীনের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের সময় পিএলএ-র বেশ কিছু জেনারেল বাংলাদেশে এসেছেন, যাঁদের মধ্যে লংমার্চে অংশগ্রহণকারী জেনারেলরাও ছিলেন। ছয় হাজার মাইল দীর্ঘ এই ঐতিহাসিক লংমার্চ, যা আজকের প্রযুক্তিগত অর্জনের যুগে অবিশ্বাস্য মনে হবে_সেই কৌশলগত ম্যান্যুভারই (সধহবাঁৎব) চীনা বিপ্লবকে বাঁচিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিয়াং-কাই-শেখ আবারও আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের সাহায্য, সমর্থন ও সহযোগিতায় কমিউনিস্টদের আক্রমণ করে। প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে কমিউনিস্টরা চিয়াংকে পরাজিত করতে সমর্থ হয় এবং চিয়াং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে তাইওয়ানে পালিয়ে যান। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পিএলএ (পিপলস লিবারেশন আর্মি) পিকিংয়ে (এখন বেইজিং) বিজয়ীবেশে প্রবেশ করে। ১ অক্টোবরে মাও পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠিত করেন।
চীনা জনগণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানে তারা দেশকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ রূপে দেখার গৌরব ও তৃপ্তি লাভ করে। ইরানেও পরিবর্তন এসেছিল একাধিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মোসাদ্দেক দেশের জনগণের সাহায্যে বিদ্রোহ করলে প্রথম বিপ্লবটি সংঘটিত হয়। ফলে ইরানের অধিপতি রেজা শাহ পাহলভি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বিপ্লব স্থায়ী হতে পারেনি। দেশটির জ্বালানি সম্পদে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ স্বার্থ জড়িত থাকায় তাদেরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের কিছু বিশ্বাসঘাতক সামরিক অফিসারের সাহায্য-সহযোগিতায় মোসাদ্দেককে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকায়। মোসাদ্দেকের অভ্যুত্থানে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতেমি নিহত হন এবং শাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়।
ক্ষমতা পুনরুদ্ধার হলে শাহ আগের চেয়েও নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। শাহর গুপ্ত পুলিশ কুখ্যাত সাভাক শাহর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার, অপহরণ এবং গুমে প্রবৃত্ত হয়। এ অবস্থায় ১৯৬২ সালে ইমাম খোমেনি দৃশ্যপটে উপনীত হন এবং অতিসত্বর জনগণের নেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জনগণের পক্ষ অবলম্বন করায় ১৯৬৪ সালে খোমেনি গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে ইরাকে নির্বাসিত করা হয়। সেখান থেকে ইমাম খোমেনি প্যারিসে চলে যান। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি নির্বাসনে থাকেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতেই গণরোষের চাপে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি শাহ সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য হন। সর্বজনগ্রাহ্যভাবে এটি ছিল একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কলঙ্কজনক পরিণতি। শাহের নির্বাসনে আরো কলঙ্ককর মৃত্যু ছিল সব দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসনের জন্য শিক্ষা।
অতঃপর একই বছরের ১ ফেব্রুয়ারিতে খোমেনি লাখ লাখ মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে তেহরানে প্রত্যাবর্তন করেন। ইরানের নতুন শাসকগোষ্ঠী স্বভাবতই শাহের শাসনামলের সব অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝোলায়, যাতে ইরানি সমাজে একটি স্থায়ী বিশোধনে তা কিছুটা অবদান রাখতে পারে। সব বিপ্লবই আসে জনগণের সীমাহীন ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, যেমনটি হয়েছিল ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং ইরানে।
আজ বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে ইতিহাসের উলি্লখিত এই অভ্যুত্থানগুলোর প্রাক-বিস্ফোরণ উপসর্গগুলো বিরাজ করছে। সেসব দেশে আলবত কোনো অভ্যুত্থান ঘটার সব রকম উপাদানই আছে। আছে ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও সম্পদ থেকে লুটপাট, সামাজিক ও রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা। আছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বৈষম্য, আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এই মাত্র কয়েক দিন আগেই আরব বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর রাষ্ট্র তিউনিসিয়ায় অবিশ্বাস্য একটি অভ্যুত্থান হয়, যেখানে দেশের প্রেসিডেন্টকে গণরোষের ভয়ে পলায়ন করতে হয়।
সামরিক ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে শিখেছি যে বুদ্ধিমানরা অপরের ভুল থেকে শেখে। কিন্তু যারা অপরের ভুল থেকেও শেখে না তাদের ইতিহাস কিভাবে মূল্যায়ন করবে! আমাদের দেশপ্রেমিক ও সচেতন সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তাবিদরা এন্তার আমাদের প্রাক-বিপ্লব উপাদান ও উপসর্গগুলোর কথা লিখে বা বলে চলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালনায় যাদের দায়দায়িত্ব তাদের ঘুম কবে ভাঙবে। তারা কি একটি অগি্নগিরির চূড়ায় বসে কার্নিভালেই লিপ্ত থাকবে?
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
আধুনিক বিশ্বে বিপ্লব মানেই ফরাসি বিপ্লব, যা রেনেসাঁ উদ্ভাসিত ইউরোপীয় বিভাকেও ম্লান করে ধ্যান-ধারণার জগতকে অকল্পনীয়ভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপিত ফরাসিরা ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের অত্যাচারী সম্রাট ষোড়শ লুই-এর যদৃচ্ছ শাসনকে উৎখাত করে। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী দুজনেই বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয় এবং ১৭৯২ সালে বিপ্লবী তৎপরতার মধ্যেই প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। বলাবাহুল্য যে ফরাসি বিপ্লবের অংশ হিসেবেই প্রজাতন্ত্র, উদার গণতন্ত্র, একরাশ আধুনিক মতাদর্শ এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্ম ঘটে। ফরাসি বিপ্লবই এযাবৎকালের বিশ্বে শাসন পদ্ধতি ও তার শৈলীতে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। বিপ্লবকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টার দায়ে ৩০ হাজার ভিন্নপন্থী, যাদের মধ্যে অপরাধী ও নিরপরাধ দুই-ই ছিল প্রাণ হারায়।
তৎকালীন বিশ্বকে বিস্ময়াভিভূত করে এই বিপ্লব ঘটেছিল রাজতন্ত্রের পুরোদস্তুর এবং দমনমূলক আচরণের কারণে। তার সঙ্গে ছিল রাষ্ট্রের আর্থিক দেউলিয়াত্ব, যার মূলে ছিল অনর্থক যুদ্ধবিগ্রহ এবং অনিয়ম-অব্যবস্থা। সেই সময় ফ্রান্সে ফসলহানি হওয়ায় ছিল খাদ্যাভাব ও ক্ষুধা। ক্রমবর্ধমানভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজপ্রাসাদের সনি্নকটে ভুখা মিছিল হওয়ায় সম্রাজ্ঞী কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তাঁকে দেশে রুটির দুষ্প্রাপ্যতার কথা জানালে তিনি তাঁর আজও কৌতুক উদ্রেককারী উক্তিটি করেছিলেন, রুটি না থাকলে ওরা তো কেকও খেতে পারে।
আজকের অন্তত তৃতীয় বিশ্ব অঞ্চলের চালচিত্র কতকটা একই রকম, যা আমরা প্রায় প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এখানে না হলেও যুগে যুগে, দেশে দেশে বিপ্লবের এমন কারণগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাস। ১৯১৭ সালে রুশরা জার নিকোলাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। নিকোলাসও ছিলেন স্বেচ্ছাচারী এবং নিপীড়ক। তিনি নিজকে অন্তরঙ্গ বন্ধু-দোসর দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিলেন। এই দোসরদের প্রায় সবাই ছিল স্বার্থান্বেষী ও চাটুকার। অথচ সারা দেশে তখন বেকারত্ব, ক্ষুধা, খাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এই সব কিছুর পরিণতিতে রাশিয়ার অমন দুরবস্থা হয়েছিল। রাশিয়ায়ও বিপ্লব হয়েছিল একাধিক। ফরাসি বিপ্লবের মতো এখানেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠী এবং সময়ের পরিসরে বিপ্লব এখানেও প্রলম্বিত হয়েছিল।
১৯১৭ সালে রুশ সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির লেনিন নেতৃত্বাধীন বলশেভিকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। তার আগেই ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাই যুদ্ধের একটি সরাসরি প্রভাব বিপ্লবের ওপরও পড়েছিল।
যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়, অনেক সৈন্যের প্রাণহানি এবং অর্থনীতির অবনতি বিপ্লবের সাফল্যে কার্যকরী হয়েছিল। ১৯১৭ সালেই জারের পতন হয় এবং তার মাত্র এক বছর পর জার নিকোলাসের সমগ্র পরিবারকে হত্যা করা হয়।
রাশিয়ার এই নৃশংস ঘটনার মাত্র ৩২ বছর পর চীনা বিপ্লব ঘটে। চীনে তখনকার একনায়কতন্ত্র, দমননীতি, ক্ষুধা, বেকারত্ব এবং খাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়। তৎকালীন চীনা স্বৈরশাসক জেনারেল চিয়াং-কাই-শেক তাঁর প্রতিপক্ষ চীনা কমিউনিস্টদের সমূলে ধ্বংস করতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেন। সে লক্ষ্যে তিনি একাধিক নির্মম, অনৈতিক এবং আইনবিরুদ্ধ পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। তাতে নিরীহ-নিরপরাধ চীনারাও প্রাণ হারায়। ১৯৩৫ সাল নাগাদ চিয়াংয়ের সেনাবাহিনী মাও-এর কমিউনিস্ট বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে প্রায় সফল হয়েছিল। কিন্তু মাও-জে-ডংয়ের কমিউনিস্ট আর্মি বিখ্যাত স্ট্র্যাটেজি লংমার্চের মাধ্যমে চিয়াংয়ের ছোবল থেকে রক্ষা পায়। আশির দশকে চীনের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের সময় পিএলএ-র বেশ কিছু জেনারেল বাংলাদেশে এসেছেন, যাঁদের মধ্যে লংমার্চে অংশগ্রহণকারী জেনারেলরাও ছিলেন। ছয় হাজার মাইল দীর্ঘ এই ঐতিহাসিক লংমার্চ, যা আজকের প্রযুক্তিগত অর্জনের যুগে অবিশ্বাস্য মনে হবে_সেই কৌশলগত ম্যান্যুভারই (সধহবাঁৎব) চীনা বিপ্লবকে বাঁচিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিয়াং-কাই-শেখ আবারও আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের সাহায্য, সমর্থন ও সহযোগিতায় কমিউনিস্টদের আক্রমণ করে। প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে কমিউনিস্টরা চিয়াংকে পরাজিত করতে সমর্থ হয় এবং চিয়াং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে তাইওয়ানে পালিয়ে যান। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পিএলএ (পিপলস লিবারেশন আর্মি) পিকিংয়ে (এখন বেইজিং) বিজয়ীবেশে প্রবেশ করে। ১ অক্টোবরে মাও পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠিত করেন।
চীনা জনগণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানে তারা দেশকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ রূপে দেখার গৌরব ও তৃপ্তি লাভ করে। ইরানেও পরিবর্তন এসেছিল একাধিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মোসাদ্দেক দেশের জনগণের সাহায্যে বিদ্রোহ করলে প্রথম বিপ্লবটি সংঘটিত হয়। ফলে ইরানের অধিপতি রেজা শাহ পাহলভি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বিপ্লব স্থায়ী হতে পারেনি। দেশটির জ্বালানি সম্পদে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ স্বার্থ জড়িত থাকায় তাদেরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের কিছু বিশ্বাসঘাতক সামরিক অফিসারের সাহায্য-সহযোগিতায় মোসাদ্দেককে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকায়। মোসাদ্দেকের অভ্যুত্থানে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতেমি নিহত হন এবং শাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হয়।
ক্ষমতা পুনরুদ্ধার হলে শাহ আগের চেয়েও নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। শাহর গুপ্ত পুলিশ কুখ্যাত সাভাক শাহর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার, অপহরণ এবং গুমে প্রবৃত্ত হয়। এ অবস্থায় ১৯৬২ সালে ইমাম খোমেনি দৃশ্যপটে উপনীত হন এবং অতিসত্বর জনগণের নেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জনগণের পক্ষ অবলম্বন করায় ১৯৬৪ সালে খোমেনি গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে ইরাকে নির্বাসিত করা হয়। সেখান থেকে ইমাম খোমেনি প্যারিসে চলে যান। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি নির্বাসনে থাকেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতেই গণরোষের চাপে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি শাহ সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য হন। সর্বজনগ্রাহ্যভাবে এটি ছিল একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কলঙ্কজনক পরিণতি। শাহের নির্বাসনে আরো কলঙ্ককর মৃত্যু ছিল সব দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসনের জন্য শিক্ষা।
অতঃপর একই বছরের ১ ফেব্রুয়ারিতে খোমেনি লাখ লাখ মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে তেহরানে প্রত্যাবর্তন করেন। ইরানের নতুন শাসকগোষ্ঠী স্বভাবতই শাহের শাসনামলের সব অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝোলায়, যাতে ইরানি সমাজে একটি স্থায়ী বিশোধনে তা কিছুটা অবদান রাখতে পারে। সব বিপ্লবই আসে জনগণের সীমাহীন ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, যেমনটি হয়েছিল ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং ইরানে।
আজ বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে ইতিহাসের উলি্লখিত এই অভ্যুত্থানগুলোর প্রাক-বিস্ফোরণ উপসর্গগুলো বিরাজ করছে। সেসব দেশে আলবত কোনো অভ্যুত্থান ঘটার সব রকম উপাদানই আছে। আছে ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও সম্পদ থেকে লুটপাট, সামাজিক ও রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা। আছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বৈষম্য, আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এই মাত্র কয়েক দিন আগেই আরব বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর রাষ্ট্র তিউনিসিয়ায় অবিশ্বাস্য একটি অভ্যুত্থান হয়, যেখানে দেশের প্রেসিডেন্টকে গণরোষের ভয়ে পলায়ন করতে হয়।
সামরিক ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসেবে শিখেছি যে বুদ্ধিমানরা অপরের ভুল থেকে শেখে। কিন্তু যারা অপরের ভুল থেকেও শেখে না তাদের ইতিহাস কিভাবে মূল্যায়ন করবে! আমাদের দেশপ্রেমিক ও সচেতন সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তাবিদরা এন্তার আমাদের প্রাক-বিপ্লব উপাদান ও উপসর্গগুলোর কথা লিখে বা বলে চলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালনায় যাদের দায়দায়িত্ব তাদের ঘুম কবে ভাঙবে। তারা কি একটি অগি্নগিরির চূড়ায় বসে কার্নিভালেই লিপ্ত থাকবে?
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments