২৭ বছর পর ভাষা পেলেন প্রসেনজিৎ

বিরাম চেষ্টা আর লক্ষ্যে অটল থাকলে সাধারণ মানুষও যে অসাধ্য সাধন করতে পারে, সেটাই প্রমাণ করলেন কলকাতার কাঁচরাপাড়ার প্রসেনজিৎ দে। ২৭ বছর বয়সে প্রথম কথা বলতে শিখেছেন তিনি। দীর্ঘ 'মূক-সময়' অতিক্রম করে প্রবেশ করেছেন বাঙ্ময় পৃথিবীতে। জীবনে এই প্রথম অনুভব করলেন 'মা' আর 'বাবা' বলে ডাকতে কেমন লাগে!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ ঠোঁট নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করতেন তিনি। প্রথম সাত দিন শুধু ঠোঁট নড়েছে।


ক্ষীণ গুঁ-গুঁ শব্দ ছাড়া কিছুই বের হয়নি। চোয়াল আরো শক্ত হয়েছে প্রসেনজিতের। ধীরে ধীরে গোঙানি থেকে ঘসঘসে অস্পষ্ট, আধো কিছু শব্দ। দুই বছরের অবিরাম চেষ্টার পর অবশেষে বের হলো টানা বাক্য। চিকিৎসাশাস্ত্রকে জিতিয়ে দিয়ে ২৭ বছরে প্রথম কথা বলতে পারলেন প্রসেনজিৎ।
সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের ইএনটি (নাক, কান, গলা) বিভাগে বসে নিজের মুখে সেই ইতিবৃত্ত বলতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছিলেন প্রসেনজিৎ। পাশে বসা মা আল্পনা দে ও বাবা প্রাণবল্লভ দে-ও ভাসছিলেন চোখের জলে। ১৯৮৪ সালে ১৩ মাস বয়সে প্রসেনজিতের শ্বাসনালির ওপরের অংশে (ল্যারিংগস) বড় সিস্ট হয়। তাতে নিঃশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল। সেই সময়ে শব্দ ফোটেনি তাঁর গলায়। অস্ত্রোপচার করা হয় শ্বাসনালিতে। একটি ছিদ্র করে টিউব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে ট্র্যাকিওস্টোমি। অস্ত্রোপচারের পরে কিছু দিন ওই টিউবের মাধ্যমেই শ্বাস নেন তিনি। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পরে পাইপ বের করতেই দেখা যায়, অস্ত্রোপচারের ত্রুটিতে শ্বাসনালি আরো সংকুচিত হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভোকাল কর্ডও। প্রাণ বাঁচাতে ফের গলার কাছে ছিদ্র করে টিউব ঢোকানো হয় শ্বাসনালিতে। কিন্তু কথা আর বলা হয়নি। প্রসেনজিতের নিজের কথায়, 'কানে তো সব শুনতে পেতাম। বলতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সব কথাই ট্র্যাকিওস্টোমির ফুটো দিয়ে বাতাসের সঙ্গে বেরিয়ে যেত।' এভাবেই কাটে ২৫টি বছর।
প্রসেনজিৎ বলেন, 'বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগই কেটে যাচ্ছিল। সবাই যখন হুল্লোড় করছে, আমাকে তখন চুপ করে শুধু দেখতে হতো। লজ্জায় আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, অনুষ্ঠানেও যেতাম না।' কলেজে ছেলেরা এত টিটকিরি করত যে, ফার্স্ট ইয়ারের বেশি আর পড়তেও পারেননি তিনি। তবু হার মানেননি। একদিন ঠিকই কথা বলতে পারবেন_সেই স্বপ্ন দেখাও ছাড়েননি প্রসেনজিৎ।
প্রসেনজিতের বর্তমান চিকিৎসক কৌশিক দাস জানান, ২০০৮-০৯ মিলিয়ে মোট তিনটি এন্ডোলেজার অস্ত্রোপচার হয় প্রসেনজিতের শ্বাসনালিতে। অবশেষে ট্র্যাকিওস্টোমির টিউব খোলা যায়। তারপরে আরো বড় চ্যালেঞ্জ। ২৭ বছরের ছেলেকে কথা বলতে শেখানো। অক্ষরের যথাযথ উচ্চারণ রপ্ত করানো। ২০০৯ থেকে চেষ্টা করতে করতে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম স্পষ্ট কথা বলতে পারলেন প্রসেনজিৎ। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।

No comments

Powered by Blogger.