কন্যাসন্তান-নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান হোক
উদ্বেগজনক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে শুক্রবারের সমকালে। কন্যাসন্তান গর্ভে ধারণ করার অপরাধে সন্তানসম্ভবা এক মাকে হত্যা করেছে তার স্বামী। ঘটনাস্থল নরসিংদীর বেলাব। মাত্র ২৬ বছর বয়সী তরুণী জোনাকি বিয়ের আট বছরের মধ্যে জন্ম দিয়েছেন চার চারটি কন্যাসন্তান।
পঞ্চম সন্তান জন্মদানের আগে আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে স্পষ্ট হয়_ এবারের সন্তানটিও কন্যা। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামী প্রথমে তাকে মারধর করে, পরে পিটিয়ে, আঘাত করে হত্যা করে। ঘটনাটি অনেক উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে তার পরিচয় ছেলে না মেয়ে হবে সে দায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুরুষের ওপরই বর্তায়। তবু আমাদের দেশে পরিবার ও সন্তান বিষয়ে বহু অন্যায় দায় নারীর ওপরই চাপানো হয়। কালের বিবর্তনে বহু পশ্চাৎপদ সামাজিক ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কার্যক্ষেত্রে নিজেদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর এই অগ্রসর ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত হলেও এখনও নারীরা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, প্রথম বাধাটি মোকাবেলা করতে হয় মায়ের পেটে থাকতেই। কন্যাসন্তানের আগমন বাধাগ্রস্ত করার জন্য ভ্রূণ হত্যা, গর্ভপাত থেকে শুরু করে অনেক অন্যায়ই ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে পুত্রসন্তান কামনায় নারীকে একের পর এক সন্তান ধারণে বাধ্য করা হয়। স্বামীর নির্যাতনে নিহত জোনাকির ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু খুব কম ঘটনাই জনসমক্ষে আসে। লোকচক্ষুর আড়ালে কন্যাসন্তানের প্রতি যে অন্যায় চলছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কত শিশু ভ্রূণ অবস্থায় হত্যার শিকার হচ্ছে, মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণের দায়ে কত শিশুকে অপুষ্টি ও অনাদর সইতে হচ্ছে তার হিসাবও নেই। ভারতে ভ্রূণ অবস্থায় কন্যাশিশু হত্যার হার সাম্প্রতিককালে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পেঁৗছেছে। সেখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম এ বিষয়ে বিশেষভাবে তৎপর হয়েছে। ভ্রূণ হত্যা প্রতিরোধের জন্য সেখানে কঠোর আইন করা হয়েছে। ডাক্তার, হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার ও ডায়াগস্টিক সেন্টারগুলোর প্রতি নির্দেশ জারি করা হয়েছে, যাতে আলট্রাসনোগ্রামের সময় সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় জানানো না হয়। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভ্রূণ হত্যার বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসছে সেখানে। আমাদের দেশে এ ধরনের আইন নেই। তবে ভ্রূণ হত্যা, কন্যাশিশু জন্মদানের জন্য নারীর ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার বিচার বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে হওয়া সম্ভব। কিন্তু কন্যাশিশুর প্রতি বৈরিতার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে আইন করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, এ বিষয়ে সমাজে যে নীরবতা রয়েছে তা ছিন্ন হওয়া দরকার। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর প্রতি বিশেষ নির্দেশনা জারি করা দরকার। কন্যাসন্তানের ভ্রূণ হত্যার অপরাধ বিশেষভাবে প্রতিরোধ করা না হলে এ সংকট দিন দিন বাড়তেই থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা তৈরি সর্বাগ্রে জরুরি। সমাজ কথা বলে না উঠলে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস করা কঠিন। আজ জোনাকির প্রতি যে নির্মম অত্যাচার হলো, যেভাবে তাকে হত্যা করা হলো এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। স্ত্রী ও সন্তানের পাষণ্ড হত্যাকারীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কন্যাশিশুর প্রতি বর্বরতার অবসান হোক, সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াটি হোক পবিত্র ও উৎসবমুখর সেটাই আমাদের চাওয়া।
No comments