শেয়ার সরবরাহে টান পড়তে পারে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

উদ্যোক্তা পরিচালকদের ২ শতাংশ এবং কম্পানিপ্রতি ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতার ফলে শেয়ার সরবরাহে সাময়িক সংকট দেখা দিতে পারে। নতুন এই বাস্তবতায় কয়েকটি কম্পানির ব্যবস্থাপনায়ও কোরাম সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় পরিচালক হওয়ার শর্ত শিথিল করা যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মত দিচ্ছেন।


বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৩৫টি কম্পানির মধ্যে চারটি ছাড়া অন্য সব কম্পানির ৯৭৪ পরিচালক ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে সক্ষম হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন ৩৫৬ পরিচালক। ছয় মাসে ৯৭৪ পরিচালক ৭৪ কোটি ৪৩ লাখ শেয়ার ধারণ করে নূ্যনতম ২ শতাংশের কোটা পূরণ করেছেন। কোটা পূরণে তাঁরা ১০ টাকা ফেসভ্যালুর ৩১ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার কিনেছেন। আর পুরস্কার হিসেবে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে পেয়েছেন ৪২ কোটি ৮৩ লাখ শেয়ার। শেয়ারবাজারের মোট তিন হাজার ৩০৯ কোটি ৩০ লাখ শেয়ারের মধ্যে এই ৭৪ কোটি ৪৩ লাখ শেয়ার আর লেনদেনের সুযোগ থাকবে না। তবে কম্পানির জন্য নূ্যনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা আরোপের ফলে ৯৯২ কোটি শেয়ারের লেনদেন হবে না সেকেন্ডারি বাজারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, প্রতিটি কম্পানির পরবর্তী বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম পর্যন্ত ৫ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে পরিচালক হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করার জন্য বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনা শুরু করলেও সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ারের সরবরাহ কমে যেতে পারে। এ ছাড়া ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে পরিচালক হওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যবান ব্যক্তি কতজন পাওয়া যাবে_তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। এ কারণে বাধ্যবাধকতার শর্ত শিথিল করে ৩ শতাংশ করা যেতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
এদিকে নূ্যনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ ৩৫৬ পরিচালক শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে কিছুটা আশঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে এই পরিচালকদের শুধু ব্লক মার্কেটে শেয়ার বিক্রির শর্ত বেঁধে দেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্লক মার্কেটে পরিচালকরা বড় বড় লটে শেয়ার লেনদেন করতে পারেন।
পরিচালকদের শেয়ার ধারণসংক্রান্ত বাধ্যবাধকতায় বাজারে বিক্রিযোগ্য শেয়ার খুব কমবে বলে মনে করেন না চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট আল মারুফ খান। তিনি বলেন, চলতি বছর শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে পরবর্তী এজিএমের মৌসুমে নতুন পরিচালক হওয়ার জন্য ৫ শতাংশ শেয়ার কেনার শর্ত পূরণের জন্য বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়বে।
এদিকে বেশির ভাগ পরিচালকের পদ শূন্য হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই ১৪টি কম্পানি কোরাম সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম, বরকতউল্লাহ ইলেকট্রো ডায়ানমিকস, বে-লিজিং, ফাইন ফুডস, ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্ক, মুন্নু সিরামিকস, নদার্ন জুট, রংপুর ডেইরি, সালভো কেমিক্যাল, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ। পরিচালনা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য নূ্যনতম যতজন পরিচালক থাকার কথা, ততজন না থাকার কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কোরাম সংকটের কারণে কম্পানিগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে এর থেকে উত্তরণের পথ নিয়েও মত দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, এসইসি ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে পরিচালক হওয়ার সুযোগ দিতে পারে। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে কম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্য থেকে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে পরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে। পরবর্তী এজিএমে ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে পরিচালক হতে না পারলে কী করা সম্ভব জানতে চাইলে আবু আহমেদ বলেন, সে ক্ষেত্রে এসইসি শর্ত শিথিল করে ৫ শতাংশের পরিবর্তে আরো কম ৩ বা ৪ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে পরিচালক হওয়ার সুযোগ দিতে পারে।
এ ব্যাপারে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে কম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই ব্যাখ্যা দিয়ে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এসইসি এ বিষয়ে যেহেতু কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, তাই কম্পানি আইনের আওতায়ই সমাধান করতে হবে।
কম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম বলেন, বাংলাদেশের কম্পানি আইনের নিয়ম হচ্ছে_একটি বোর্ড মিটিংয়ে কোরাম পূরণ না হলে এক সপ্তাহ পর আবার বোর্ড মিটিং ডাকতে হবে। সেই মিটিংয়ে যে কজন পরিচালক উপস্থিত থাকবেন, তাঁদের নিয়েই মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত পরিচালকদের মাধ্যমে পরবর্তী এজিএম পর্যন্ত কম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করারও নিয়ম রয়েছে।
ডিএসইর পরিচালক আবদুল হক বলেন, ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক উদ্যোক্তাকে কম্পানি ছাড়তে হবে বলে কোনো কোনো কম্পানির ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তবে ব্যক্তিগত মালিকানার জন্য ৫ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত কমিয়ে ২ বা আড়াই শতাংশ করা হলে বাইরে থেকেও পরিচালক হওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে পরিচালক হওয়া অনেক ব্যয়বহুল।
২ শতাংশ শেয়ার ধারণের ফলে শেয়ারের কিছুটা কমতি হলেও এটিকে খুব বড় সমস্যা বলে মনে করেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তাঁর মতে, পরিচালকদের শূন্যপদে ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে কারা আসবেন, সে ক্ষেত্রে অর্থের জোর করপোরেট গভর্ন্যান্স বা ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা ছাপিয়ে যায় কি না সেটিই দেখার বিষয়। অবশ্য এ ধরনের সমস্যা হলে এসইসি তার নীতিমালা পরিবর্তন করতে পারে।
এদিকে হঠাৎ করে পরিচালকদের শেয়ার ধারণ নিয়ে উঠেপড়ে লাগাকে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা বলে মন্তব্য করেন ২০১১ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, বাজারের মূল সমস্যা হলো রক্ষকই ভক্ষক। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যথাযথভাবে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন করা সম্ভব হলেই শেয়ারবাজারে কিছুটা স্বচ্ছতা আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায় রয়েছে বলে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, 'কারসাজি পৃথিবীর সব শেয়ারবাজারেই হয়, তবে সেখানে জড়িতরা ধরা পড়ে, শাস্তি হয়। আর আমাদের এখানে চিহ্নিত হলেও কেউ ধরা পড়ে না। কারণ যাঁরা ধরবেন, তাঁরাও এ প্রক্রিয়ায় জড়িত।'
তবে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন না চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি আল মারুফ খান। তিনি বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন হওয়ার পরও স্টক মার্কেটে ম্যানুপুলেশন হয়েছে পৃথিবীতে এমন নজিরও কম নেই। কম্পানির ব্যবস্থাপনা সংকট প্রসঙ্গে সিএসই সভাপতি বলেন, বিদ্যমান আইনে কম্পানিগুলো সাময়িক শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে। অথবা এসইসি অন্তর্বর্তীকালীন কোনো নির্দেশনাও দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.