প্রথম আলো জনমত জরিপ ২০১১-দেশ ঠিক পথে চলছে না
বেশির ভাগ মানুষ মনে করছেন, দেশ ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি বা বিরোধী দল—কারও ওপরই খুশি নন মানুষ। তাঁদের মতে, সরকারি দল তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলও মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ২০১০-এর তুলনায় ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেশ খানিকটা কমেছে। বিপরীতে বিএনপির জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে। তবে জোটবদ্ধভাবে দুই পক্ষের জনপ্রিয়তা প্রায় সমান।
অধিকাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াকে ‘ভালো’ বলেছেন।
বর্তমান সরকারের তিন বছর উপলক্ষে প্রথম আলোর উদ্যোগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত জাতীয় জনমত জরিপ-২০১১ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাঁচ হাজার উত্তরদাতার ওপর জরিপটি চালানো হয়।
প্রায় অভিন্ন প্রশ্নমালা নিয়ে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দুটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো।
২০১১ সালের জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ৩৮ শতাংশ আর জাতীয় পার্টির ৮ শতাংশ, সম্মিলিতভাবে ৪৬ শতাংশ। বিপরীতে বিরোধী দল বিএনপির জনসমর্থন ৪৩ শতাংশ আর জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর ৪ শতাংশ, সম্মিলিতভাবে ৪৭ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো দলের প্রতি সমর্থন দেননি।
জরিপে অংশ নেওয়া মানুষ সরকার পরিচালনার বেশির ভাগ ক্ষেত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদ সক্রিয় করা নিয়ে সরকারি দলের উদ্যোগহীনতা আর বিরোধী দলের সংসদ বর্জন বেশির ভাগ উত্তরদাতা পছন্দ করছেন না। দেশে দুর্নীতি, নৈরাজ্যের রাজনীতি বেড়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সঠিকভাবে কাজ করছে না বলে বেশির ভাগ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না করার সিদ্ধান্তকে বেশির ভাগ উত্তরদাতা সঠিক মনে করছেন না। গত এক বছরে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারের আওতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলে বেশির ভাগ উত্তরদাতার ধারণা।
প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো সরকার সঠিকভাবে পালন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় বাড়ছে। এই সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের (যুদ্ধাপরাধ) বিচার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে হ্যাঁ-না উভয় পক্ষে ৪৭ শতাংশ মত পড়েছে। অথচ ২০০৯ সালে ৮৬ এবং ২০১০-এ ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতার মত ছিল, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে।
জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকার সবচেয়ে সফল। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সঠিক ছিল। আর ২০১০-এর হতাশা কাটিয়ে ২০১১-তে এসে ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিদ্যুৎ খাতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
তবে ২০০৯ ও ২০১০-এর অন্যতম সফল খাত কৃষি নিয়ে মানুষ হতাশ। ২০০৯ সালে ৬৭ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, কৃষি খাতে নেওয়া সরকারের উদ্যোগগুলো ঠিক আছে। কিন্তু ২০১১-তে এসে মাত্র ৩৭ শতাংশ মনে করছেন, কৃষিক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য লাভজনক। ২০০৯ ও ২০১০-এর তুলনায় ২০১১-তে কৃষক ধান-পাটসহ বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক অখুশি বলে জরিপে উঠে এসেছে।
কোন পথে দেশ: জরিপে দেখা গেছে, সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ চালাতে পারছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের কর্মদক্ষতা ভালো নয়।
২০০৯ সালে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, সব মিলিয়ে দেশ যে পথে এগোচ্ছে, তা সঠিক। ২০১০-এ এই মতের পক্ষে জনমত কমে ৬১ শতাংশে দাঁড়ায়। এবার জনমত ব্যাপক কমেছে। ২০১১ সালে মাত্র ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। আর ৫৭ শতাংশ মনে করছেন, দেশ সঠিক পথে চলছে না।
দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন: এ মুহূর্তে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা বিএনপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন ৩৮ শতাংশ। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) পক্ষে ৮ ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ৪ শতাংশ উত্তরদাতা ভোট দিতে চেয়েছেন।
জোট ধরে হিসাব করলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পক্ষে ৪৬ শতাংশ এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে ৪৭ শতাংশ ভোট পড়বে।
২০০৯ সালের জরিপে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা এককভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তা কমে ৪৯ শতাংশ এবং ২০১১ সালে তা আরও কমে ৩৮ শতাংশ হয়। জাতীয় পার্টির জনসমর্থন ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, ২০১০-এ এসে দ্বিগুণ হয়। আর ২০১১ সালে তা আরও বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দেশে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ২০১১ সালে ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা না করতে দেওয়ার পক্ষে এবং ৪০ শতাংশ করতে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ২০১০ সালের জরিপেও একই ফল এসেছিল।
বিরোধী দলের প্রতি আচরণ: ২০১১-এর জরিপে ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ সঠিক মনে করেন না। ২০১১-এর জরিপ অনুযায়ী, ৫৪ শতাংশ মনে করেন, বিরোধী দলকে সংসদে নিতে সরকার আন্তরিক নয়। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৪৮ শতাংশ আর ২০০৯ সালে ৩৪ শতাংশ।
বিরোধী দলের হরতাল ও নৈরাজ্যের মতো পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবারও ফিরে আসবে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের জরিপে এই একই প্রশ্নের উত্তরে ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ফিরে আসবে না। ২০১০ সালে এই ধারণার পক্ষে জনমত ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। ২০১১-এর জরিপে তা বেশ কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
সংবিধান সংশোধন: ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, সরকার সঠিক পন্থায় বা ইতিবাচক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করেনি।
২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ৪১ ও ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বিগত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের তুলনায় বর্তমান সময়ে দলীয়করণের মাত্রা বেড়েছে। ২০১১-এর জরিপে দেখা যায়, ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন, দলীয়করণ বেড়েছে।
আইনের শাসন: মানুষের সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ২০১১ সালের জরিপে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিপক্ষে। ২০০৯ সালে ৭৭ শতাংশ এবং ২০১০-এ ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। ২০১১ সালের জরিপে ৩১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২০০৯ সালে ১১ শতাংশ ও ২০১০-এ ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা এমন মত দিয়েছেন।
বিচারব্যবস্থার উন্নতি না অবনতি হয়েছে—এমন প্রশ্নে ২০১১ সালে ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন উন্নতি হয়েছে। ২০০৯ সালে ৫২ শতাংশ ও ২০১০-এ ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ২০১১ সালের অন্যতম আলোচিত বিষয় হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর, ট্রানজিট, তিস্তা চুক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনমত জরিপে মিশ্র মনোভাব পাওয়া গেছে। ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া লাভজনক হবে না।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য দায় বাংলাদেশ, ভারতের, না উভয় সরকারের—এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ২২ শতাংশ উত্তরদাতা বাংলাদেশকে ও ২০ শতাংশ ভারতকে দায়ী করেছেন। চুক্তি না হওয়ায় উভয় দেশকেই দায়ী করেছেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা।
২০১১ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে মনে করেন ৬৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে ৭৬ শতাংশ এবং ২০১০-এ ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছিলেন।
অর্থনীতি ও উন্নয়ন: অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপকে সঠিক মনে করেননি বেশির ভাগ মানুষ। জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে, এমন মতদাতার সংখ্যা এর আগের দুই বছরের তুলনায় ২০১১ সালে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ২২ ও ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
ক্ষুব্ধ মনোভাব উঠে এসেছে দ্রব্যমূল্য নিয়ে। ২০১১ সালের জরিপে ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো অসফল। মাত্র ২১ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে মত দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ৫০ শতাংশ এবং ২০১০-এ ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপকে সফল বলে মত দিয়েছিলেন।
দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন নিয়ে ২০১১ সালের জরিপে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। ২০০৯ সালে ২১ ও ২০১০ সালে ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিয়ে মানুষের হতাশা ব্যাপক বেড়েছে। কর্মসংস্থান বাড়ানো নিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে, ২০১১-এর জরিপে এমন মত দিয়েছেন ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে এ হার ছিল ৪৮ শতাংশ।
দুর্নীতি: ২০১১ সালের জরিপে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা দুর্নীতি বেড়েছে বলে মত দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ৩৪ এবং ২০১০-এ ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন, দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। ২০১০ সালে ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
জাতীয় সংসদে গণমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার ও পত্রিকার প্রকাশনা রদ করার মতো আচরণে দেশের মানুষ খুশি নন। ২০১০ সালের জরিপে ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের আচরণে খুশি ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে এ হার ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
দেশ নিয়ে হতাশা বেড়েছে: ২০১১ সালের জরিপে ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, দেশের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। ২০১০ সালে এই মত ছিল ৫০ আর ২০০৯ সালে ছিল ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতার।
হরতাল, সহিংসতার মতো পুরোনো রাজনৈতিক ধারা আর ফিরবে না, এমন আশা করা মানুষের সংখ্যা কমছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ৫৯ ও ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করতেন, হরতালের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ফিরবে না। কিন্তু এই সংখ্যা ২০১১ সালে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। পক্ষান্তরে, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবার ফিরে আসবে বলে ২০১১ সালে মত দিয়েছেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০০৯ ও ২০১০ সালে এই মত ছিল যথাক্রমে ৩৮ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ।
জন-অসন্তুষ্টি বেড়েছে: বর্তমান সরকারের গত তিন বছরের কার্যক্রমে মানুষের অসন্তুষ্টি বেড়েছে। ২০১১ সালে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ২০০৯ সালে ৬৬ শতাংশ আর ২০১০ সালে ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
জনমত জরিপের ইংরেজি বিবরণ পড়তে ক্লিক করুন
বর্তমান সরকারের তিন বছর উপলক্ষে প্রথম আলোর উদ্যোগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত জাতীয় জনমত জরিপ-২০১১ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাঁচ হাজার উত্তরদাতার ওপর জরিপটি চালানো হয়।
প্রায় অভিন্ন প্রশ্নমালা নিয়ে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দুটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো।
২০১১ সালের জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ৩৮ শতাংশ আর জাতীয় পার্টির ৮ শতাংশ, সম্মিলিতভাবে ৪৬ শতাংশ। বিপরীতে বিরোধী দল বিএনপির জনসমর্থন ৪৩ শতাংশ আর জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর ৪ শতাংশ, সম্মিলিতভাবে ৪৭ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো দলের প্রতি সমর্থন দেননি।
জরিপে অংশ নেওয়া মানুষ সরকার পরিচালনার বেশির ভাগ ক্ষেত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদ সক্রিয় করা নিয়ে সরকারি দলের উদ্যোগহীনতা আর বিরোধী দলের সংসদ বর্জন বেশির ভাগ উত্তরদাতা পছন্দ করছেন না। দেশে দুর্নীতি, নৈরাজ্যের রাজনীতি বেড়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সঠিকভাবে কাজ করছে না বলে বেশির ভাগ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না করার সিদ্ধান্তকে বেশির ভাগ উত্তরদাতা সঠিক মনে করছেন না। গত এক বছরে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারের আওতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলে বেশির ভাগ উত্তরদাতার ধারণা।
প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো সরকার সঠিকভাবে পালন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় বাড়ছে। এই সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের (যুদ্ধাপরাধ) বিচার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে হ্যাঁ-না উভয় পক্ষে ৪৭ শতাংশ মত পড়েছে। অথচ ২০০৯ সালে ৮৬ এবং ২০১০-এ ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতার মত ছিল, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে।
জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকার সবচেয়ে সফল। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সঠিক ছিল। আর ২০১০-এর হতাশা কাটিয়ে ২০১১-তে এসে ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিদ্যুৎ খাতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
তবে ২০০৯ ও ২০১০-এর অন্যতম সফল খাত কৃষি নিয়ে মানুষ হতাশ। ২০০৯ সালে ৬৭ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, কৃষি খাতে নেওয়া সরকারের উদ্যোগগুলো ঠিক আছে। কিন্তু ২০১১-তে এসে মাত্র ৩৭ শতাংশ মনে করছেন, কৃষিক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য লাভজনক। ২০০৯ ও ২০১০-এর তুলনায় ২০১১-তে কৃষক ধান-পাটসহ বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক অখুশি বলে জরিপে উঠে এসেছে।
কোন পথে দেশ: জরিপে দেখা গেছে, সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ চালাতে পারছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের কর্মদক্ষতা ভালো নয়।
২০০৯ সালে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, সব মিলিয়ে দেশ যে পথে এগোচ্ছে, তা সঠিক। ২০১০-এ এই মতের পক্ষে জনমত কমে ৬১ শতাংশে দাঁড়ায়। এবার জনমত ব্যাপক কমেছে। ২০১১ সালে মাত্র ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। আর ৫৭ শতাংশ মনে করছেন, দেশ সঠিক পথে চলছে না।
দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন: এ মুহূর্তে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা বিএনপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন ৩৮ শতাংশ। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) পক্ষে ৮ ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ৪ শতাংশ উত্তরদাতা ভোট দিতে চেয়েছেন।
জোট ধরে হিসাব করলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পক্ষে ৪৬ শতাংশ এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে ৪৭ শতাংশ ভোট পড়বে।
২০০৯ সালের জরিপে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা এককভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তা কমে ৪৯ শতাংশ এবং ২০১১ সালে তা আরও কমে ৩৮ শতাংশ হয়। জাতীয় পার্টির জনসমর্থন ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, ২০১০-এ এসে দ্বিগুণ হয়। আর ২০১১ সালে তা আরও বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দেশে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ২০১১ সালে ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা না করতে দেওয়ার পক্ষে এবং ৪০ শতাংশ করতে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ২০১০ সালের জরিপেও একই ফল এসেছিল।
বিরোধী দলের প্রতি আচরণ: ২০১১-এর জরিপে ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ সঠিক মনে করেন না। ২০১১-এর জরিপ অনুযায়ী, ৫৪ শতাংশ মনে করেন, বিরোধী দলকে সংসদে নিতে সরকার আন্তরিক নয়। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৪৮ শতাংশ আর ২০০৯ সালে ৩৪ শতাংশ।
বিরোধী দলের হরতাল ও নৈরাজ্যের মতো পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবারও ফিরে আসবে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের জরিপে এই একই প্রশ্নের উত্তরে ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ফিরে আসবে না। ২০১০ সালে এই ধারণার পক্ষে জনমত ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। ২০১১-এর জরিপে তা বেশ কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
সংবিধান সংশোধন: ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, সরকার সঠিক পন্থায় বা ইতিবাচক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করেনি।
২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ৪১ ও ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বিগত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের তুলনায় বর্তমান সময়ে দলীয়করণের মাত্রা বেড়েছে। ২০১১-এর জরিপে দেখা যায়, ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন, দলীয়করণ বেড়েছে।
আইনের শাসন: মানুষের সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ২০১১ সালের জরিপে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিপক্ষে। ২০০৯ সালে ৭৭ শতাংশ এবং ২০১০-এ ৭৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। ২০১১ সালের জরিপে ৩১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২০০৯ সালে ১১ শতাংশ ও ২০১০-এ ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা এমন মত দিয়েছেন।
বিচারব্যবস্থার উন্নতি না অবনতি হয়েছে—এমন প্রশ্নে ২০১১ সালে ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন উন্নতি হয়েছে। ২০০৯ সালে ৫২ শতাংশ ও ২০১০-এ ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: ২০১১ সালের অন্যতম আলোচিত বিষয় হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর, ট্রানজিট, তিস্তা চুক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনমত জরিপে মিশ্র মনোভাব পাওয়া গেছে। ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া লাভজনক হবে না।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য দায় বাংলাদেশ, ভারতের, না উভয় সরকারের—এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ২২ শতাংশ উত্তরদাতা বাংলাদেশকে ও ২০ শতাংশ ভারতকে দায়ী করেছেন। চুক্তি না হওয়ায় উভয় দেশকেই দায়ী করেছেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা।
২০১১ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে মনে করেন ৬৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে ৭৬ শতাংশ এবং ২০১০-এ ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছিলেন।
অর্থনীতি ও উন্নয়ন: অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপকে সঠিক মনে করেননি বেশির ভাগ মানুষ। জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে, এমন মতদাতার সংখ্যা এর আগের দুই বছরের তুলনায় ২০১১ সালে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ২২ ও ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
ক্ষুব্ধ মনোভাব উঠে এসেছে দ্রব্যমূল্য নিয়ে। ২০১১ সালের জরিপে ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো অসফল। মাত্র ২১ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারি পদক্ষেপের পক্ষে মত দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ৫০ শতাংশ এবং ২০১০-এ ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপকে সফল বলে মত দিয়েছিলেন।
দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন নিয়ে ২০১১ সালের জরিপে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। ২০০৯ সালে ২১ ও ২০১০ সালে ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিয়ে মানুষের হতাশা ব্যাপক বেড়েছে। কর্মসংস্থান বাড়ানো নিয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে, ২০১১-এর জরিপে এমন মত দিয়েছেন ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে এ হার ছিল ৪৮ শতাংশ।
দুর্নীতি: ২০১১ সালের জরিপে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা দুর্নীতি বেড়েছে বলে মত দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ৩৪ এবং ২০১০-এ ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন, দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। ২০১০ সালে ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা এই মত দিয়েছিলেন।
জাতীয় সংসদে গণমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার ও পত্রিকার প্রকাশনা রদ করার মতো আচরণে দেশের মানুষ খুশি নন। ২০১০ সালের জরিপে ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের আচরণে খুশি ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে এ হার ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
দেশ নিয়ে হতাশা বেড়েছে: ২০১১ সালের জরিপে ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, দেশের রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। ২০১০ সালে এই মত ছিল ৫০ আর ২০০৯ সালে ছিল ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতার।
হরতাল, সহিংসতার মতো পুরোনো রাজনৈতিক ধারা আর ফিরবে না, এমন আশা করা মানুষের সংখ্যা কমছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে ৫৯ ও ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করতেন, হরতালের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ফিরবে না। কিন্তু এই সংখ্যা ২০১১ সালে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। পক্ষান্তরে, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবার ফিরে আসবে বলে ২০১১ সালে মত দিয়েছেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০০৯ ও ২০১০ সালে এই মত ছিল যথাক্রমে ৩৮ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ।
জন-অসন্তুষ্টি বেড়েছে: বর্তমান সরকারের গত তিন বছরের কার্যক্রমে মানুষের অসন্তুষ্টি বেড়েছে। ২০১১ সালে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ২০০৯ সালে ৬৬ শতাংশ আর ২০১০ সালে ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
জনমত জরিপের ইংরেজি বিবরণ পড়তে ক্লিক করুন
No comments