কালের আয়নায়-রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষে গোটেনবার্গে দুটি দিন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
হঠাৎ চোখে পড়ল একটি দৃশ্য। সৌদি আরবের একদল তরুণ-তরুণী। তরুণীদের সকলে হিজাব পরেছে। কেউ কেউ শরীর-ঢাকা বোরকাও পরেছে। কিন্তু উদ্দাম হয়ে তরুণীরা তরুণদের হাত ধরে নাচছে। সঙ্গে বাজছে ওয়েস্টার্ন মিউজিক
এ বছর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষে মে মাসজুড়েই সারাবিশ্বে উৎসব চলছে।
এ বছর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষে মে মাসজুড়েই সারাবিশ্বে উৎসব চলছে।
প্রমাণিত হলো, তিনি সত্যি ছিলেন বিশ্বকবি, বিশ্বমানবতার কবি। জাতীয়তার ক্ষুদ্র বন্ধনে তাকে বেঁধে রাখা যায় না। তবু জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। কারণ, আমাদের জাতি-পরিচয় নিয়েই তিনি জন্মেছেন এবং আমাদের ভাষাতেই তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করে সেই সাহিত্যকে, সেই ভাষাকে বিশ্বের সব সাহিত্য ও ভাষার নাড়ির সঙ্গে যুক্ত করে গেছেন, তাকে পুনর্নির্মাণ ও সমৃদ্ধ করেছেন।
যে সুইডেনের নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে প্রথম তাকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করেছিলেন, সেই সুইডেনেও রবীন্দ্রনাথ যে কত জনপ্রিয়, এবার সে সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো। সুইডেনের গোটেনবার্গ একটি সুন্দর ছোট শহর। রাজধানী স্টকহোম থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে। এই গোটেনবার্গের টেগোর সেলস্কপ (টেগোর সোসাইটি) থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তাদের আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মোৎসবের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। যদিও লন্ডনে এখন অসংখ্য অনুষ্ঠান চলছে। সেসব রেখে সুইডেনে ছুটেছিলাম, সেখানে সুইডিশ ও দুই বাংলার বাঙালিরা মিলে কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানায় এবং স্মরণ করে তা দেখার আগ্রহ নিয়ে।
স্টকহোমে থাকেন আমার অনুজপ্রতিম বল্পুব্দ খালেদ হাশেম। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ঢাকায় দাপুটে ছাত্রনেতা ছিলেন। আর সালেহ মোস্তফা জামিল থাকেন গোটেনবার্গে। দু'জনই টেগোর সেলস্কপের সঙ্গে যুক্ত। দু'জনই আমাকে জানিয়েছিলেন, এবার রবীন্দ্র জন্মোৎসবের সেরা অনুষ্ঠানটি হবে গোটেনবার্গে। ভারত এবং বাংলাদেশের দুই রাষ্ট্রদূতই হাজির থাকবেন এ অনুষ্ঠানে। তারা আসবেন রাজধানী স্টকহোম থেকে। তা ছাড়া গোটেনবার্গের মেয়র এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। তিনিও রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
আগেই আমার সহৃদয় পাঠকদের জানিয়ে রাখি, আমার এ লেখাটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয় (গত সপ্তাহের সমকালেই আমি কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা লেখা লিখেছি)। আমার এই লেখাটা রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষের উৎসব উপলক্ষ করে দেশভ্রমণ এবং সেই ভ্রমণে অর্জিত কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে। এ অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দের ভাগ আমার পাঠকদেরও দিতে চাই।
আজকাল ইউরোপে বিমানে যাতায়াত সুলভ ও সহজ হয়ে গেছে। ছোট ছোট অসংখ্য এয়ারলাইন্স হয়েছে, যারা অকল্পনীয় সস্তায় টিকিট বিক্রি করে। লন্ডন থেকে ইউরোপের কোনো শহরে যেতে যেখানে বড় কোনো এয়ারলাইন্সের প্লেনের ভাড়া দেড়শ' থেকে দুইশ' এবং কখনও কখনও তিনশ'-সাড়ে তিনশ' পাউন্ডের মতো, সেখানে ছোট এয়ারলাইন্সের প্লেনের ভাড়া পঁচিশ-ত্রিশ পাউন্ডের মতো। কখনও কখনও পাঁচ পাউন্ডেও টিকিট পাওয়া যায়। তবে তা কোথাও যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে কিনতে হয়। নইলে পাওয়া যায় না।
রায়ান এয়ারলাইন্স, ইজি জেট ইত্যাদি হলো এ ধরনের ছোট এয়ারলাইন্স। আমি গোটেনবার্গে যেতে রায়ান এয়ারলাইন্সের টিকিট পেলাম ২৬ পাউন্ডে। তবে প্লেন ছাড়বে আমার বাড়ির কাছের হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে নয়, বেশ দূরের স্টানস্টেড এয়ারপোর্ট থেকে। ভাড়া করা মিনি ক্যাবে হিথ্রো যেতে আমার যেখানে লাগে ত্রিশ পাউন্ড; সেখানে স্টানস্টেডে যেতে লাগবে ষাট পাউন্ড। অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। তবু তাতেও লাভ। রায়ান এয়ারেই গোটেনবার্গে যাত্রা করলাম।
৭ মে শনিবার সকাল ৭টায় ফ্লাইট। ৫টায় বাড়ি থেকে বেরোতে হলো। দীর্ঘ পথ। সামারের সকাল। মেঘ ও কুয়াশামুক্ত আকাশ। আবহাওয়াও খুব প্লেজেন্ট। যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পেঁৗছলাম। প্লেনে চেপে মনে পড়ল, এসব প্লেনে খাবার ফ্রি নয়। দাম দিয়ে কিনতে হয়। এমনকি এক গ্গ্নাস পানিও। অত ভোরে ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে লাগল কুড়ি পাউন্ড। বাইরে যার দাম হতো বড়জোর সাত কি দশ পাউন্ড। তবু বড় এয়ারলাইন্সের প্লেনে চড়লে যে ভাড়ার টাকা গুনতে হতো, তার তুলনায় আমার এই সর্বমোট খরচও কম। তাতেই স্বস্তি পেলাম।
রায়ান এয়ারের প্লেনে চেপে দেশে জিএমজির ছোট প্লেনে চেপে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে পড়েছিল। তবে রায়ান বা ইজি জেটের প্লেনগুলো জিএমজির প্লেনের চেয়ে বড়। কোনো কোনোটি বাংলাদেশ বিমানের আগের সেকোর ফ্রেন্ডশিপ প্লেনের মতো, কোনো কোনোটি ছোট বোয়িং। মেঘমুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়ে পৌনে দু'ঘণ্টায় লন্ডন থেকে গোটেনবার্গে পেঁৗছে গেছি।
সকাল ১০টার দিকে গোটেনবার্গে পেঁৗছেছি। ইউরোপের ঘড়ি ব্রিটেনের ঘড়ির চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে। শহরে পেঁৗছেই শুনি, সিটি-মেয়র আমাদের সম্মানে দুপুরেই এক ভোজসভার আয়োজন করেছেন। আমরা মানে সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং বলাবাহুল্য আমি। রোদা সেতারি নামে যে প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক ভবনটিতে এই ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল, তার বয়স তিনশ' বছরের মতো। সংরক্ষিত ভবন। দেশি-বিদেশি ডিগনিটারিজ গোটেনবার্গে এলে তাদের সম্মান জানানোর জন্য এই ভবনে আনা হয়।
প্রথমবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে জর্জ বুশ জুনিয়র সুইডেনে এলে এই রোদা সেতারি ভবনে এসেছিলেন। এই ভবনের ভোজকক্ষে আমরা যখন টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে বসতে যাচ্ছি, তখন মেয়র আনেত সারমানের সঙ্গে বসা এক সুইডিশ মহিলা আমাকে বললেন, আপনি যে চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন, হয়তো এই চেয়ারেই প্রেসিডেন্ট বুশ বসেছিলেন। আমি সবিনয়ে বলেছি, তাতে আমি গৌরব বোধ করছি না। মহিলা বললেন, কেন, আপনি বুশবিরোধী? বলেছি, আমি কারও বিরোধী নই। কিন্তু বুশ তার কার্যকলাপ দ্বারা সারাবিশ্বে যে ঘৃণা সৃষ্টি করে গেছেন, তার সম্পর্কে সেই ঘৃণার কিছুটা আমিও পোষণ করি।
মহিলা আমার কথায় রাগ করলেন না। বললেন, আমি বুশকে ঘৃণা করি না। কিন্তু তার সব কাজের সমর্থক নই। তাকে মানুষ ঘৃণা করে কি-না জানি না, কিন্তু তিনি মানুষকে কতটা ভয় করেন, তার গোটেনবার্গ সফরকালে আমি তা দেখেছি। এই সফরকালে তিনি মাত্র প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। গালফ ওয়ার তখনও শুরু করেননি। তখনও গোটেনবার্গ সফরকালে তাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা আমি লক্ষ্য করেছি। তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বিরাট মার্কিন সেনাদল গোটেনবার্গে এসেছিল। ওই যে সামনে রাস্তা এবং দু'পাশে গাছের সারি দেখছেন; এই গাছের সারির প্রত্যেকটির নিচে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধাবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রণাঙ্গন পরিদর্শন করছেন।
আলোচনাটি ঘুরে গেল টেবিলে খাবার পরিবেশিত হওয়ায়। খেতে বসে সবাই সুইডিশ একাডেমী থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলেন। এই আলোচনার এক ফাঁকে আগের মহিলা (তিনিও গোটেনবার্গের গণ্যমান্য নাগরিক, তার নামটা তখন টুকে রাখতে ভুলে গেছি) বললেন, আমরা শুধু একজন বাঙালি রবীন্দ্রনাথকেই নোবেল প্রাইজ দিইনি, আরও দুই বাঙালি ড. অমর্ত্য সেন এবং ড. ইউনূসকেও দিয়েছি।
আমি এবারও সবিনয়ে বলেছি, ড. অমর্ত্য সেনের নামের সঙ্গে দ্বিতীয় নামটা যোগ না করাই ভালো। একজন নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তার যথার্থ যোগ্যতা এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত অবদানের জন্য। দ্বিতীয়জনের উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো যোগ্যতা ও অবদান আবিষ্কার করতে না পেরে আমেরিকার হোয়াইট হাউসের তৎকালীন বাসিন্দাদের চাপে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিতে হয়েছে, যে শান্তির ব্যাপারে তার কোনো অবদান নেই।
মহিলা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আপনাদের এই নোবেল লরিয়েটের ওপর রুষ্ট? বলেছি, রুষ্ট নই, তবে এই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তিনি যে অসাধু রাজনীতির খেলা শুরু করেছিলেন, তাতে অনেকের মতো আমিও তার ওপর বিরক্ত। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তা পদে মেয়াদ শেষেও থাকার জেদ ধরে তিনি শুধু নিজেকেই নিজে ছোট করেছেন, আন্তর্জাতিক পুরস্কারটির সম্মান রাখতে পারেননি।
এই ভোজসভাতেই আমার প্রাথমিক পরিচয় সুইডেনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অশোক সাতজুনেহর এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারের সঙ্গে। অশোক বাবু দিলি্লর লোক। সুদর্শন। চুলে মাত্র সাদা অংশ দেখা দিয়েছে। এক সময় ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। দেখলাম রাজনীতি, কূটনীতি থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছু সম্পর্কেই ভালো জ্ঞান রাখেন। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কেও। রসিকতাতেও তিনি পারদর্শী। তার চেয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকার বয়সে ছোট, মাত্র ছয় মাস আগে সুইডেনে এসেছেন, অশোক সাতজুনেহর এসেছেন আট মাস আগে। অশোক বাবু রসিকতা করে বললেন, আমি এ দেশে আমার মাননীয় বন্ধুর চেয়ে মাত্র দু'মাসের সিনিয়র। তিনি স্টকহোমে এক পেল্লায় বাড়িতে থাকেন। কিন্তু থাকেন একা। এখনও স্ত্রীকে আনতে পারেননি। একজন তাকে হেসে জিজ্ঞাসা করেছেন, আর আপনি? অশোক বাবু হাসিমুখে বলেছেন, আমি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। তবে সঙ্গে স্ত্রী আছেন। তার কথা শুনে সকলে হেসে উঠেছেন।
ভোজ শেষে অশোক বাবু বললেন, 'এই ভবনের পেছনেই চমৎকার লেক। চলুন আমরা লেকের দিকের খোলা বারান্দায় গিয়ে একটু রোদ পোহাই।' গোটেনবার্গে আজ চমৎকার আবহাওয়া। ঠাণ্ডা চলে গেছে, কিছুটা গরম পড়েছে। অথচ কয়েকদিন আগেই বরফ পড়েছিল। মেয়র আনেত সারমান বললেন, আমাদের দেশে ওয়েদার খুবই আনপ্রেডিকটেবল।
দুপুরের ভোজের পরই সরাসরি সম্মেলনস্থলে যেতে হলো। বিরাট কমিউনিটি হল। ভেতরে লাইব্রেরি থেকে দোকানপাট, ব্যায়ামাগার আছে। অনুষ্ঠানটি হয়েছে চমৎকার ছিমছাম। আলোচনা পর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম বক্তৃতা দিয়েছেন ৪৫ মিনিট, রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ইংরেজ কবি, বিশেষ করে এজরা পাউন্ড, টিএস এলিয়ট, ইয়েটস প্রমুখের কথা তুলে রবীন্দ্র-সাহিত্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা বলব। হালে যেসব তরুণ বাঙালি-কূটনীতিকদের বিদেশে রাষ্ট্রদূত, উপরাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করতে দেখছি, তারা বিদেশে অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলেই মনে হয়। লন্ডনে উপরাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকী, ইতালির রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, জার্মানির রাষ্ট্রদূত মাসুদ মান্নান, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম প্রমুখ যাদের দেখেছি, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের যোগ্য এবং সম্ভাবনাময় কূটনীতিকদের প্রতীক বলেই তাদের মনে হয়েছে। গোটেনবার্গে গাউসুল আজম সরকারের বক্তৃতা শুনে তার বিদেশি শ্রোতারাও খুশি হয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রদূত তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশ ও ভারত কর্তৃক যুক্তভাবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষের উৎসব পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন।
আগেই বলেছি, অনুষ্ঠানটি ছিল সুন্দর এবং ছিমছাম। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অগুনতি সুইডিশ নারী-পুরুষ তো ছিলেনই, অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে অংশগ্রহণ করেছেন বহু সুইডিশ তরুণী। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতা আবৃত্তি করেছেন রবিন আন্ডারসন এবং ইংরিদ সেলমান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন শাড়ি পরে ইংরিদ সুন্দমার। মেয়র আনেত সারমানও বক্তব্য রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের ওপর। রবীন্দ্রনাথের জীবনভিত্তিক একটি ডকুমেন্টারি ছবি অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। এটি সম্পাদনা করেছেন সালেহ মোস্তফা জামিল। টেগোর সেলস্কপের সঙ্গে তিনি যুক্ত। বাঙালি মেয়ে জেনিফার মনসুর অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেছেন এবং সঙ্গীতশিল্পী দিলরুবা জামিল একাই অর্ধডজনের মতো সঙ্গীত পরিবেশন করে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলেছিলেন। শরিফ আহমদের তবলা এবং শোভন পালের বেহালা বাদন অনুষ্ঠানটিকে আরও প্রাণবন্ত করেছে।
৭ মে শনিবার একটা চমৎকার দিন ছিল আমার জন্য গোটেনবার্গে। পরের দিনটাও ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। জামিল দম্পতির সঙ্গে সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। এ সময় একটা মজার দৃশ্য চোখে পড়েছে। শহরের হারবারের কাছে একটা উঁচু পাহাড়। তার চূড়ায় উঠলে নিচে সারা শহর দেখা যায়। সোনালি রোদের দিন, গরমের আমেজ মাখানো আবহাওয়া সারা শহরের নানা বয়সের লোকেরা সেদিন এই পাহাড়ে উঠে এসেছে। পিকনিক, গান-বাজনা, রৌদ্রস্নান সবকিছু চলছে পাহাড় চূড়ায়।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটি দৃশ্য। জামিলই ডেকে আমাকে দৃশ্যটা দেখাল। সৌদি আরবের একদল তরুণ-তরুণী। তরুণীদের সকলে হিজাব পরেছে। কেউ কেউ শরীর-ঢাকা বোরকাও পরেছে। কিন্তু উদ্দাম হয়ে তরুণীরা তরুণদের হাত ধরে নাচছে। সঙ্গে বাজছে ওয়েস্টার্ন মিউজিক।
জামিলকে বললাম, ঢাকা থেকে মুফতি আমিনী গংকে এখানে ধরে এনে দৃশ্যটা দেখানো দরকার। আমরা দৃশ্যটা ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার জন্য যেই ক্যামেরা তাক করেছি অমনি নৃত্য বন্ধ হয়ে গেল, তরুণীরা তরুণদের কাছ থেকে দূরে সরে বসল।
গোটেনবার্গ থেকে লন্ডনে ফিরেছি ৯ মে সোমবার সকালে। কিন্তু তার আগের সন্ধ্যাটি অনেকদিন আমার মনে থাকবে। ফারজানা ছন্দ এবং তার স্বামী আহার পর্বের সঙ্গে এক সান্ধ্য গানের আসর বসিয়েছিলেন তাদের বাসায়। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই একেবারে তরুণ, দু'জনেই চিত্রশিল্পী, বিদেশে এসে ফারজানা অন্য পেশা শেখার ছাত্রী। তাকে দেখলে মনে হয় না, সে ছোট ছোট তিনটি কন্যার জননী। মধ্যরাত পর্যন্ত কেটেছে খাওয়া-দাওয়া আর গান-বাজনায়। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল সুইডেনের গোটেনবার্গে নয়, বাংলাদেশের ঢাকা শহরেই আছে।
এ তো হরষের মাঝে বিষাদও ছিল। স্টকহোমের অনুজপ্রতিম বন্ধু খালেদ হাশেম এসেছিলেন এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। তিনি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দেখতে ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে। আমাকে দেখে রোগক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেছেন, 'ভেবেছিলাম, অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। একটা রাত জামিলের বাসায় চুটিয়ে আপনার সঙ্গে আড্ডা দেব।' তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, ভবিষ্যতে এই আড্ডা হবে।
লন্ডনগামী প্লেনে বসে ভেবেছি, সেই ভবিষ্যৎ আবার কবে আসবে?
লন্ডন, ১৩ মে, শুক্রবার, ২০১১
যে সুইডেনের নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে প্রথম তাকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করেছিলেন, সেই সুইডেনেও রবীন্দ্রনাথ যে কত জনপ্রিয়, এবার সে সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো। সুইডেনের গোটেনবার্গ একটি সুন্দর ছোট শহর। রাজধানী স্টকহোম থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে। এই গোটেনবার্গের টেগোর সেলস্কপ (টেগোর সোসাইটি) থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তাদের আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মোৎসবের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। যদিও লন্ডনে এখন অসংখ্য অনুষ্ঠান চলছে। সেসব রেখে সুইডেনে ছুটেছিলাম, সেখানে সুইডিশ ও দুই বাংলার বাঙালিরা মিলে কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানায় এবং স্মরণ করে তা দেখার আগ্রহ নিয়ে।
স্টকহোমে থাকেন আমার অনুজপ্রতিম বল্পুব্দ খালেদ হাশেম। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ঢাকায় দাপুটে ছাত্রনেতা ছিলেন। আর সালেহ মোস্তফা জামিল থাকেন গোটেনবার্গে। দু'জনই টেগোর সেলস্কপের সঙ্গে যুক্ত। দু'জনই আমাকে জানিয়েছিলেন, এবার রবীন্দ্র জন্মোৎসবের সেরা অনুষ্ঠানটি হবে গোটেনবার্গে। ভারত এবং বাংলাদেশের দুই রাষ্ট্রদূতই হাজির থাকবেন এ অনুষ্ঠানে। তারা আসবেন রাজধানী স্টকহোম থেকে। তা ছাড়া গোটেনবার্গের মেয়র এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। তিনিও রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
আগেই আমার সহৃদয় পাঠকদের জানিয়ে রাখি, আমার এ লেখাটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয় (গত সপ্তাহের সমকালেই আমি কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা লেখা লিখেছি)। আমার এই লেখাটা রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষের উৎসব উপলক্ষ করে দেশভ্রমণ এবং সেই ভ্রমণে অর্জিত কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে। এ অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দের ভাগ আমার পাঠকদেরও দিতে চাই।
আজকাল ইউরোপে বিমানে যাতায়াত সুলভ ও সহজ হয়ে গেছে। ছোট ছোট অসংখ্য এয়ারলাইন্স হয়েছে, যারা অকল্পনীয় সস্তায় টিকিট বিক্রি করে। লন্ডন থেকে ইউরোপের কোনো শহরে যেতে যেখানে বড় কোনো এয়ারলাইন্সের প্লেনের ভাড়া দেড়শ' থেকে দুইশ' এবং কখনও কখনও তিনশ'-সাড়ে তিনশ' পাউন্ডের মতো, সেখানে ছোট এয়ারলাইন্সের প্লেনের ভাড়া পঁচিশ-ত্রিশ পাউন্ডের মতো। কখনও কখনও পাঁচ পাউন্ডেও টিকিট পাওয়া যায়। তবে তা কোথাও যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে কিনতে হয়। নইলে পাওয়া যায় না।
রায়ান এয়ারলাইন্স, ইজি জেট ইত্যাদি হলো এ ধরনের ছোট এয়ারলাইন্স। আমি গোটেনবার্গে যেতে রায়ান এয়ারলাইন্সের টিকিট পেলাম ২৬ পাউন্ডে। তবে প্লেন ছাড়বে আমার বাড়ির কাছের হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে নয়, বেশ দূরের স্টানস্টেড এয়ারপোর্ট থেকে। ভাড়া করা মিনি ক্যাবে হিথ্রো যেতে আমার যেখানে লাগে ত্রিশ পাউন্ড; সেখানে স্টানস্টেডে যেতে লাগবে ষাট পাউন্ড। অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। তবু তাতেও লাভ। রায়ান এয়ারেই গোটেনবার্গে যাত্রা করলাম।
৭ মে শনিবার সকাল ৭টায় ফ্লাইট। ৫টায় বাড়ি থেকে বেরোতে হলো। দীর্ঘ পথ। সামারের সকাল। মেঘ ও কুয়াশামুক্ত আকাশ। আবহাওয়াও খুব প্লেজেন্ট। যথাসময়ে এয়ারপোর্টে পেঁৗছলাম। প্লেনে চেপে মনে পড়ল, এসব প্লেনে খাবার ফ্রি নয়। দাম দিয়ে কিনতে হয়। এমনকি এক গ্গ্নাস পানিও। অত ভোরে ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে লাগল কুড়ি পাউন্ড। বাইরে যার দাম হতো বড়জোর সাত কি দশ পাউন্ড। তবু বড় এয়ারলাইন্সের প্লেনে চড়লে যে ভাড়ার টাকা গুনতে হতো, তার তুলনায় আমার এই সর্বমোট খরচও কম। তাতেই স্বস্তি পেলাম।
রায়ান এয়ারের প্লেনে চেপে দেশে জিএমজির ছোট প্লেনে চেপে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে পড়েছিল। তবে রায়ান বা ইজি জেটের প্লেনগুলো জিএমজির প্লেনের চেয়ে বড়। কোনো কোনোটি বাংলাদেশ বিমানের আগের সেকোর ফ্রেন্ডশিপ প্লেনের মতো, কোনো কোনোটি ছোট বোয়িং। মেঘমুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়ে পৌনে দু'ঘণ্টায় লন্ডন থেকে গোটেনবার্গে পেঁৗছে গেছি।
সকাল ১০টার দিকে গোটেনবার্গে পেঁৗছেছি। ইউরোপের ঘড়ি ব্রিটেনের ঘড়ির চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে। শহরে পেঁৗছেই শুনি, সিটি-মেয়র আমাদের সম্মানে দুপুরেই এক ভোজসভার আয়োজন করেছেন। আমরা মানে সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং বলাবাহুল্য আমি। রোদা সেতারি নামে যে প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক ভবনটিতে এই ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল, তার বয়স তিনশ' বছরের মতো। সংরক্ষিত ভবন। দেশি-বিদেশি ডিগনিটারিজ গোটেনবার্গে এলে তাদের সম্মান জানানোর জন্য এই ভবনে আনা হয়।
প্রথমবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে জর্জ বুশ জুনিয়র সুইডেনে এলে এই রোদা সেতারি ভবনে এসেছিলেন। এই ভবনের ভোজকক্ষে আমরা যখন টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে বসতে যাচ্ছি, তখন মেয়র আনেত সারমানের সঙ্গে বসা এক সুইডিশ মহিলা আমাকে বললেন, আপনি যে চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন, হয়তো এই চেয়ারেই প্রেসিডেন্ট বুশ বসেছিলেন। আমি সবিনয়ে বলেছি, তাতে আমি গৌরব বোধ করছি না। মহিলা বললেন, কেন, আপনি বুশবিরোধী? বলেছি, আমি কারও বিরোধী নই। কিন্তু বুশ তার কার্যকলাপ দ্বারা সারাবিশ্বে যে ঘৃণা সৃষ্টি করে গেছেন, তার সম্পর্কে সেই ঘৃণার কিছুটা আমিও পোষণ করি।
মহিলা আমার কথায় রাগ করলেন না। বললেন, আমি বুশকে ঘৃণা করি না। কিন্তু তার সব কাজের সমর্থক নই। তাকে মানুষ ঘৃণা করে কি-না জানি না, কিন্তু তিনি মানুষকে কতটা ভয় করেন, তার গোটেনবার্গ সফরকালে আমি তা দেখেছি। এই সফরকালে তিনি মাত্র প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। গালফ ওয়ার তখনও শুরু করেননি। তখনও গোটেনবার্গ সফরকালে তাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা আমি লক্ষ্য করেছি। তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বিরাট মার্কিন সেনাদল গোটেনবার্গে এসেছিল। ওই যে সামনে রাস্তা এবং দু'পাশে গাছের সারি দেখছেন; এই গাছের সারির প্রত্যেকটির নিচে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধাবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রণাঙ্গন পরিদর্শন করছেন।
আলোচনাটি ঘুরে গেল টেবিলে খাবার পরিবেশিত হওয়ায়। খেতে বসে সবাই সুইডিশ একাডেমী থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠলেন। এই আলোচনার এক ফাঁকে আগের মহিলা (তিনিও গোটেনবার্গের গণ্যমান্য নাগরিক, তার নামটা তখন টুকে রাখতে ভুলে গেছি) বললেন, আমরা শুধু একজন বাঙালি রবীন্দ্রনাথকেই নোবেল প্রাইজ দিইনি, আরও দুই বাঙালি ড. অমর্ত্য সেন এবং ড. ইউনূসকেও দিয়েছি।
আমি এবারও সবিনয়ে বলেছি, ড. অমর্ত্য সেনের নামের সঙ্গে দ্বিতীয় নামটা যোগ না করাই ভালো। একজন নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তার যথার্থ যোগ্যতা এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত অবদানের জন্য। দ্বিতীয়জনের উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো যোগ্যতা ও অবদান আবিষ্কার করতে না পেরে আমেরিকার হোয়াইট হাউসের তৎকালীন বাসিন্দাদের চাপে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিতে হয়েছে, যে শান্তির ব্যাপারে তার কোনো অবদান নেই।
মহিলা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আপনাদের এই নোবেল লরিয়েটের ওপর রুষ্ট? বলেছি, রুষ্ট নই, তবে এই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তিনি যে অসাধু রাজনীতির খেলা শুরু করেছিলেন, তাতে অনেকের মতো আমিও তার ওপর বিরক্ত। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তা পদে মেয়াদ শেষেও থাকার জেদ ধরে তিনি শুধু নিজেকেই নিজে ছোট করেছেন, আন্তর্জাতিক পুরস্কারটির সম্মান রাখতে পারেননি।
এই ভোজসভাতেই আমার প্রাথমিক পরিচয় সুইডেনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অশোক সাতজুনেহর এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারের সঙ্গে। অশোক বাবু দিলি্লর লোক। সুদর্শন। চুলে মাত্র সাদা অংশ দেখা দিয়েছে। এক সময় ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। দেখলাম রাজনীতি, কূটনীতি থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছু সম্পর্কেই ভালো জ্ঞান রাখেন। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কেও। রসিকতাতেও তিনি পারদর্শী। তার চেয়ে আমাদের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকার বয়সে ছোট, মাত্র ছয় মাস আগে সুইডেনে এসেছেন, অশোক সাতজুনেহর এসেছেন আট মাস আগে। অশোক বাবু রসিকতা করে বললেন, আমি এ দেশে আমার মাননীয় বন্ধুর চেয়ে মাত্র দু'মাসের সিনিয়র। তিনি স্টকহোমে এক পেল্লায় বাড়িতে থাকেন। কিন্তু থাকেন একা। এখনও স্ত্রীকে আনতে পারেননি। একজন তাকে হেসে জিজ্ঞাসা করেছেন, আর আপনি? অশোক বাবু হাসিমুখে বলেছেন, আমি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। তবে সঙ্গে স্ত্রী আছেন। তার কথা শুনে সকলে হেসে উঠেছেন।
ভোজ শেষে অশোক বাবু বললেন, 'এই ভবনের পেছনেই চমৎকার লেক। চলুন আমরা লেকের দিকের খোলা বারান্দায় গিয়ে একটু রোদ পোহাই।' গোটেনবার্গে আজ চমৎকার আবহাওয়া। ঠাণ্ডা চলে গেছে, কিছুটা গরম পড়েছে। অথচ কয়েকদিন আগেই বরফ পড়েছিল। মেয়র আনেত সারমান বললেন, আমাদের দেশে ওয়েদার খুবই আনপ্রেডিকটেবল।
দুপুরের ভোজের পরই সরাসরি সম্মেলনস্থলে যেতে হলো। বিরাট কমিউনিটি হল। ভেতরে লাইব্রেরি থেকে দোকানপাট, ব্যায়ামাগার আছে। অনুষ্ঠানটি হয়েছে চমৎকার ছিমছাম। আলোচনা পর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম বক্তৃতা দিয়েছেন ৪৫ মিনিট, রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ইংরেজ কবি, বিশেষ করে এজরা পাউন্ড, টিএস এলিয়ট, ইয়েটস প্রমুখের কথা তুলে রবীন্দ্র-সাহিত্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা বলব। হালে যেসব তরুণ বাঙালি-কূটনীতিকদের বিদেশে রাষ্ট্রদূত, উপরাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করতে দেখছি, তারা বিদেশে অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলেই মনে হয়। লন্ডনে উপরাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকী, ইতালির রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, জার্মানির রাষ্ট্রদূত মাসুদ মান্নান, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম প্রমুখ যাদের দেখেছি, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের যোগ্য এবং সম্ভাবনাময় কূটনীতিকদের প্রতীক বলেই তাদের মনে হয়েছে। গোটেনবার্গে গাউসুল আজম সরকারের বক্তৃতা শুনে তার বিদেশি শ্রোতারাও খুশি হয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রদূত তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশ ও ভারত কর্তৃক যুক্তভাবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষের উৎসব পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন।
আগেই বলেছি, অনুষ্ঠানটি ছিল সুন্দর এবং ছিমছাম। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অগুনতি সুইডিশ নারী-পুরুষ তো ছিলেনই, অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে অংশগ্রহণ করেছেন বহু সুইডিশ তরুণী। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতা আবৃত্তি করেছেন রবিন আন্ডারসন এবং ইংরিদ সেলমান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন শাড়ি পরে ইংরিদ সুন্দমার। মেয়র আনেত সারমানও বক্তব্য রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের ওপর। রবীন্দ্রনাথের জীবনভিত্তিক একটি ডকুমেন্টারি ছবি অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। এটি সম্পাদনা করেছেন সালেহ মোস্তফা জামিল। টেগোর সেলস্কপের সঙ্গে তিনি যুক্ত। বাঙালি মেয়ে জেনিফার মনসুর অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেছেন এবং সঙ্গীতশিল্পী দিলরুবা জামিল একাই অর্ধডজনের মতো সঙ্গীত পরিবেশন করে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলেছিলেন। শরিফ আহমদের তবলা এবং শোভন পালের বেহালা বাদন অনুষ্ঠানটিকে আরও প্রাণবন্ত করেছে।
৭ মে শনিবার একটা চমৎকার দিন ছিল আমার জন্য গোটেনবার্গে। পরের দিনটাও ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। জামিল দম্পতির সঙ্গে সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। এ সময় একটা মজার দৃশ্য চোখে পড়েছে। শহরের হারবারের কাছে একটা উঁচু পাহাড়। তার চূড়ায় উঠলে নিচে সারা শহর দেখা যায়। সোনালি রোদের দিন, গরমের আমেজ মাখানো আবহাওয়া সারা শহরের নানা বয়সের লোকেরা সেদিন এই পাহাড়ে উঠে এসেছে। পিকনিক, গান-বাজনা, রৌদ্রস্নান সবকিছু চলছে পাহাড় চূড়ায়।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটি দৃশ্য। জামিলই ডেকে আমাকে দৃশ্যটা দেখাল। সৌদি আরবের একদল তরুণ-তরুণী। তরুণীদের সকলে হিজাব পরেছে। কেউ কেউ শরীর-ঢাকা বোরকাও পরেছে। কিন্তু উদ্দাম হয়ে তরুণীরা তরুণদের হাত ধরে নাচছে। সঙ্গে বাজছে ওয়েস্টার্ন মিউজিক।
জামিলকে বললাম, ঢাকা থেকে মুফতি আমিনী গংকে এখানে ধরে এনে দৃশ্যটা দেখানো দরকার। আমরা দৃশ্যটা ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার জন্য যেই ক্যামেরা তাক করেছি অমনি নৃত্য বন্ধ হয়ে গেল, তরুণীরা তরুণদের কাছ থেকে দূরে সরে বসল।
গোটেনবার্গ থেকে লন্ডনে ফিরেছি ৯ মে সোমবার সকালে। কিন্তু তার আগের সন্ধ্যাটি অনেকদিন আমার মনে থাকবে। ফারজানা ছন্দ এবং তার স্বামী আহার পর্বের সঙ্গে এক সান্ধ্য গানের আসর বসিয়েছিলেন তাদের বাসায়। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই একেবারে তরুণ, দু'জনেই চিত্রশিল্পী, বিদেশে এসে ফারজানা অন্য পেশা শেখার ছাত্রী। তাকে দেখলে মনে হয় না, সে ছোট ছোট তিনটি কন্যার জননী। মধ্যরাত পর্যন্ত কেটেছে খাওয়া-দাওয়া আর গান-বাজনায়। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল সুইডেনের গোটেনবার্গে নয়, বাংলাদেশের ঢাকা শহরেই আছে।
এ তো হরষের মাঝে বিষাদও ছিল। স্টকহোমের অনুজপ্রতিম বন্ধু খালেদ হাশেম এসেছিলেন এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। তিনি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দেখতে ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে। আমাকে দেখে রোগক্লিষ্ট মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেছেন, 'ভেবেছিলাম, অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। একটা রাত জামিলের বাসায় চুটিয়ে আপনার সঙ্গে আড্ডা দেব।' তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, ভবিষ্যতে এই আড্ডা হবে।
লন্ডনগামী প্লেনে বসে ভেবেছি, সেই ভবিষ্যৎ আবার কবে আসবে?
লন্ডন, ১৩ মে, শুক্রবার, ২০১১
No comments