কালান্তরের কড়চা-'বিএনপি নৈবেদ্য সাজিয়েছিল ভালোই কিন্তু গণদেবতা তা গ্রহণ করেনি' by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার প্রতিবাদে বিএনপি ৪ ডিসেম্বর রবিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। আমার যেন কেন মনে হয়েছিল, এমন একটি পপুলার ইস্যুতে ডাকা হরতাল সফল না হয়ে যায় না। আমি শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধীদের নয়, সমর্থকদের অনেককেও ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা সম্পর্কে অভিমত জানতে চেয়ে একজনের কাছ থেকেও সমর্থনসূচক মন্তব্য পাইনি। সবাই সখেদে বলেছেন, 'নেই কাজ তো খই ভাজ।
আওয়ামী লীগ সরকারের হয়েছে সেই অবস্থা। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ ত্বরান্বিত করা_এসব শিকায় ঝুলিয়ে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা ইত্যাদি এ মুহূর্তের অপ্রয়োজনীয় কাজে হাত দিয়ে বিরোধী দলের জন্য মাঠ গরম করার একটার পর একটা ইস্যু সরকারই তৈরি করে দিচ্ছে।'
বিএনপি আপ্রাণ চেষ্টা করছে নানা ধরনের ইস্যু, নন-ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার। পারছে না। শর্টমার্চ, লংমার্চ_কোনোটাতেই কাজ হচ্ছে না। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনকে হঠাৎ সরকারের রাজনৈতিক মর্জিমাফিক ভাগ করে ফেলা ঢাকার নাগরিক মাত্রেরই আবেগ-অনুভূতিতে গভীরভাবে আঘাত দিয়েছে। এই আঘাতের গভীরতা সুদূর লন্ডনে বসেও অনুভব করেছি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বারবার অনুরোধ করেছি, এই মুহূর্তে ঢাকা ভাগ করা নয়। তিনি আমার কেন, কারো অনুরোধেই কান দেননি। ক্ষমতার দম্ভ এমনই দম্ভ, যা ক্ষমতাসীনকে কিছুই বুঝতে দেয় না, কিছুই দেখতে দেয় না।
আমার তাই ভয় হয়েছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা এমন একটি ইস্যু, যে ইস্যুতে বিএনপি হরতাল ডাকার সুযোগ হাতছাড়া করবে না এবং এই হরতালে নতুন ও পুরনো ঢাকার মানুষ এককাট্টা হয়ে যোগ দিয়ে গোটা নগর অচল ও স্তব্ধ করে দেবে। আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী-উপদেষ্টারা হয়তো ঘরের বাইরেই যেতে পারবেন না।
এই আশঙ্কায় ৩ ডিসেম্বর শনিবারের রাতটা প্রায় বিনিদ্র কাটিয়েছি বলা চলে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই টিভি খুলেছি, টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়েছি। ঢাকায় তখন দুপুর। সুতরাং হরতালের হালহকিকত জানতে পারব। সাধারণত সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজনীতিক ও কলামিস্ট বন্ধু মোনায়েম সরকারকে টেলিফোন করি। রবিবার লন্ডনের সময় সকালে তাঁর টেলিফোন প্রথমে এনগেজড পেলাম। তাঁকে না পেয়ে একজন সাধারণ ব্যবসায়ী বন্ধুকে টেলিফোন করলাম। বিজয়েশ্বর রায়। আমার কলেজজীবনের বন্ধু। হরতালের অবস্থা কী জানতে চাইতেই তিনি বললেন, 'বিএনপি তার পূজার নৈবেদ্য ভালোই সাজিয়েছিল, কিন্তু গণদেবতা তা গ্রহণ করেননি।'
তাঁর কথার অর্থ বুঝতে আমার দেরি হয়নি। ঢাকা ভাগ করায় দলমত নির্বিশেষে নগরবাসী ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। কিন্তু এমন একটা ইস্যুতেও বিএনপির ডাকা হরতালে তারা সাড়া দেয়নি। কারণ ঢাকা সিটি করপোরেশন দীর্ঘ ৯ বছর ছিল বিএনপির কবজায়। তাদের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা তাঁর মেয়র পদে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত কৃপায় দীর্ঘদিন মেয়র পদে ছিলেন। তার পরও নগরবাসীর জীবনে সামান্য সুখ-সুবিধা বাড়াতে কী করেছেন অথবা করতে পেরেছেন, তা গবেষণার বিষয়। তিনিও রবিবারের হরতালে নাকি রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। ধরে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
অর্থাৎ হরতাল সফল হয়নি। যে শিথিল হরতাল হয়েছে, তাকে হরতাল না বলে ডরতাল অথবা ভয়তাল বলা চলে। বিএনপি-জামায়াতের ক্যাঙ্গারু ক্যাডারদের হাতে গাড়ি-দোকান ভস্মীভূত হবে_এই ভয়ে অনেকে দোকানপাট খোলেননি অথবা রাস্তায় গাড়ি বের করেননি। এবারের হরতালে গাড়ি-বাস পোড়ানো বা দোকানপাটে ভাঙচুরের তেমন খবর পাইনি। তাতে মনে হয়, হরতালের নামে অরাজকতা সৃষ্টিতে বাধা দিতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। পুলিশের প্রি-এমটিভ অ্যাকশনের ভয়ে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার বাবাজিরা এবার হয়তো কল্লা বের করার সাহস পায়নি। কিছুমাত্র জনসমর্থনের আভাস পেলে তারা বের করত।
এখন প্রশ্ন, ঢাকা বিভক্তকরণের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকরাও যেখানে ক্ষুব্ধ, সেখানে এমন একটি ইস্যু নিয়েও বিএনপি একটি সফল হরতাল করতে পারল না কেন? আমি এই প্রশ্নটি ঢাকার কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুকে করেছিলাম। তাঁরা বললেন, ৪ ডিসেম্বরের হরতালে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা যথার্থ চিত্র ফুটে উঠেছে। এই চিত্রটি হলো, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু বিএনপির জনপ্রিয়তা এক ছটাকও বাড়েনি। রোডমার্চের রোডশোর তামাশা দেখতে আসা জনতার বিপুল ভিড়কে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়ার ব্যারোমিটার ভাবলে ভুল করা হবে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ট; কিন্তু বিএনপির প্রতি সন্তুষ্ট নয়। বিএনপি-জামায়াতের অপশাসনের ভয়াবহ স্মৃতি তারা এখনো ভোলেনি। খালেদা জিয়া সারা দেশে যতই রণরঙ্গিনী বেশে নেচে-কুঁদে বেড়ান না কেন, তাতে 'ভবি ভুলবার নয়'।
দেশ শাসনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পারফরম্যান্স যত খারাপ হোক, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির পারফরম্যান্স আরো হতাশাব্যঞ্জক। কিছু নন-ইস্যু এবং ভারতবিদ্বেষী প্রচার ছাড়া তাদের রাজনৈতিক মূলধন বলতে কিছুই নেই। সঠিক কর্মসূচিও নেই। দলে নতুন মুখেরও আবির্ভাব নেই। তারেক রহমানের দোসরদেরই রাজত্ব এখনো চলছে। খোন্দকার দেলোয়ারের মৃত্যুর পর যে মির্জা ফখরুল ইসলামকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়েছে তিনি নতুন মুখ নন। তাঁর বাবার ১৯৭১ সালের ভূমিকা বিতর্কিত এবং ছেলে ফখরুল ইসলামেরও রাজনীতি তথৈবচ। তিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপিতে এসব লোককেই সব সময় সংগ্রহ করা হয়, যাদের চরিত্রে অহংকার করার মতো কিছু নেই; কিন্তু গলাবাজির অহংকার আছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ও রাজনৈতিক মূলধনশূন্য বিএনপির এখন একটি মাত্র তুরুপের তাস তারেক রহমানের আশু দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রচার এবং তারেকই যে দেশের ভাবী নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও, দেশবাসীকে অহরহ এই 'সুসমাচার' জানানো। কিন্তু খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির প্রত্যেক নেতা জানেন, হাওয়া ভবনের অধীশ্বর হিসেবে তারেক রহমান এতই নৈতিক বলশূন্য হয়ে পড়েছেন যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত দেশে ফিরে আসার সাহস তাঁর নেই।
সেই সাহস তাঁর থাকলে তিনি বহু আগে দেশে ফিরে এসে সম্ভাব্য জেল-জুলুম বরণ করে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করে দেশের মানুষের আস্থা ও সম্মান কুড়াতেন এবং যথার্থই বীর নেতা হিসেবে পরিচিত হতেন। কিন্তু তিনি অনির্দিষ্টকাল ধরে মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে বিদেশে লুকিয়ে থাকায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কোনো অভিযোগ বিদেশি আদালতেও উত্থাপিত ও প্রচারিত হওয়ায় দেশে কোনো দিন রাজনীতির হাওয়া ঘুরলে তিনি বীরপূজা পাবেন, সে আশা বৃথা।
৪ ডিসেম্বরের শিথিল অথবা ব্যর্থ হরতাল এই সত্যটি তুলে ধরেছে, সরকারের ওপর নাগরিক সমাজের ক্ষোভ আছে, কিন্তু বিএনপিকে তারা বিশ্বাস করে না। তাই কোনো পপুলার ইস্যু নিয়ে বিএনপি হরতাল ডাকলেও সাধারণ মানুষ তাতে সাড়া দেয় না। ভবিষ্যতেও দেবে না, যদি বিএনপি তার চরিত্র, চেহারা ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি না বদলায়। জামায়াত ও মৌলবাদী অপশক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত ভেঙে না দেয়।
৪ ডিসেম্বরের এই তথাকথিত হরতাল আরো একটি সত্য আরো প্রকটভাবে তুলে ধরেছে যে বাংলাদেশে হরতাল আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনো অস্ত্র নয়। হরতালের শক্তি নিঃশেষ এবং পদ্ধতিটিও বাসি হয়ে গেছে। জনসাধারণের কাছে হরতালের আর কোনো আবেদন নেই। এককালে বাংলাদেশে হরতাল সত্যিই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র ছিল। কিন্তু তার অতিব্যবহার এবং তুচ্ছ ছুতো-নাতাতেও তার বারংবার ব্যবহারে অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে গেছে। এই ভোঁতা অস্ত্র হাতে নিয়ে বিএনপি কথায় কথায় রাজপথে নেমে কিছু লোককে ভয় দেখাতে পারবে, জনসমর্থন আদায় করতে পারবে না।
তবে ৪ ডিসেম্বরের হরতাল সফল না হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষেও খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা যেন না ভাবে, ঢাকার মানুষ সর্বাত্মকভাবে হরতালে যোগ দেয়নি বলে ঢাকা বিভক্তকরণ মেনে নিয়েছে। তারা মেনে নেয়নি। নির্বাক জনগণের নাড়ির স্পন্দন যদি আওয়ামী লীগ সরকার বুঝতে না পেরে থাকে, তাহলে বলব, তারা গণসম্পৃক্ততা হারিয়েছে। জনগণ ব্যাপকভাবে হরতালে যায়নি, বিএনপিকে সমর্থন দেয়নি। তার অর্থ এই নয়, তারা সরকারের ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপকে সমর্থন করে। অবিস্ফোরিত বোমা যেমন বিপজ্জনক, অবিস্ফোরিত জনক্ষোভ তার চেয়েও ভয়ংকর। এটা একটা বিস্ময়কর পিপলস সাইকি বা জনমনস্তত্ত্ব যে কখনো কখনো কোনো সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে স্বীকৃতি না দিলে তারা সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে না। তারা অপেক্ষা করে। তারপর ভোটের দিনটি যখন আসে, তখন ব্যালটের চূড়ান্ত অস্ত্রটি তারা প্রয়োগ করে হতবাক সরকারের বিরুদ্ধে। সরকার তখন তার হঠকারিতার চরম মূল্য দেয়।
এটা ঘটেছিল ভারতের একটি সাধারণ নির্বাচনেও। বিজেপি দিলি্লর মসনদে বসে তাদের সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী বহু কাজের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ না দেখে ভেবেছিল, তাদের কাজে দেশের মানুষ সন্তুষ্ট। আত্মপ্রতারিত বিজেপির আদভানি 'ইন্ডিয়া শাইনিং' নাম দিয়ে এক বিরাট 'রাজনৈতিক উৎসব মিছিল' বের করেছিলেন নির্বাচনের আগে। তাতে লাখ লাখ নর-নারী এসে জমায়েতও হয়েছিল। তারপর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন হলো। দেখা গেল বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসী প্রতিশোধ নিয়েছে ব্যালটে। দিলি্লর তখতে তাউস থেকে বিজেপি শোচনীয়ভাবে উৎখাত হয়ে গেল।
'কথায় বলে, কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে।' আওয়ামী লীগ দেখেও শেখে না, ঠেকেও শেখে না। ৪ ডিসেম্বরের হরতালের হাল দেখে তারা খুশি হবে, আত্মপ্রতারিত হবে। কোনো শিক্ষা নেবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তকরণের ব্যাপারে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে কোনো দাম না দেওয়ায় তারা মনের ক্ষোভ আপাতত মনে চেপে রেখে বিএনপির হরতালে সাড়া না দিতে পারে; কিন্তু ভবিষ্যৎ ভোটের দিনটিতে ব্যালটের সাহায্যে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এখনো সময় আছে। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তারা দাম দিক। নইলে ভবিষ্যতে সেই ভুলের মাসুল কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হবে।
লন্ডন, ৫ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১১
বিএনপি আপ্রাণ চেষ্টা করছে নানা ধরনের ইস্যু, নন-ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার। পারছে না। শর্টমার্চ, লংমার্চ_কোনোটাতেই কাজ হচ্ছে না। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনকে হঠাৎ সরকারের রাজনৈতিক মর্জিমাফিক ভাগ করে ফেলা ঢাকার নাগরিক মাত্রেরই আবেগ-অনুভূতিতে গভীরভাবে আঘাত দিয়েছে। এই আঘাতের গভীরতা সুদূর লন্ডনে বসেও অনুভব করেছি। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বারবার অনুরোধ করেছি, এই মুহূর্তে ঢাকা ভাগ করা নয়। তিনি আমার কেন, কারো অনুরোধেই কান দেননি। ক্ষমতার দম্ভ এমনই দম্ভ, যা ক্ষমতাসীনকে কিছুই বুঝতে দেয় না, কিছুই দেখতে দেয় না।
আমার তাই ভয় হয়েছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা এমন একটি ইস্যু, যে ইস্যুতে বিএনপি হরতাল ডাকার সুযোগ হাতছাড়া করবে না এবং এই হরতালে নতুন ও পুরনো ঢাকার মানুষ এককাট্টা হয়ে যোগ দিয়ে গোটা নগর অচল ও স্তব্ধ করে দেবে। আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী-উপদেষ্টারা হয়তো ঘরের বাইরেই যেতে পারবেন না।
এই আশঙ্কায় ৩ ডিসেম্বর শনিবারের রাতটা প্রায় বিনিদ্র কাটিয়েছি বলা চলে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই টিভি খুলেছি, টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়েছি। ঢাকায় তখন দুপুর। সুতরাং হরতালের হালহকিকত জানতে পারব। সাধারণত সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজনীতিক ও কলামিস্ট বন্ধু মোনায়েম সরকারকে টেলিফোন করি। রবিবার লন্ডনের সময় সকালে তাঁর টেলিফোন প্রথমে এনগেজড পেলাম। তাঁকে না পেয়ে একজন সাধারণ ব্যবসায়ী বন্ধুকে টেলিফোন করলাম। বিজয়েশ্বর রায়। আমার কলেজজীবনের বন্ধু। হরতালের অবস্থা কী জানতে চাইতেই তিনি বললেন, 'বিএনপি তার পূজার নৈবেদ্য ভালোই সাজিয়েছিল, কিন্তু গণদেবতা তা গ্রহণ করেননি।'
তাঁর কথার অর্থ বুঝতে আমার দেরি হয়নি। ঢাকা ভাগ করায় দলমত নির্বিশেষে নগরবাসী ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। কিন্তু এমন একটা ইস্যুতেও বিএনপির ডাকা হরতালে তারা সাড়া দেয়নি। কারণ ঢাকা সিটি করপোরেশন দীর্ঘ ৯ বছর ছিল বিএনপির কবজায়। তাদের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা তাঁর মেয়র পদে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত কৃপায় দীর্ঘদিন মেয়র পদে ছিলেন। তার পরও নগরবাসীর জীবনে সামান্য সুখ-সুবিধা বাড়াতে কী করেছেন অথবা করতে পেরেছেন, তা গবেষণার বিষয়। তিনিও রবিবারের হরতালে নাকি রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। ধরে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
অর্থাৎ হরতাল সফল হয়নি। যে শিথিল হরতাল হয়েছে, তাকে হরতাল না বলে ডরতাল অথবা ভয়তাল বলা চলে। বিএনপি-জামায়াতের ক্যাঙ্গারু ক্যাডারদের হাতে গাড়ি-দোকান ভস্মীভূত হবে_এই ভয়ে অনেকে দোকানপাট খোলেননি অথবা রাস্তায় গাড়ি বের করেননি। এবারের হরতালে গাড়ি-বাস পোড়ানো বা দোকানপাটে ভাঙচুরের তেমন খবর পাইনি। তাতে মনে হয়, হরতালের নামে অরাজকতা সৃষ্টিতে বাধা দিতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। পুলিশের প্রি-এমটিভ অ্যাকশনের ভয়ে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার বাবাজিরা এবার হয়তো কল্লা বের করার সাহস পায়নি। কিছুমাত্র জনসমর্থনের আভাস পেলে তারা বের করত।
এখন প্রশ্ন, ঢাকা বিভক্তকরণের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকরাও যেখানে ক্ষুব্ধ, সেখানে এমন একটি ইস্যু নিয়েও বিএনপি একটি সফল হরতাল করতে পারল না কেন? আমি এই প্রশ্নটি ঢাকার কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুকে করেছিলাম। তাঁরা বললেন, ৪ ডিসেম্বরের হরতালে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা যথার্থ চিত্র ফুটে উঠেছে। এই চিত্রটি হলো, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু বিএনপির জনপ্রিয়তা এক ছটাকও বাড়েনি। রোডমার্চের রোডশোর তামাশা দেখতে আসা জনতার বিপুল ভিড়কে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়ার ব্যারোমিটার ভাবলে ভুল করা হবে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তুষ্ট; কিন্তু বিএনপির প্রতি সন্তুষ্ট নয়। বিএনপি-জামায়াতের অপশাসনের ভয়াবহ স্মৃতি তারা এখনো ভোলেনি। খালেদা জিয়া সারা দেশে যতই রণরঙ্গিনী বেশে নেচে-কুঁদে বেড়ান না কেন, তাতে 'ভবি ভুলবার নয়'।
দেশ শাসনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পারফরম্যান্স যত খারাপ হোক, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির পারফরম্যান্স আরো হতাশাব্যঞ্জক। কিছু নন-ইস্যু এবং ভারতবিদ্বেষী প্রচার ছাড়া তাদের রাজনৈতিক মূলধন বলতে কিছুই নেই। সঠিক কর্মসূচিও নেই। দলে নতুন মুখেরও আবির্ভাব নেই। তারেক রহমানের দোসরদেরই রাজত্ব এখনো চলছে। খোন্দকার দেলোয়ারের মৃত্যুর পর যে মির্জা ফখরুল ইসলামকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়েছে তিনি নতুন মুখ নন। তাঁর বাবার ১৯৭১ সালের ভূমিকা বিতর্কিত এবং ছেলে ফখরুল ইসলামেরও রাজনীতি তথৈবচ। তিনি বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপিতে এসব লোককেই সব সময় সংগ্রহ করা হয়, যাদের চরিত্রে অহংকার করার মতো কিছু নেই; কিন্তু গলাবাজির অহংকার আছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ও রাজনৈতিক মূলধনশূন্য বিএনপির এখন একটি মাত্র তুরুপের তাস তারেক রহমানের আশু দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রচার এবং তারেকই যে দেশের ভাবী নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও, দেশবাসীকে অহরহ এই 'সুসমাচার' জানানো। কিন্তু খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির প্রত্যেক নেতা জানেন, হাওয়া ভবনের অধীশ্বর হিসেবে তারেক রহমান এতই নৈতিক বলশূন্য হয়ে পড়েছেন যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত দেশে ফিরে আসার সাহস তাঁর নেই।
সেই সাহস তাঁর থাকলে তিনি বহু আগে দেশে ফিরে এসে সম্ভাব্য জেল-জুলুম বরণ করে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করে দেশের মানুষের আস্থা ও সম্মান কুড়াতেন এবং যথার্থই বীর নেতা হিসেবে পরিচিত হতেন। কিন্তু তিনি অনির্দিষ্টকাল ধরে মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে বিদেশে লুকিয়ে থাকায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কোনো অভিযোগ বিদেশি আদালতেও উত্থাপিত ও প্রচারিত হওয়ায় দেশে কোনো দিন রাজনীতির হাওয়া ঘুরলে তিনি বীরপূজা পাবেন, সে আশা বৃথা।
৪ ডিসেম্বরের শিথিল অথবা ব্যর্থ হরতাল এই সত্যটি তুলে ধরেছে, সরকারের ওপর নাগরিক সমাজের ক্ষোভ আছে, কিন্তু বিএনপিকে তারা বিশ্বাস করে না। তাই কোনো পপুলার ইস্যু নিয়ে বিএনপি হরতাল ডাকলেও সাধারণ মানুষ তাতে সাড়া দেয় না। ভবিষ্যতেও দেবে না, যদি বিএনপি তার চরিত্র, চেহারা ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি না বদলায়। জামায়াত ও মৌলবাদী অপশক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত ভেঙে না দেয়।
৪ ডিসেম্বরের এই তথাকথিত হরতাল আরো একটি সত্য আরো প্রকটভাবে তুলে ধরেছে যে বাংলাদেশে হরতাল আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনো অস্ত্র নয়। হরতালের শক্তি নিঃশেষ এবং পদ্ধতিটিও বাসি হয়ে গেছে। জনসাধারণের কাছে হরতালের আর কোনো আবেদন নেই। এককালে বাংলাদেশে হরতাল সত্যিই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র ছিল। কিন্তু তার অতিব্যবহার এবং তুচ্ছ ছুতো-নাতাতেও তার বারংবার ব্যবহারে অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে গেছে। এই ভোঁতা অস্ত্র হাতে নিয়ে বিএনপি কথায় কথায় রাজপথে নেমে কিছু লোককে ভয় দেখাতে পারবে, জনসমর্থন আদায় করতে পারবে না।
তবে ৪ ডিসেম্বরের হরতাল সফল না হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষেও খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারা যেন না ভাবে, ঢাকার মানুষ সর্বাত্মকভাবে হরতালে যোগ দেয়নি বলে ঢাকা বিভক্তকরণ মেনে নিয়েছে। তারা মেনে নেয়নি। নির্বাক জনগণের নাড়ির স্পন্দন যদি আওয়ামী লীগ সরকার বুঝতে না পেরে থাকে, তাহলে বলব, তারা গণসম্পৃক্ততা হারিয়েছে। জনগণ ব্যাপকভাবে হরতালে যায়নি, বিএনপিকে সমর্থন দেয়নি। তার অর্থ এই নয়, তারা সরকারের ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপকে সমর্থন করে। অবিস্ফোরিত বোমা যেমন বিপজ্জনক, অবিস্ফোরিত জনক্ষোভ তার চেয়েও ভয়ংকর। এটা একটা বিস্ময়কর পিপলস সাইকি বা জনমনস্তত্ত্ব যে কখনো কখনো কোনো সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে স্বীকৃতি না দিলে তারা সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে না। তারা অপেক্ষা করে। তারপর ভোটের দিনটি যখন আসে, তখন ব্যালটের চূড়ান্ত অস্ত্রটি তারা প্রয়োগ করে হতবাক সরকারের বিরুদ্ধে। সরকার তখন তার হঠকারিতার চরম মূল্য দেয়।
এটা ঘটেছিল ভারতের একটি সাধারণ নির্বাচনেও। বিজেপি দিলি্লর মসনদে বসে তাদের সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী বহু কাজের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ না দেখে ভেবেছিল, তাদের কাজে দেশের মানুষ সন্তুষ্ট। আত্মপ্রতারিত বিজেপির আদভানি 'ইন্ডিয়া শাইনিং' নাম দিয়ে এক বিরাট 'রাজনৈতিক উৎসব মিছিল' বের করেছিলেন নির্বাচনের আগে। তাতে লাখ লাখ নর-নারী এসে জমায়েতও হয়েছিল। তারপর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন হলো। দেখা গেল বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসী প্রতিশোধ নিয়েছে ব্যালটে। দিলি্লর তখতে তাউস থেকে বিজেপি শোচনীয়ভাবে উৎখাত হয়ে গেল।
'কথায় বলে, কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে।' আওয়ামী লীগ দেখেও শেখে না, ঠেকেও শেখে না। ৪ ডিসেম্বরের হরতালের হাল দেখে তারা খুশি হবে, আত্মপ্রতারিত হবে। কোনো শিক্ষা নেবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তকরণের ব্যাপারে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে কোনো দাম না দেওয়ায় তারা মনের ক্ষোভ আপাতত মনে চেপে রেখে বিএনপির হরতালে সাড়া না দিতে পারে; কিন্তু ভবিষ্যৎ ভোটের দিনটিতে ব্যালটের সাহায্যে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এখনো সময় আছে। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তারা দাম দিক। নইলে ভবিষ্যতে সেই ভুলের মাসুল কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হবে।
লন্ডন, ৫ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১১
No comments