কুমিল্লা সিটির প্রথম মেয়র মনিরুল-ইভিএমে ভোট পাঁচ ঘণ্টায় ফল by টিপু সুলতান

লেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট নেওয়ার বিষয়ে যাঁর আপত্তি ও ভীতি ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই মনিরুল হকই গতকাল পুরোপুরি ডিজিটাল এক নির্বাচনে নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আফজল খানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সরকারের তৃতীয় বছরের শেষ দিনে গতকাল
বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো পুরোপুরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে। সবগুলো কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণ হয়েছে ইভিএমের মাধ্যমে। সব কটি কেন্দ্রে ছিল ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে ডিজিটাল নজরদারি।
রাত নয়টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন কেন্দ্রভিত্তিক ফল ঘোষণার পর মনিরুল হককে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এর আগে চারটায় ভোট নেওয়া শেষে এক ঘণ্টার মধ্যেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ফল ঘোষণা করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষে আসতে শুরু করেন। সেখানে রিটার্নিং কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করেন। সব মিলে চূড়ান্ত ফল পেতে প্রার্থীদের মাত্র পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।
রাতে ফলাফল ঘোষণার পর মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমার মধ্যে অনেক সংশয় ছিল। ইভিএম নিয়ে ভীতিও ছিল। সবকিছু ম্লান করে দিয়ে আমি জয়ী হয়েছি।’
সদ্য বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার মেয়র মনিরুল হক ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের প্রতিবাদে বিএনপি এই নির্বাচন বয়কট করায় মনিরুল হক দল থেকে ‘রাজনৈতিক অব্যাহতি’ নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করেন। সম্মিলিত নাগরিক কমিটির ব্যানারে মনিরুল হক প্রার্থী হলেও স্থানীয়ভাবে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
এখন বিএনপিতে ফিরে যাবেন কি না, জানতে চাইলে মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৩ বছর যে দল করেছি, তার প্রতি আমার গভীর অনুরাগ রয়েছে। শিগগিরই ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব। আমার ভোটারদের সঙ্গেও কথা বলব।’
গত রাতে ভোটের ফলাফলের পর আফজল খানের প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করলে তাঁর বড় ছেলে ও প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মাসুদ পারভেজ খান (ইমরান) প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনিরুল হককে আমি ইতিমধ্যে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছি। নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। ইভিএমে দুই নম্বরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই।’
আর নির্বাচন কমিশন বলেছে, কুমিল্লা সিটি নির্বাচন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সুষ্ঠু হয়েছে। এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ফলাফল: ভোট নেওয়া শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেশিনে গণনা শেষে বেসরকারিভাবে ফল ঘোষণা করা হয়। বেসরকারি ফলাফলে মনিরুল হক পেয়েছেন ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আফজল খান পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট।
বাকি ছয়জন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে নূর-উর রহমান মাহমুদ আট হাজার ৫১৪ ভোট, আনিসুর রহমান তিন হাজার ৯৯৪, জাতীয় পার্টি-সমর্থিত এয়ার আহমেদ সেলিম সাত হাজার ৯৬১, শিরিন আখতার এক হাজার ১০৩, সালমান সাঈদ ৪২৭ ও চঞ্চল কুমার ঘোষ ৮৯০ ভোট পান। মামুনুর রশীদ ৫৮৫ ভোট পেয়েছেন, যদিও তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
এই সিটি করপোরেশনের ৬৫টি কেন্দ্রে মোট ভোটার এক লাখ ৬৯ হাজার ২৭৯ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৭২ জন। ভোট নষ্ট হয়েছে এক হাজার ৫৫০টি।
কুমিল্লা টাউন হলে স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন। সন্ধ্যার পর তিনি মাইকে একেকটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন। আর টাউন হল আঙিনায় সমবেত মনিরুল হকের সমর্থকেরা হর্ষধ্বনি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। মনিরুল হক নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল ভোট গ্রহণের সময় কেন্দ্রগুলোতে কোথাও মনিরুল হকের প্রতীকের ব্যাজ লাগানো কাউকে দেখা যায়নি। সর্বত্র আফজল খানের প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা যায় উল্টো চিত্র। স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, আফজলের প্রতীকে ব্যাজ লাগিয়ে অনেকেই ভোট দিয়েছেন মনিরুল হককে।
জয় ইভিএমেরও: ইভিএমে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বয়স্ক ও নারী ভোটারের জড়তা ছিল। তবে বেশির ভাগ ভোটার এই পদ্ধতি সহজভাবে গ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে ইভিএম নিয়ে ছিল দারুণ উৎসাহ।
দেশে প্রথম ইভিএম ব্যবহূত হয় ২০০৯ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সেখানে মাত্র একটি ওয়ার্ডে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। এরপর গত ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নয়টি ওয়ার্ডে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। ওই দুটি নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মধ্যে এত উৎসাহ দেখা যায়নি। কিন্তু গতকাল কুমিল্লার নির্বাচনে ইভিএমই ছিল প্রধান আকর্ষণ।
ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে কান্দিরপাড় এলাকার শাম্মি আক্তার (৩৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন পদ্ধতিতে ভোট দিলাম। প্রথমে একটু ভয় লাগছিল। পরে দেখলাম, খুব সহজ কাজ। আনন্দও পাইছি। আর কোনো গ্যাঞ্জাম নাই।’
গতকাল সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ৬৫টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ হয়েছে। প্রথম আলোর পাঁচজন প্রতিবেদক ও তিনজন আলোকচিত্রী সাংবাদিক প্রায় ৩০টি কেন্দ্র ঘুরে খবর সংগ্রহ করেছেন। কোথাও অপ্রীতিকর কিছু দেখা যায়নি। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাব-পুলিশ বেশ তৎপর ছিল। কেন্দ্রের আশপাশেও জটলা করতে দেননি ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাব-পুলিশের ভ্রাম্যমাণ দলগুলো।
সদর দক্ষিণ এলাকার করিম আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে জাল ভোট দিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন আল আমিন নামের এক যুবক। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। জাল ভোটের চেষ্টাকালে আরও তিনজনকে আটক করা হয়।
রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ইভিএম নিয়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।’
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইভিএম ছাড়া আরও কয়েকটি কারণে এই নির্বাচন ব্যতিক্রম। নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকে ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত আগাগোড়াই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল। ভোট গ্রহণ শুরুর পর মেয়র পদে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাংবাদিকদের বলেছেন, ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। ফলাফল যা-ই হোক, তাঁরা তা মেনে নেবেন।
৩০ সেকেন্ডে ভোট শেষ: সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হলেও এর আগে থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের লাইন দাঁড়িয়ে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভোটারদের উপস্থিতি। ইভিএমে খুব অল্প সময়ে ভোট দেওয়ায় বেলা দুইটার পর বেশির ভাগ কেন্দ্র ফাঁকা হয়ে যায়।
ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নারী ভোটারদের মধ্যে, বিশেষ করে নিরক্ষর ও বয়স্ক মানুষ কিছুটা ভোগান্তিতে পড়লেও পুরুষ ভোটারদের অভিযোগ ছিল নগণ্য।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবুল বাশার বলেন, ‘ভোট দিতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড। ভোট দেওয়ার নিয়মকানুন টাঙিয়ে রাখা আছে। কেউ না বুঝলে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
বেলা ১১টায় শালবন বিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ততক্ষণে এক হাজার ৫৯১ জন ভোট দিয়ে ফেলেছেন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার দুই হাজার ১২ জন। এখানকার পোলিং কর্মকর্তারা বলেন, প্রথম দিকে কিছু নারী ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে ঠিকভাবে ভোট দিতে পারছিলেন না। তাঁদের সহায়তা করতে হয়েছে। আর কোনো সমস্যা হয়নি।
কুমিল্লা হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান সেলিমা রহমান বলেন, ইভিএম নিয়ে বয়স্ক ও নিরক্ষরদের মধ্যে একধরনের ভীতি দেখা গেছে। এই পদ্ধতি সম্পর্কে ভোটারদের আরও ব্যাপকভাবে ধারণা দেওয়া দরকার। অন্তত ১০টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে বয়স্ক নারী ভোটারদের ইভিএম ব্যবহারে অস্বস্তির কথা স্বীকার করেছেন।
পাঁচ মিনিটের জন্য: কুমিল্লা হাইস্কুলে একটি বুথে দুপুর ১২টায় ইভিএম মেশিন বিকল হয়ে যায়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে বিকল্প মেশিন স্থাপন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.