আত্মহত্যা না হত্যা-সাঈদের লাশ প্রিজন সেলে

ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলের বাথরুম থেকে গতকাল সোমবার ভোর ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাঈদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ২৩ নভেম্বর থেকে কারা হেফাজতে সাঈদ বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রুমানাকে নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ জুন রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে সাঈদকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে সাঈদকে কারাগারে পাঠানো হয়।


কেন, কীভাবে সাঈদের মৃত্যু হয়েছে_ গতকাল রাত পর্যন্ত এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। রহস্যে ঘেরা রয়েছে তার এই অস্বাভাবিক মৃত্যু। মৃতের দু'হাতের কব্জিতে কালচে দাগ ছিল। শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। নিহতের পরিবারের সদস্যরাও সাঈদের মৃত্যুরহস্যের উত্তর খুঁজছেন। তারা বলছেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডাক্তারি রিপোর্টে বলা হয়, 'সাসপেকটেড কেস অব কার্ডিও অ্যারেস্ট'। বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত পরিচালক জামাল উদ্দিন খলিফা সাংবাদিককের জানান, চোখের সমস্যা নিয়ে কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন ছিলেন সাঈদ। আমরা শুধু ওষুধ সরবরাহ করেছি। সব দেখভাল করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। কীভাবে হাতে দাগ
এলো_ এ ব্যাপারে জামাল বলেন, অনেকে নানা ধরনের কথা বলছেন। এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে বিষয়টি জানা যাবে।
কারা উপ-মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, 'কার্ডিয়াক ফেইলিয়রে' সাঈদ মারা গেছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি মানসিক অস্থিরতায় ছিলেন। বাথরুমে পড়ে থাকা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া গেছে।
সাঈদের ছোট ভাই ফারুক সাঈদ সমকালকে বলেন, সকাল ৮টার দিকে জেলার ফোন করে আমার বাবাকে জানান, সাঈদের লাশ বাথরুমে কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার মুখ পলিথিনে প্যাঁচানো ছিল। আমার ভাইয়ের চোখ ছাড়া অন্য কোথাও সমস্যা ছিল না। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা মামলা করব।
নিহতের খালু রফিক উদ্দিন সমকালকে বলেন, মানসিক যন্ত্রণা থেকেই তার এ মৃত্যু হতে পারে। তবে এটি হত্যা, না আত্মহত্যা_ এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না।
সাঈদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সকাল থেকে বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলের সামনে সংবাদকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। নিহতের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে ওই এলাকার পরিবেশ। সাঈদের পিতা অভিযোগ করেছেন মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। দুপুর দেড়টায় লাশের সুরতহাল করেন ম্যাজিস্ট্রেট শামীমা খন্দকার। তিনি সমকালকে বলেন, সুইসাইড বলে মনে হচ্ছে না। নরমাল মৃত্যু। দু'হাতেই সরু রশির দাগ রয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
বিকেল ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. আ খ ম শফিউজ্জামান মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, তার মৃত্যু কী কারণে হয়েছে তা নিশ্চিত করে এখনও বলা যাচ্ছে না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাসায়নিক পরীক্ষা করতে ভিসেরা মহাখালীতে পাঠানো হয়েছে। আর হার্ট পরীক্ষা করা হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হিস্টোপ্যাথলজি বিভাগে।
কারারক্ষী তাহের উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, হাসান সাঈদ ও ইউসুফ নামে বিজিবির এক সাজাপ্রাপ্ত জওয়ান বিএসএমএমইউর দোতলায় একটি কক্ষে একই সঙ্গে ছিলেন। ভোরে সাঈদকে তার কক্ষে না পেয়ে ইউসুফের কাছে খোঁজ নেন এক কারারক্ষী। এরপর ইউসুফ জানায়, সাঈদ বাথরুমে ঢুকেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে বাথরুম থেকে তিনি বের হচ্ছেন না। পরে বাথরুমে গিয়ে দেখা যায়, প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা হাসান সাঈদের মৃতদেহ পড়ে আছে। চারতলার প্রিজন সেলে এক হাবিলদারের নেতৃত্বে ১১ কারারক্ষী ও চার পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। সাঈদ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শফিকুল ইসলামের অধীনে ভর্তি হন। তার চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করেন ডা. পল্লব কুমার সেন। দুপুর ২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি অ্যাম্বুলেন্সে সাঈদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সাঈদের মৃত্যুর খবর পেয়ে উৎসুক লোকজন বিএসএমএমইউতে ভিড় জমান। সকাল থেকে প্রিজন সেলের সামনে ছিল নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া পাহারা। কোনো সংবাদকর্মীকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি :কিছু প্রশ্নের উত্তর না মেলায় কারা হেফাজতে সাঈদের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে সাঈদের দু'কব্জিতে রশির দাগের চিহ্ন এলো? দীর্ঘদিন তিনি হ্যান্ডকাফ পরেন না। হাতের দাগ হ্যান্ডকাফেরও নয়। এ ছাড়া কম্বল নিয়ে কারোই বাথরুমে যাওয়ার কথা নয়। এমনকি বাথরুমে চিকিৎসাধীন আসামিদের সার্বক্ষণিক দেখভাল ও নজরদারিতে রাখার বিধান রয়েছে। দীর্ঘ সময় শয়নকক্ষে অনুপস্থিত থাকলেও কারারক্ষীরা কেন প্রথম থেকে তার খোঁজ নেননি? পরিবারের পক্ষ থেকেও বলা হয়, সাঈদের গুরুতর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না। সেক্ষেত্রে হঠাৎ তার এমন মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল।
স্বজনদের আহাজারি : সাঈদের মৃত্যুর খবর পেয়ে সকাল থেকেই স্বজনরা প্রিজন সেলের সামনে জড়ো হন। সাঈদের বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সাঈদ আহমেদ কবীর, মা হাসিনা আহমেদ কবীর, ছোট ভাই ফারুক সাঈদ, খালু রফিক উদ্দিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বজনদের আহাজারিতে প্রিজন সেলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। একতরফা সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে তারা সংবাদকর্মীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে সাঈদের মৃত্যু সম্পর্কে প্রথমে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে সাঈদের বাবা বলেন, রুমানা মঞ্জুর ছিল আত্মস্বীকৃত ব্যভিচারিণী। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী মিডিয়া। অথচ রুমানা মঞ্জুরের সবকিছু ঠিক আছে। এখনও সে সব দেখতে পায়। মিডিয়ার সামনে এলে সে চোখে কালো চশমা দিয়ে আসে। এ ঘটনার নেপথ্যে কী ছিল তা নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ না করে একতরফা রিপোর্ট লিখেছেন সংবাদকর্মীরা। কিছু নারীবাদীর কারণে আমরা অবিচারের শিকার হয়েছি। আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচারের ভার দিলাম।
যেভাবে আছে মামলাটি : রুমানা মঞ্জুরকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি ডিবি তদন্ত করছে। ডিবির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সাঈদ অসুস্থ থাকায় সর্বশেষ তাকে আমরা জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়েছিলাম। তবে এ আবেদনের শুনানি হওয়ার আগেই সাঈদের মৃত্যু হলো। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমকালকে বলেন, আদালতে এখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) পেশ করা হবে। এর আগে তিনি জানান, সাঈদ আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে রুমানাকে 'মারধরের' কথা স্বীকার করলেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তার বক্তব্য, ঘটনার সময় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তবে তিনি রুমানার চোখ নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী নন। রুমানা বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য রেকর্ড করা যায়নি। পাশাপাশি তার দু'চোখ নষ্ট হওয়ার ডাক্তারি সনদ এখনও তারা হাতে পাননি।
অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসায় ৫ জুন স্বামী হাসান সাঈদের নির্যাতনের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর। এ ঘটনার পরদিন রুমানাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে তার বাবা মনজুর হোসেন বাদী হয়ে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন। এরপর ১৫ জুন সাঈদকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেদিন দুপুরেই ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি) রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে সাঈদকে গ্রেফতার করে। পরে সাঈদকে চার দফায় ছয় দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। তার জামিনের জন্য চারবার আবেদন করা হলেও আদালত তা নাকচ করেন। এদিকে ১৫ জুলাই কানাডার ভ্যানকুভার জেনারেল হাসপাতালে রুমানার চোখে অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা জানান, তিনি আর কোনোদিনই দেখতে পাবেন না।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আলতাফ হোসেন সমকালকে বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আগে সাঈদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত মন্তব্য করা যাবে না। তবে সেখানে কর্তব্যরত কারা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার পরও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সে সময় দায়িত্ব পালনকারীদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলার মাহবুবুল ইসলাম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.