পুরান ঢাকার উৎসব by মযহারুল ইসলাম বাবলা

রবি মহররম মাসের আগমনের সংবাদ ঘটা করে কারও পক্ষে জানার উপায় না থাকলেও পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়। পুরান ঢাকার সড়কে, মোড়ে, অলিগলিতে ঢাকঢোল পেটানোর শব্দে মহররম মাসের আগমনের সংবাদটি জানান দিয়ে যায়। এক সময় মহররমকেন্দ্রিক নানা আনুষ্ঠানিকতা ব্যাপকভাবে থাকলেও এখন আর তেমনটি নেই। ক্রমেই তা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। লুপ্ত হয়েছে একে একে প্রায় সবই।


পুরান ঢাকার সব উৎসব-পার্বণ ধর্মীয় দিনগুলোকে কেন্দ্র করে আগাগোড়া পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি যেভাবে পালিত হয়, জাতীয় অনুষ্ঠানাদি সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে আগের মতো আজ পালিত হয় না। পুরান ঢাকায় ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ আগের মতো আজ আর নেই। কালের বিবর্তনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তবে এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। বেশিরভাগই লুপ্তপ্রায়।
মহররম মাসের পহেলা তারিখ থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত দশ দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের সমারোহ পুরান ঢাকার সমাজ জীবনে বহমান থাকত। নিজ নিজ সন্তানের মঙ্গলার্থে মানত করে সন্তানদের বেহেস্তা করা হতো। বেহেস্তা মানে ইমাম হোসেনের স্বেচ্ছাসেবক-সৈনিক। যারা এই দশ দিন মাছ খাবে না। লাল-সবুজ জরি দেওয়া চিকন কাপড় গলায় বেঁধে রাখবে। পোশাকের ওপর নিম্নাংশে লালসালু লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে জরি বাদলার বিশেষ সাজ শরীরের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত জড়িয়ে, হাতে ত্রিকোণ লাল বা সবুজ রঙের পতাকা রঙ করা বাহারি সরু লাঠিতে বেঁধে মহররমকেন্দ্রিক মিছিলে নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকত। অনেকে নিজেদের শিশু-কিশোর বয়সী সন্তানদের মানত করে ভিক্ষুক বানিয়ে সবুজ কাপড় মাথায় পরিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়ে টাকা ও চাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে শিরনি রেঁধে বিলি করত। মহররমকেন্দ্রিক মানতের সীমা-পরিসীমা ছিল না। নানা উপলক্ষে মানতের এমন আধিক্য অন্য কোনো ধর্মীয় আচারে দেখা যেত না। মহররমের সব মিছিলে বেহেস্তাদের অংশগ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। আশুরার আগের রাতের শেষ দিকে হোসেনী দালান থেকে বিশাল মিছিল বের হতো। 'ভোররাতের মিছিল'খ্যাত মিছিলটি হোসেনী দালান থেকে শহরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণের সময় অত ভোরেও রাস্তায় ও বাড়ির ছাদে অগণিত মানুষ তা দেখতে ভিড় করত। মিছিল দেখা আনন্দের পাশাপাশি পুণ্য বলেই স্থানীয়রা জ্ঞান করত। আশুরার আগের রাতভর প্রদর্শিত হতো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় লাঠি, তলোয়ারসহ যুদ্ধের অনুকরণে নানা খেলা। স্থানীয় ভাষায় যুদ্ধ প্রদর্শনীর দলকে আখাড়ার দল বলা হতো। আখাড়ার দল পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকাব্যাপী সড়কের মোড়ে মোড়ে লাঠিখেলা, কুস্তি, ঢাল-তলোয়ার যুদ্ধসহ বিভিন্ন শারীরিক কসরত প্রদর্শন করত। এক দলের প্রদর্শনীর পর অপর দলের আগমন ঘটত। তাদের বিকট ঢোল-বাজনার শব্দ পেয়ে সবাই ছুটত একের পর এক আখাড়া দলের অনুষ্ঠান দেখতে। রাতব্যাপী পর্যায়ক্রমে আখাড়া দলের দৃষ্টিনন্দিত খেলা খুবই উপভোগ্য ছিল। দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়-পরিজনরা পুরান ঢাকায় ছুটে আসত আখাড়ার টানে।
তবে সময় পাল্টেছে। এখনও ভোররাতের মিছিল, তাজিয়া মিছিল, পাগলা গওড়া মিছিল হোসেনি দালান থেকে বের হয়ে শহরের স্বল্প আয়তনে প্রদক্ষিণ করে। তবে অতীতের মতো বিশালতায় মোটেও নয়। অনেকটা দায়সারা গোছের প্রাণহীনভাবে। আজিমপুরের মেলা স্বাধীনতার পরও চালু ছিল; কিন্তু গত বেশ ক'বছর ধরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার মহররমকেন্দ্রিক আয়োজন-অনুষ্ঠানগুলো এখন আর দেখা যায় না। কালের গর্ভে একে একে বিলীন হয়েছে। এ যেন হারানো পৃথিবীর হারানো সময়ের স্মৃতি মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.