তারাপদ আচার্য্য-সর্বশুক্লা সরস্বতী
দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা ও শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবাণীধারিণী, শুভ্রবর্ণা ও শ্বেত অলংকারে ভূষিতা।
সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাঁদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন ধরাতে। দিনে দিনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার হিন্দু দেবী। ঋগ্বেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। সরস্বতী হিন্দু সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার পত্নী এবং লক্ষ্মী ও পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, এই ত্রিদেবী যথাক্রমে ত্রিমূর্তি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু ও সংহারকর্তা শিবের পত্নী। হিন্দুদের বিশ্বাস, সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ প্রসব করেন। হিন্দুধর্ম ছাড়াও খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে রচিত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মহাযান সূত্রেও সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
ধ্যানমন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মাসনা, মুক্তা হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। আবার পদ্মপুরাণে উলি্লখিত সরস্বতীস্তোত্রমে বর্ণিত হয়েছে, ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুর্জা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কম-লু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীন। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। অভ্র-আবির, আমের শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ ছাড়াও পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ থাকে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দলবেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। পূজার পরদিন ফের পূজার পর চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। আমাদের পশু থেকে যিনি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তোলেন তিনি হলেন মা সরস্বতী। জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, ললিতকলার দেবী।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধুনাগ মহাশয় আশ্রম, নারায়ণগঞ্জ।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাঁদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন ধরাতে। দিনে দিনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার হিন্দু দেবী। ঋগ্বেদে তিনি বৈদিক সরস্বতী নদীর অভিন্ন এক রূপ। সরস্বতী হিন্দু সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার পত্নী এবং লক্ষ্মী ও পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, এই ত্রিদেবী যথাক্রমে ত্রিমূর্তি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু ও সংহারকর্তা শিবের পত্নী। হিন্দুদের বিশ্বাস, সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ প্রসব করেন। হিন্দুধর্ম ছাড়াও খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে রচিত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মহাযান সূত্রেও সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
ধ্যানমন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মাসনা, মুক্তা হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। আবার পদ্মপুরাণে উলি্লখিত সরস্বতীস্তোত্রমে বর্ণিত হয়েছে, ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুর্জা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কম-লু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীন। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। অভ্র-আবির, আমের শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ ছাড়াও পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ থাকে। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দলবেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। পূজার পরদিন ফের পূজার পর চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। আমাদের পশু থেকে যিনি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তোলেন তিনি হলেন মা সরস্বতী। জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, ললিতকলার দেবী।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধুনাগ মহাশয় আশ্রম, নারায়ণগঞ্জ।
No comments