আশুরা :মুক্তিকামীদের বিজয়ের দিন by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

শুরা মুসলিম ইতিহাসের এক আলোচিত দিন। এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম বিশ্বের নানা ঘটনাপ্রবাহ। তবে হাল সময়ে সবকিছু ছাপিয়ে হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শাহাদতের কথাই বেশি উচ্চারিত হয়ে আসছে। অনেকের কাছে আশুরার অর্থই হলো_ দুটি রোজা রাখা, কিছু দান-খয়রাত করা। আবার অনেকেই মনে করেন, আশুরার দিন কারবালার ঘটনা মনে করে তাজিয়া মিছিল, নিজেকে রক্তাক্ত করে শোক প্রকাশসহ ইয়াজিদ ও তার


বাহিনীকে গালি দেওয়াই আশুরার মূল কাজ। কিন্তু কেউই আশুরার দিনের মূল বিষয়ে যেতে চান না। আশুরার মূল তাৎপর্য কী তা খতিয়ে দেখতে চান না। আশুরার দিনের ইতিহাস ও বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে বলা যায়, আশুরা হলো মুক্তিকামী মুসলমানদের বিজয়ের দিন। ইমানওয়ালা ও পরকালে বিশ্বাসীদের সাহস সঞ্চারের দিন। তাবৎ অন্যায়-অবিচার, ক্ষমতা কুক্ষিগত ও অপব্যবহার শেষ হওয়ার দিন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং আশুরাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদিস ও ইতিহাসের কিতাবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনা আগমন করে দেখতে পেলেন, সেখানকার ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তারা জানাল, এই দিনে আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাইলকে শত্রুর কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন আর ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনীকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) এ দিনে আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রোজা রেখেছিলেন। কাজেই আমরা হজরত মুসার (আ.) অনুসরণে এ দিনে রোজা রাখি। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'আমরা তোমাদের চেয়ে হজরত মুসার বেশি নিকটবর্তী ও তাঁকে অনুসরণের বেশি হকদার।' বুখারি শরিফ।
এই হলো হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে আশুরার গুরুত্বের মূল তাৎপর্য। এখান থেকেই আশুরার রোজা ও অন্যান্য আমলের উৎপত্তি। এ ছাড়াও পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে মহররমের ১০ তারিখে, যা আশুরার দিনকে আরও তাৎপর্যময় করে তুলেছে। পৃথিবী সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব। শাসক ও শাসিতের শ্রেণী বিভাজন। এসব অন্যায়-অবিচার থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা অসংখ্য নবী-রাসূল (আ.) দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন হজরত মুসা (আ.)। এরপর যত নবী-রাসূল (আ.) দুনিয়ায় এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকেই হক-বাতিলের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। যেমন_ হজরত ইবরাহিম (আ.) লড়েছেন অত্যাচারী শাসক নমরুদের বিরুদ্ধে, হজরত শোয়াইব (আ.) স্বার্থান্বেষী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, হজরত ঈসা (আ.) লোভী বক ধার্মিক যাজকদের বিরুদ্ধে।
যুগে যুগে এসব ঘটনা ও আশুরার মূল ইতিহাস মুসলমানদের শক্তি জুগিয়ে এসেছে। আমাদের বিশ্বাস, আশুরার অন্তর্নিহিত শিক্ষা মুসলিম সমাজ লালন করলে তারা আরও শক্তিশালী হবে, আর আল্লাহকে অবিশ্বাসকারীরা বিভিন্ন নিদর্শন থেকে শিক্ষাও নিতে পারবে। তবে আশুরায় কারবালার ঘটনা সামনে এনে যেভাবে শোক প্রকাশ ও মাতম করা হয় তা বিদআত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা এভাবে আশুরা পালন করেননি।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় বিভিন্ন যুদ্ধে অনেক সাহাবি শহীদ হয়েছেন। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রিয় চাচাও ছিলেন তাদের দলে। কিন্তু তিনি (সা.) তো তাদের জন্য কোনো ধরনের শোক প্রকাশ করেননি বছরের পর বছর। খলিফাতুল মুসলিমিনদের তিনজন শহীদ হয়েছেন। তখনও অনেক সাহাবি জীবিত ছিলেন; তারাও তো এভাবে শোক প্রকাশের ব্যবস্থা করেননি? ইসলামী শরিয়তে মৃত ব্যক্তির মারা যাওয়ার দিন থেকে নিয়ে তিন দিন পর্যন্তই শোক_ এরপর কোনো শোক নেই। মুসলিম জাতি শোক প্রকাশকারী জাতি নয়, এরা সাহসী জাতি, বিশ্বাসী জাতি। আমাদের দৃঢ়ভাবে মনে রাখতে হবে_ কারবালার ঘটনার সঙ্গে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই এ বিষয়ে যদি কেউ ভুল ধারণায় নিমজ্জিত হয় তার ভুল ভেঙে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আশুরা নিয়ে সহজভাবে যে কথাটা বলা যায় তা হলো_ আশুরার দিন হলো বিশ্বাসী ও মুক্তিকামীদের বিজয় দিবস আর অহঙ্কারী, অত্যাচারী নাস্তিকদের পতন দিবস। এই বিজয় পালনের সুন্নত পদ্ধতি হলো ১০ মহররমের সঙ্গে আগে-পরে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখা।
তবে এটা ঠিক, আশুরার মূল ঘটনার সঙ্গে হজরত হোসাইনের (রা.) শাহাদতের প্রেক্ষাপট একই বিষয়কে কেন্দ্র করে। ফলে কারবালার ঘটনা আশুরার ইতিহাসকে করেছে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। হজরত মুসা (আ.) যেমন অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এদিন বিজয়ী হয়েছিলেন, তদ্রূপ একই তারিখে হজরত হোসাইন (রা.) রক্তের আখরে লিখে গেছেন অত্যাচারী ও ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়া ইতিহাস।
কারণ, হজরত হোসাইন (রা.) নেতৃৃত্ব ও ক্ষমতার লালসায় কুফায় যাননি। কুফাবাসী তাঁর কাছে একের পর এক চিঠি ও প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইয়াজিদের অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে তাদের রক্ষা করার আকুতি জানিয়েছিল। তারা হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রবর্তিত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠাকল্পে তার হাতে বায়াত হওয়ার জন্য আগ্রহী ছিল। তিনি পারেননি মজলুমদের ফরিয়াদ শুনে চুপ থাকতে। তাই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কুফাবাসীকে স্বৈরশাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে।
তিনি গিয়েছিলেন ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, অগণতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের জুলুম ও নির্যাতনমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে। ৬১ হিজরির ১০ মহররম হজরত হোসাইন (সা.) পরিবারসহ শাহাদাতবরণ করেছেন। তবে অন্যায়-অবিচার ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা ছড়িয়ে গেছেন বিশ্বময়। যা অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত, মানবতাকে সব ধরনের জুলুম, নির্যাতন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাবে কিয়ামত পর্যন্ত।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.