পবিত্র মহররমের মহিমা by মাসুদা বেগম

সলামী বর্ষপরিক্রমার প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ হলো অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা নামে পরিচিত। মহানবী (সা.) স্বয়ং মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা নামে অভিহিত করেছেন। ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কারণে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মহররম একটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ মাস। এ মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলা হয়। পবিত্র হাদিস শরিফে এ মাসের রোজাকে মাহে রমজানের পর অধিক ফজিলতময় রোজা


হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নবীজি (সা.)-এর হিজরত করা থেকে আরবি সন গণনা শুরু হয়। মহররম মাস আরবি সনের প্রথম মাস।
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই পৃথিবীতে আগমন পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এ আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা এ দিনের সঙ্গে জড়িত।
৬১ হিজরির ১০ মহররম তারিখে বিশ্বের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বিশ্বনবীর নয়নমণি হজরত ফাতেমাতুজজোহরা (রা.)-এর কলিজার টুকরা আবু আবদুল্লাহ ইমাম হুসাইন (রা.) ওই দিবসে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বনবীর আদর্শে আদর্শবান স্বর্গীয় পুরুষ। হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন মানবতার মহান বন্ধু। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ও প্রিয় সাথি। আসাদুল্লাহিল গালিব হজরত আলী (রা.) ও খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি। তাই প্রতি বর্ষপরিক্রমায় এ মাস, এ দিনটি যখন মুসলমানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়, তখন প্রতিটি হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, প্রতিটি চক্ষু হয়ে ওঠে সিক্ত। প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষের হৃদয়ে আজও বেদনার অশ্রু ঝরতে থাকে। শাহাদাতে কারবালা সর্বোচ্চ আসন আজও সিক্ত করে আছে বিশ মুসলিমের হৃদয়ে।
১০ মহররম বর্তমান ইরাকের 'কুফা' নগরীর অদূরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবীজির (সা.) প্রিয়তম দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) পাষাণ হৃদয় ইয়াজিদের নিষ্ঠুর বাহিনীর কাছে বন্দি ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, 'তোমরা আল্লাহর মাস মহররমকে সম্মান করবে।'
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'রমজানের রোজার পর সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মহররমের রোজা।' (মুসলিম শরিফ, তিরমিজি, নাসায়ি, আবু দাউদ, বায়হাকি, আহমদ)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলেন, দেখলেন_মদিনার ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। এর কারণ তাদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এদিন আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদিন আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) এবং তাঁর সম্প্রদায় বনিইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন ও তার ওপর বিজয় দান করেছেন। আর এরই শুকরিয়া হিসেবে এদিন মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এদিন রোজা রাখি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী তোমাদের চেয়ে। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (বুখারি, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, আবু ইয়ালা, আহমদ)
শুধু ইহুদিরাই নয়, মক্কার কুরাইশরাও এই দিনে রোজা রাখত। এ সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, 'জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও আশুরার দিনে রোজা পালন করত।'
এদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও রোজা রেখেছেন এবং (সাহাবায়ে কেরামকে) রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা ফরজিয়াত রহিত হয়ে নফলে পরিণত হয়। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, বায়হাকি, আহমদ)
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন_'মহররম মাস আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও সেদিন অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন।
বিশ্বনবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'আমি আশাবাদী যে আশুরার রোজার উসিলায় আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।' (মুসলিম, প্রথম খণ্ড, ৩৬৭ পৃ., জামে তিরমিজি প্রথম খণ্ড-১৫৮ পৃ.)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, 'তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো।' (মুসনাদে আহমাদ-প্রথম খণ্ড, ২৪১ পৃ.)
রাসুলে আকরাম (সা.) মদিনা শরিফে হিজরতের আগেও এই রোজা রেখেছেন। মদিনা শরিফে তাশরিফ আনার পর তিনি এ রোজার ব্যাপারে আরো গুরুত্ব ও জোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, আগামী বছর আমি বেঁচে থাকলে ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ তারিখেও রোজা রাখব। কিন্তু তিনি সেই বছরই ওফাত লাভ করেন।
আশুরার এই পবিত্র দিনে অনেকে যেভাবে 'হায় হুসাইন!' 'হায় হুসাইন!' বলে মাতম জারি করে, 'ইয়া আলী' বলে ছুরি মারামারি করে, নিজের বুকের তাজা রক্ত ফেলে তাজিয়া নিয়ে মিছিল করে, বুক চাপড়ে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে, শোকমিছিল বের করে, খিচুড়ি রান্না করে, বিতরণ করে, লাল কাপড়ের পট্টি মাথায় বাঁধে, লাল কাপড় গলায় ঝুলিয়ে, ঢোল বাজিয়ে ছুরি-তলোয়ার নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধের ভণিতা ইত্যাদি করে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েজ ও বিদ'আত। ইমানদার ব্যক্তিদের এমন শরিয়তবিরোধী কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। এ ধরনের কাজ শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত ও গুনাহের কাজ।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ও নবীজি (সা.)-এর পূর্ণ আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

No comments

Powered by Blogger.