মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ স্বৈরাচার যোগ স্বৈরাচার
আজ ৬ ডিসেম্বর তারিখে ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের নয় বছরব্যাপী স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের পতনের গৌরবোজ্জ্বল দিনটি পালিত হচ্ছে। লক্ষ্য করবার বিষয়, গত দু’বছর ধরে দিবসটি পালনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো উত্সাহ দেখাচ্ছে না। এর অন্তর্নিহিত কারণ বোঝাও তেমন কঠিন কিছু নয়।
এ বছর বিএফইউজে এবং ডিইউজে সম্মিলিতভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ৯ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে জাতিকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মহান সংগ্রামের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পেশাজীবী ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের দল-মতনির্বিশেষে নেতৃ-বৃন্দকে সম্মাননা দিয়ে সাংবাদিক সমাজ এক বিরল নজির স্থাপন করেছেন। উল্লিখিত অনুুষ্ঠানে শহীদ ডা. মিলনের দুঃখিনী মায়ের কণ্ঠে তাঁর পুত্রের স্মৃতিচারণ শুনে আবেগাপ্লুত হয়েছি। তবে চমত্কার অনুষ্ঠানটি সর্বজনীন রূপ পেল না আওয়ামীপন্থী সম্মাননাপ্রাপ্ত সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতির কারণে। তারা হয়তো দলীয় আনুগত্য এবং ক্ষমতাসীন মহাজোটে সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সংযুক্তির কারণে সেদিন প্রেস ক্লাব চত্বরে উপস্থিত হতে বিব্রতবোধ করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে রাজনৈতিক বিভাজন আজ এতটাই প্রকট যে, এই রাষ্ট্রে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানেই সব দল-মতের মানুষকে এক মঞ্চে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা সময় ছিল যখন অন্তত বছরে একটা দিন, সশস্ত্র
বাহিনী দিবসে দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে পাশাপাশি দেখা যেত। জেনারেল মইন এবং তার উত্তরসূরিরা সেনাবাহিনীর সেই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যটিকেও নষ্ট করে ফেলেছেন। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার মতো করে সেনাবাহিনীর টপ ব্র্যাসদের (Top brass) মধ্যে পদোন্নতি ও জাতিসংঘ শান্তিমিশনে একাধিকবার গমনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মোহে রাজনৈতিক নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তি করার অপেশাদারি মনোবৃত্তি পরিণামে আমাদের স্বাধীনতাকেও হয়তো একদিন শেষ করে দেবে। মহাজোট সরকার দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা তো দিল্লির পদতলে এর মধ্যে বিসর্জন দিয়েই ফেলেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে ছায়াটি এখনও টিকে আছে, সেটিও অপসৃত হওয়া সম্ভবত সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ক’দিন আগে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারের অর্থের টানাটানি না থাকলে তিনি ঢাকাকে কেবল দুই ভাগ নয় চার টুকরো করে ছাড়তেন। বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিবিদ ও জনপ্রিয় কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর গুটিকয়েক মন্ত্রী, উপদেষ্টা নামধারী ব্যক্তিগত চাকর-বাকর ব্যতীত এ দেশের ১৬ কোটি নাগরিকের প্রত্যেকে ৪০০ বছরেরও অধিক বয়সের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে। কোনো আওয়ামী বুদ্ধিজীবী এমন তথ্য দিতে পারবেন না যে, রাজধানী ভাগ করার দাবি গত চল্লিশ বছরে সমাজের কোনো স্তর থেকে কোনোদিন উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু, কেবল স্বয়ং শেখ হাসিনার মস্তিষ্কপ্রসূত হওয়ার কারণে কোনো আলাপ-আলোচনা, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই ঢাকার বুকে ছুরি চালাতেই হবে! তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিনাশের ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের একগুঁয়েমি প্রত্যক্ষ করেছি। সারাদেশ চাইল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অন্তত আরও দুটো টার্ম থাকুক, অথচ শেখ হাসিনা এক বগ্গা ঘোড়ার মতো গোঁ ধরে বললেন, কভি নেহি। ফলে রাতারাতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল হয়ে গেল। সেবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে একদলীয় সংসদের সরকারি সংসদ সদস্যরা দু’ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিল। আর এবার ঢাকাকে খুন করতে লাগল মাত্র ৪ মিনিট। এটাকেই বলে স্বৈরাচার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে সময় নিয়েছিলেন সাকুল্যে এগার মিনিট। দেশের বারোটা বাজানোর গতিতে কন্যা অবশ্যই তার পিতাকেও অতিক্রম করতে পেরেছেন।
এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে না ঘরকা না ঘাটকা আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দল করবেন বলেই দলীয় প্রধানের সব কথা মানতে হবে—এটা ঠিক নয়। আমি দলের নেতা হিসেবেই বলছি, ডিসিসি ভাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঠিক হয়নি। যে কোনো মানুষই এটাই বলবে।’ একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ মুজিব সরকারের আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে গণফোরাম প্রধান ড. কামাল হোসেন ঢাকাকে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ও ঐতিহ্যের সূতিকাগার উল্লেখ করে বলেছেন, ‘উত্তর-দক্ষিণ ভাগ করে ঢাকার এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখা যাবে না। রুগ্ণ এই রাজনীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্ররা মাঠে নামবে। ১৬ কোটি মানুষও নামবে।’ ঢাকা বিভক্তির পক্ষে ওকালতি করে কোনো আওয়ামী কলামিস্টের লেখাও এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কিন্তু, কথা হলো মানব ইতিহাসে স্বৈরাচার কোনোদিনই জনমতের ধার ধারেনি। দেশের সংবিধান, আইন, আদালত—সবকিছুকেই তারা বশংবদ বিবেচনা করতেই অভ্যস্ত। এদের সবাই সেই ভাইকিং রাজা ক্যানিউটের (King Canute) মতো সমুদ্রের ঢেউকেও আজ্ঞাধীন ভেবে বসে।
বাংলাদেশের অবস্থা অধিকতর বিপজ্জনক। এ দেশে একজন নয়, গত তিরিশ বছর ধরে দু’জন স্বৈরাচার একে অপরের সহযোগিতায় সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। দুই স্বৈরাচার কেমন করে মিলেমিশে থাকে, এ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছা করলে পিএইচডি থিসিস রচনা করতে পারে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ট্যাংকে সওয়ার হয়ে যখন ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন, তখন সমর্থন পেলেন শেখ হাসিনার কাছ থেকে। প্রতিদানে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা মসনদে বসলেন জেনারেল এরশাদের কৃপায়। আর এবার তো স্বৈরাচারের সঙ্গে স্বৈরাচারের একেবারে মাখামাখি। ঢাকা শহরের বিভক্তি নিয়ে দলমত নির্বিশেষে জনগণের প্রতিবাদকে রীতিমত অপমান করে নির্বাচিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সংসদে সদম্ভে ঘোষণা করলেন, টাকা থাকলে ঢাকাকে চার ভাগ করতাম। অর্থাত্ আমার পিঠা আমি ভাগ করব, তুমি বলার কে? তার যুক্তি হলো করপোরেশন ভাগ হলে নাকি জনগণ বেশি সেবা পাবে! স্বৈরাচারী ঔদ্ধত্যেরও একটা সীমা থাকা দরকার। দুই কোটি নাগরিকের শহরকে জনগণের চাপ বিবেচনায় ভাগ করে যদি দুই মেয়রের হাতে দিতে হয়, তাহলে ষোল কোটি জনগণের ভারে পিষ্ট বাংলাদেশকে ভাগ করে ক’জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে হয়—সে হিসাবের গুরুদায়িত্ব রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মালিক সেই জনগণের ওপরই রাখলাম। বিএনপি’র নেতৃবৃন্দসহ অনেক বিজ্ঞজনই বলছেন নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়েই শেখ হাসিনা ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহরের এত বড় সর্বনাশের আয়োজন করেছেন। আমার ধারণাটা অবশ্য ভিন্ন।
অনেক চেষ্টা-তদবির করেও নোবেল পুরস্কার জোটাতে না পারলেও নিত্য-নতুন ইস্যু তৈরির ক্ষেত্রে গিনেস বুকে নাম ওঠানোর ব্যবস্থা কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিন বছরে করে ফেলেছেন। গড় হিসাব করলে প্রতি মাসে একটা নতুন ইস্যু তো দেশবাসী অবশ্যই পেয়েছেন। এ সপ্তাহের মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখতে বসে যে প্রধান ইস্যুগুলোর কথা মনে আসছে, সেগুলোই কেবল সাজানোর চেষ্টা করছি। আমি নিশ্চিত যে এর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
১. বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা হত্যা।
২. জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন।
৩. নিজেরগুলোসহ আওয়ামী নেতা-কর্মীদের খুন, ডাকাতি, লুটপাটের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার।
৪. বেগম খালেদা জিয়াকে তার তিন যুগের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে ঈদের পূর্বদিন অমানবিকভাবে উচ্ছেদ।
৫. ভারতের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি সই।
৬. গোপন চুক্তির মাধ্যমে অথবা কোনো চুক্তি ব্যতীত ভারতকে রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর প্রদান।
৭. টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতার পরিবর্তে সরবে তার পক্ষে ওকালতি।
৮. দেশের জনগণকে তিস্তা পানি চুক্তির আশা দিয়ে ভারতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ।
৯. ভারতকে বাংলাদেশের জমি একতরফা প্রদান।
১০. বিচারবিভাগসহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নগ্ন দলীয়করণ।
১১. শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীর লাখো-কোটি টাকা ডাকাতি।
১২. পঞ্চম সংশোধনী বাতিল।
১৩. সংবিধান থেকে আল্লাহ্র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দেয়া।
১৪. কথিত ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নামে সারা দেশে ইসলাম বিরোধী আবহ তৈরি।
১৫. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জোর করে বাঙালি বানিয়ে পিতার মতো পুনরায় পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করা।
১৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল।
১৭. বিরোধী মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়াবহ নির্যাতন।
১৮. মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
১৯. সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ।
২০. সরকারে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার।
২১. ড. ইউনূসসহ সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে অপমান ও নিগ্রহ।
২২. পারিবারিক জমিদারির মতো করে রাষ্ট্রকে ব্যবহার।
২৩. জাতীয় সংসদকে অকার্যকর, একদলীয় করে তোলা।
২৪. বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে প্রকাশ্য রাজপথে অর্ধউলঙ্গ করে লাঠিপেটা এবং পুলিশের গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে প্রাণনাশের চেষ্টা করা।
২৫. নাটোরের বাবু, নরসিংদীর লোকমান, ঢাকার চৌধুরী আলমের মতো জনপ্রতিনিধিদের সরকারি পেটোয়া বাহিনী কর্তৃক প্রকাশ্যে হত্যা অথবা গুম-খুন।
২৬. দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধি।
২৭. আইন-শৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি।
২৮. দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ধস সৃষ্টি।
২৯. দেউলিয়া পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ইসলামী বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
৩০. আমাদের গর্ব ও ঐতিহ্যের রাজধানী ঢাকা ভাগ।
সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যে কোনো সরকারই জনঅসন্তোষ সৃষ্টি অথবা আন্দোলন হতে পারে এমন ইস্যুর সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। স্বাধীন বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে মহাজোটের নামে প্রথমবারের মতো এমন এক সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনাকে ছেলেখেলা মনে করে একের পর এক ইস্যু তৈরি করেই চলেছে। বিশিষ্ট বাম রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর গত সপ্তাহে আমার দেশ পত্রিকাতেই লেখা তাঁর সাপ্তাহিক কলামে সরকারের অব্যাহত অবিমৃষ্যকারিতায় ভয়ানক বিরক্ত হয়ে সরকার প্রধানের মানসিক সমস্যা থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি চিকিত্সকদের বিষয় বিধায় প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কের প্রকৃত অবস্থা আমার জ্ঞানের বাইরে। তবে আগেই উল্লেখ করেছি, এই বেশুমার ইস্যু তৈরির পেছনে কোনোরকম রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে না এমনটা আমি অন্তত ভাবতে পারছি না। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, ইস্যুর ভিড়ে জনগণ ও বিরোধী দলকে ব্যতিব্যস্ত রাখার উদ্দেশেই সরকারের এই অভিনব কৌশল।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক রোডমার্চসমূহে অভূতপূর্ব জনজোয়ার দেশে তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা পুনর্বার সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। এই মুহূর্তে তার তুলনীয় জনসমর্থনধন্য কোনো রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে যে নেই, এটা বোধহয় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করবেন। কিন্তু, একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, গত তিন বছরে দল হিসেবে বিএনপি সুসংগঠিত হতে পারেনি। সুতরাং, প্রতিটি ইস্যুতেই দেখা যাচ্ছে বিএনপি অতি দুর্বল প্রতিক্রিয়াই (reactive) কেবল দেখাতে পারছে, কোনো বিষয়েই তারা সক্রিয় (pro-active) হয়ে উঠতে পারেনি। সরকার দলীয় কৌশল প্রণেতারা হয়তো ভাবছেন যে, এভাবে ক্রমাগত ইস্যু তৈরি করা গেলে অতি সহজে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করা তো যাবেই, সেই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের সময়ও আগের মতোই এক অগোছালো এবং অনৈক্যে ভারাক্রান্ত বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটের মাঠে পাওয়া যাবে।
এদিকে মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির নেতৃত্বে যে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক মোর্চা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন করেছিল, তারা মহাজোটের তিন বছরের ভয়াবহ অপশাসন সত্ত্বেও বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মিলছে না। প্রফেসর ইউনূস ইস্যু নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ হাসিনার ওপর দৃশ্যত বিরক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত ইসলামী জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে সময়মত তাদের সমর্থন সেক্যুলারদের দিকে হেলে পড়বে না সেই নিশ্চয়তা এখনও দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের মদতে বাংলাদেশে সর্বত্র দুর্নীতির মহোত্সব চললেও টিআইবি’র সাম্প্রতিক পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন বরঞ্চ সে রকম সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। এমতাবস্থায় রোডমার্চের বিপুল সফলতা দর্শনে জাতীয়তাবাদী দলের যেসব নেতা কোনো রকম আন্দোলন ব্যতিরেকে এখন থেকেই মন্ত্রিত্বের স্বপ্ন দেখছেন, তাদের মোহভঙ্গ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বেগম খালেদা জিয়ার বিপুল ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তাদের আখের গোছানোর স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
মোদ্দা কথা, সেই ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে দুই স্বৈরাচারের মৈত্রীর যে বীজটি রোপিত হয়েছিল, তা বিগত দুই দশকে পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে দু’দিন লাপাত্তা থাকার পর জেনারেল এরশাদের পল্টন ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় আত্মপ্রকাশের নাটকীয় মুহূর্তটি স্মরণ করলেই স্বৈরাচারী দোস্তির চিত্রটি গণমানসে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। সেদিনের সেই জনসভায় অবশ্য ড. কামাল হোসেন এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বামধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্যুত রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু গংও উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং আজ আমরা যে স্বৈরাচার পতন দিবস পালন করছি, সে সম্পর্কে নতুন করে মূল্যায়নের সময় এসেছে। একজন সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেই যে দেশ থেকে স্বৈরাচারী মানসিকতার অবসান ঘটে না, সেটি প্রমাণের জন্য বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের শাসন প্রণালী অবলোকনই যথেষ্ট। শেখ হাসিনা এবং জেনারেল এরশাদের যৌথ স্বৈরাচারী শাসনের তিন বছরে জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি সমগ্র দেশটিকেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের কাছে সমর্পণ করা হয়েছে।
জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে এই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করার কৌশল রূপে এরশাদ এখন শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে প্রতিবাদী রাজনীতিকের মুখোশ পরে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের ভড়ং করছেন। দিল্লি সফর করে দেশে ফিরেই এরশাদের ভারত বিরোধিতার এই নাটক চাণক্য কৌশল ছাড়া অন্যকিছু নয়। দিল্লির সম্মতিতে এবং তাদের কৌশল বাস্তবায়নেই এরশাদের এই ভাঁড়ামি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা এবং এরশাদের মধ্যকার নির্বাচনী যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার চিত্রনাট্য এর মধ্যেই দিল্লির সাউথ ব্লকে রচিত হয়েছে বলেই আমার ধারণা। জেনারেল এরশাদের হঠাত্ বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য দরদ উথলে ওঠা যে সেই চিত্রনাট্যেরই অংশ, সেটা অনুধাবন করতে দেশবাসী আবারও ভুল করলে পরাধীনতাই আমাদের অবধারিত ললাট লিখন। এরশাদ নামধারী এই বহুরূপীকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাসিত করতে না পারাটা আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই ব্যর্থতা।
২০০৫-০৬ সালের দিকে বিএনপিও যে এরশাদকে কোলে তুলে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, সেটিও তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই নিদর্শন ছিল। আশা করি, আগের ভুল থেকে বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। অবশ্য সেই সময় এরশাদকে আশকারা দেয়ার কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কতখানি সম্মতি ছিল, সে সম্পর্কে আমার অন্তত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এক এগারোর সময় থেকেই লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রতি নানারকম সাবধানবাণী উচ্চারণ করেও তাদের সচেতন করতে পারিনি। আমার মতো একজন অতি নগণ্য নাগরিকের মতামতকে হয়তো তারা কোনো মূল্য দেননি। কিন্তু কি আশ্চর্য! গত পাঁচ বছরে আমার অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সত্যে পরিণত হয়েছে। স্বৈরাচারবিষয়ক আজকের লেখাটিও একটি আশঙ্কার কথা দিয়েই সমাপ্ত করব। সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে নির্বাচিত স্বৈরাচার যোগ হয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী দানবের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই দানবীয় শাসন বাংলাদেশকে অবধারিত সংঘাতের দিকে ধাবিত করছে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মিডিয়া বিদ্বেষ সেই অঘটনের ইঙ্গিতবাহী।
যৌথ স্বৈরাচারকে এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে সর্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ে আমার মতো ‘চান্স এডিটরদের’ জীবন বিপন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। পুলিশের ছত্রছায়ায় চট্টগ্রামে কর্নেল (অব.) অলি এবং ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকার ওপর ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনীর হামলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিষাক্ত নখর দেশবাসী দেখতে পেয়েছে। পাঠককে আগাম সতর্ক করে রাখছি—এই আক্রমণ আরম্ভ মাত্র। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে যথেষ্ট সম্মান ও সফলতার সঙ্গে পার করতে পেরেছি। সুতরাং জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পক্ষে কলম চালানোর পরিণতিতে জালিমের হাতে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত ত্বরান্বিত হলে তাকেও সৃষ্টিকর্তার করুণা হিসেবেই বিবেচনা করব। এই বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণকে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে পুনরায় আহ্বান জানাই।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
বাহিনী দিবসে দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে পাশাপাশি দেখা যেত। জেনারেল মইন এবং তার উত্তরসূরিরা সেনাবাহিনীর সেই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যটিকেও নষ্ট করে ফেলেছেন। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার মতো করে সেনাবাহিনীর টপ ব্র্যাসদের (Top brass) মধ্যে পদোন্নতি ও জাতিসংঘ শান্তিমিশনে একাধিকবার গমনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মোহে রাজনৈতিক নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তি করার অপেশাদারি মনোবৃত্তি পরিণামে আমাদের স্বাধীনতাকেও হয়তো একদিন শেষ করে দেবে। মহাজোট সরকার দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা তো দিল্লির পদতলে এর মধ্যে বিসর্জন দিয়েই ফেলেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে ছায়াটি এখনও টিকে আছে, সেটিও অপসৃত হওয়া সম্ভবত সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ক’দিন আগে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারের অর্থের টানাটানি না থাকলে তিনি ঢাকাকে কেবল দুই ভাগ নয় চার টুকরো করে ছাড়তেন। বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিবিদ ও জনপ্রিয় কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর গুটিকয়েক মন্ত্রী, উপদেষ্টা নামধারী ব্যক্তিগত চাকর-বাকর ব্যতীত এ দেশের ১৬ কোটি নাগরিকের প্রত্যেকে ৪০০ বছরেরও অধিক বয়সের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে। কোনো আওয়ামী বুদ্ধিজীবী এমন তথ্য দিতে পারবেন না যে, রাজধানী ভাগ করার দাবি গত চল্লিশ বছরে সমাজের কোনো স্তর থেকে কোনোদিন উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু, কেবল স্বয়ং শেখ হাসিনার মস্তিষ্কপ্রসূত হওয়ার কারণে কোনো আলাপ-আলোচনা, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই ঢাকার বুকে ছুরি চালাতেই হবে! তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিনাশের ক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের একগুঁয়েমি প্রত্যক্ষ করেছি। সারাদেশ চাইল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অন্তত আরও দুটো টার্ম থাকুক, অথচ শেখ হাসিনা এক বগ্গা ঘোড়ার মতো গোঁ ধরে বললেন, কভি নেহি। ফলে রাতারাতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল হয়ে গেল। সেবার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে একদলীয় সংসদের সরকারি সংসদ সদস্যরা দু’ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিল। আর এবার ঢাকাকে খুন করতে লাগল মাত্র ৪ মিনিট। এটাকেই বলে স্বৈরাচার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে সময় নিয়েছিলেন সাকুল্যে এগার মিনিট। দেশের বারোটা বাজানোর গতিতে কন্যা অবশ্যই তার পিতাকেও অতিক্রম করতে পেরেছেন।
এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে না ঘরকা না ঘাটকা আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দল করবেন বলেই দলীয় প্রধানের সব কথা মানতে হবে—এটা ঠিক নয়। আমি দলের নেতা হিসেবেই বলছি, ডিসিসি ভাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঠিক হয়নি। যে কোনো মানুষই এটাই বলবে।’ একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ মুজিব সরকারের আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে গণফোরাম প্রধান ড. কামাল হোসেন ঢাকাকে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ও ঐতিহ্যের সূতিকাগার উল্লেখ করে বলেছেন, ‘উত্তর-দক্ষিণ ভাগ করে ঢাকার এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখা যাবে না। রুগ্ণ এই রাজনীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ছাত্ররা মাঠে নামবে। ১৬ কোটি মানুষও নামবে।’ ঢাকা বিভক্তির পক্ষে ওকালতি করে কোনো আওয়ামী কলামিস্টের লেখাও এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কিন্তু, কথা হলো মানব ইতিহাসে স্বৈরাচার কোনোদিনই জনমতের ধার ধারেনি। দেশের সংবিধান, আইন, আদালত—সবকিছুকেই তারা বশংবদ বিবেচনা করতেই অভ্যস্ত। এদের সবাই সেই ভাইকিং রাজা ক্যানিউটের (King Canute) মতো সমুদ্রের ঢেউকেও আজ্ঞাধীন ভেবে বসে।
বাংলাদেশের অবস্থা অধিকতর বিপজ্জনক। এ দেশে একজন নয়, গত তিরিশ বছর ধরে দু’জন স্বৈরাচার একে অপরের সহযোগিতায় সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। দুই স্বৈরাচার কেমন করে মিলেমিশে থাকে, এ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছা করলে পিএইচডি থিসিস রচনা করতে পারে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ট্যাংকে সওয়ার হয়ে যখন ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন, তখন সমর্থন পেলেন শেখ হাসিনার কাছ থেকে। প্রতিদানে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা মসনদে বসলেন জেনারেল এরশাদের কৃপায়। আর এবার তো স্বৈরাচারের সঙ্গে স্বৈরাচারের একেবারে মাখামাখি। ঢাকা শহরের বিভক্তি নিয়ে দলমত নির্বিশেষে জনগণের প্রতিবাদকে রীতিমত অপমান করে নির্বাচিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সংসদে সদম্ভে ঘোষণা করলেন, টাকা থাকলে ঢাকাকে চার ভাগ করতাম। অর্থাত্ আমার পিঠা আমি ভাগ করব, তুমি বলার কে? তার যুক্তি হলো করপোরেশন ভাগ হলে নাকি জনগণ বেশি সেবা পাবে! স্বৈরাচারী ঔদ্ধত্যেরও একটা সীমা থাকা দরকার। দুই কোটি নাগরিকের শহরকে জনগণের চাপ বিবেচনায় ভাগ করে যদি দুই মেয়রের হাতে দিতে হয়, তাহলে ষোল কোটি জনগণের ভারে পিষ্ট বাংলাদেশকে ভাগ করে ক’জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে হয়—সে হিসাবের গুরুদায়িত্ব রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মালিক সেই জনগণের ওপরই রাখলাম। বিএনপি’র নেতৃবৃন্দসহ অনেক বিজ্ঞজনই বলছেন নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়েই শেখ হাসিনা ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহরের এত বড় সর্বনাশের আয়োজন করেছেন। আমার ধারণাটা অবশ্য ভিন্ন।
অনেক চেষ্টা-তদবির করেও নোবেল পুরস্কার জোটাতে না পারলেও নিত্য-নতুন ইস্যু তৈরির ক্ষেত্রে গিনেস বুকে নাম ওঠানোর ব্যবস্থা কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিন বছরে করে ফেলেছেন। গড় হিসাব করলে প্রতি মাসে একটা নতুন ইস্যু তো দেশবাসী অবশ্যই পেয়েছেন। এ সপ্তাহের মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখতে বসে যে প্রধান ইস্যুগুলোর কথা মনে আসছে, সেগুলোই কেবল সাজানোর চেষ্টা করছি। আমি নিশ্চিত যে এর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
১. বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা হত্যা।
২. জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন।
৩. নিজেরগুলোসহ আওয়ামী নেতা-কর্মীদের খুন, ডাকাতি, লুটপাটের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার।
৪. বেগম খালেদা জিয়াকে তার তিন যুগের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে ঈদের পূর্বদিন অমানবিকভাবে উচ্ছেদ।
৫. ভারতের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি সই।
৬. গোপন চুক্তির মাধ্যমে অথবা কোনো চুক্তি ব্যতীত ভারতকে রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর প্রদান।
৭. টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতার পরিবর্তে সরবে তার পক্ষে ওকালতি।
৮. দেশের জনগণকে তিস্তা পানি চুক্তির আশা দিয়ে ভারতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ।
৯. ভারতকে বাংলাদেশের জমি একতরফা প্রদান।
১০. বিচারবিভাগসহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নগ্ন দলীয়করণ।
১১. শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীর লাখো-কোটি টাকা ডাকাতি।
১২. পঞ্চম সংশোধনী বাতিল।
১৩. সংবিধান থেকে আল্লাহ্র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দেয়া।
১৪. কথিত ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নামে সারা দেশে ইসলাম বিরোধী আবহ তৈরি।
১৫. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জোর করে বাঙালি বানিয়ে পিতার মতো পুনরায় পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করা।
১৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল।
১৭. বিরোধী মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়াবহ নির্যাতন।
১৮. মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
১৯. সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ।
২০. সরকারে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার।
২১. ড. ইউনূসসহ সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে অপমান ও নিগ্রহ।
২২. পারিবারিক জমিদারির মতো করে রাষ্ট্রকে ব্যবহার।
২৩. জাতীয় সংসদকে অকার্যকর, একদলীয় করে তোলা।
২৪. বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে প্রকাশ্য রাজপথে অর্ধউলঙ্গ করে লাঠিপেটা এবং পুলিশের গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে প্রাণনাশের চেষ্টা করা।
২৫. নাটোরের বাবু, নরসিংদীর লোকমান, ঢাকার চৌধুরী আলমের মতো জনপ্রতিনিধিদের সরকারি পেটোয়া বাহিনী কর্তৃক প্রকাশ্যে হত্যা অথবা গুম-খুন।
২৬. দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধি।
২৭. আইন-শৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি।
২৮. দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ধস সৃষ্টি।
২৯. দেউলিয়া পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ইসলামী বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
৩০. আমাদের গর্ব ও ঐতিহ্যের রাজধানী ঢাকা ভাগ।
সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যে কোনো সরকারই জনঅসন্তোষ সৃষ্টি অথবা আন্দোলন হতে পারে এমন ইস্যুর সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। স্বাধীন বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে মহাজোটের নামে প্রথমবারের মতো এমন এক সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনাকে ছেলেখেলা মনে করে একের পর এক ইস্যু তৈরি করেই চলেছে। বিশিষ্ট বাম রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর গত সপ্তাহে আমার দেশ পত্রিকাতেই লেখা তাঁর সাপ্তাহিক কলামে সরকারের অব্যাহত অবিমৃষ্যকারিতায় ভয়ানক বিরক্ত হয়ে সরকার প্রধানের মানসিক সমস্যা থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি চিকিত্সকদের বিষয় বিধায় প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কের প্রকৃত অবস্থা আমার জ্ঞানের বাইরে। তবে আগেই উল্লেখ করেছি, এই বেশুমার ইস্যু তৈরির পেছনে কোনোরকম রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে না এমনটা আমি অন্তত ভাবতে পারছি না। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, ইস্যুর ভিড়ে জনগণ ও বিরোধী দলকে ব্যতিব্যস্ত রাখার উদ্দেশেই সরকারের এই অভিনব কৌশল।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক রোডমার্চসমূহে অভূতপূর্ব জনজোয়ার দেশে তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা পুনর্বার সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। এই মুহূর্তে তার তুলনীয় জনসমর্থনধন্য কোনো রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে যে নেই, এটা বোধহয় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও স্বীকার করবেন। কিন্তু, একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, গত তিন বছরে দল হিসেবে বিএনপি সুসংগঠিত হতে পারেনি। সুতরাং, প্রতিটি ইস্যুতেই দেখা যাচ্ছে বিএনপি অতি দুর্বল প্রতিক্রিয়াই (reactive) কেবল দেখাতে পারছে, কোনো বিষয়েই তারা সক্রিয় (pro-active) হয়ে উঠতে পারেনি। সরকার দলীয় কৌশল প্রণেতারা হয়তো ভাবছেন যে, এভাবে ক্রমাগত ইস্যু তৈরি করা গেলে অতি সহজে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করা তো যাবেই, সেই সঙ্গে আগামী নির্বাচনের সময়ও আগের মতোই এক অগোছালো এবং অনৈক্যে ভারাক্রান্ত বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটের মাঠে পাওয়া যাবে।
এদিকে মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির নেতৃত্বে যে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক মোর্চা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন করেছিল, তারা মহাজোটের তিন বছরের ভয়াবহ অপশাসন সত্ত্বেও বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ মিলছে না। প্রফেসর ইউনূস ইস্যু নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ হাসিনার ওপর দৃশ্যত বিরক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত ইসলামী জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে সময়মত তাদের সমর্থন সেক্যুলারদের দিকে হেলে পড়বে না সেই নিশ্চয়তা এখনও দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের মদতে বাংলাদেশে সর্বত্র দুর্নীতির মহোত্সব চললেও টিআইবি’র সাম্প্রতিক পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন বরঞ্চ সে রকম সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। এমতাবস্থায় রোডমার্চের বিপুল সফলতা দর্শনে জাতীয়তাবাদী দলের যেসব নেতা কোনো রকম আন্দোলন ব্যতিরেকে এখন থেকেই মন্ত্রিত্বের স্বপ্ন দেখছেন, তাদের মোহভঙ্গ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বেগম খালেদা জিয়ার বিপুল ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তাদের আখের গোছানোর স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
মোদ্দা কথা, সেই ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে দুই স্বৈরাচারের মৈত্রীর যে বীজটি রোপিত হয়েছিল, তা বিগত দুই দশকে পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে দু’দিন লাপাত্তা থাকার পর জেনারেল এরশাদের পল্টন ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় আত্মপ্রকাশের নাটকীয় মুহূর্তটি স্মরণ করলেই স্বৈরাচারী দোস্তির চিত্রটি গণমানসে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। সেদিনের সেই জনসভায় অবশ্য ড. কামাল হোসেন এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বামধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্যুত রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু গংও উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং আজ আমরা যে স্বৈরাচার পতন দিবস পালন করছি, সে সম্পর্কে নতুন করে মূল্যায়নের সময় এসেছে। একজন সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেই যে দেশ থেকে স্বৈরাচারী মানসিকতার অবসান ঘটে না, সেটি প্রমাণের জন্য বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের শাসন প্রণালী অবলোকনই যথেষ্ট। শেখ হাসিনা এবং জেনারেল এরশাদের যৌথ স্বৈরাচারী শাসনের তিন বছরে জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি সমগ্র দেশটিকেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের কাছে সমর্পণ করা হয়েছে।
জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে এই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করার কৌশল রূপে এরশাদ এখন শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে প্রতিবাদী রাজনীতিকের মুখোশ পরে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের ভড়ং করছেন। দিল্লি সফর করে দেশে ফিরেই এরশাদের ভারত বিরোধিতার এই নাটক চাণক্য কৌশল ছাড়া অন্যকিছু নয়। দিল্লির সম্মতিতে এবং তাদের কৌশল বাস্তবায়নেই এরশাদের এই ভাঁড়ামি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা এবং এরশাদের মধ্যকার নির্বাচনী যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার চিত্রনাট্য এর মধ্যেই দিল্লির সাউথ ব্লকে রচিত হয়েছে বলেই আমার ধারণা। জেনারেল এরশাদের হঠাত্ বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য দরদ উথলে ওঠা যে সেই চিত্রনাট্যেরই অংশ, সেটা অনুধাবন করতে দেশবাসী আবারও ভুল করলে পরাধীনতাই আমাদের অবধারিত ললাট লিখন। এরশাদ নামধারী এই বহুরূপীকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাসিত করতে না পারাটা আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই ব্যর্থতা।
২০০৫-০৬ সালের দিকে বিএনপিও যে এরশাদকে কোলে তুলে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, সেটিও তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই নিদর্শন ছিল। আশা করি, আগের ভুল থেকে বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। অবশ্য সেই সময় এরশাদকে আশকারা দেয়ার কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কতখানি সম্মতি ছিল, সে সম্পর্কে আমার অন্তত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এক এগারোর সময় থেকেই লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রতি নানারকম সাবধানবাণী উচ্চারণ করেও তাদের সচেতন করতে পারিনি। আমার মতো একজন অতি নগণ্য নাগরিকের মতামতকে হয়তো তারা কোনো মূল্য দেননি। কিন্তু কি আশ্চর্য! গত পাঁচ বছরে আমার অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সত্যে পরিণত হয়েছে। স্বৈরাচারবিষয়ক আজকের লেখাটিও একটি আশঙ্কার কথা দিয়েই সমাপ্ত করব। সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে নির্বাচিত স্বৈরাচার যোগ হয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী দানবের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই দানবীয় শাসন বাংলাদেশকে অবধারিত সংঘাতের দিকে ধাবিত করছে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মিডিয়া বিদ্বেষ সেই অঘটনের ইঙ্গিতবাহী।
যৌথ স্বৈরাচারকে এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে সর্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ে আমার মতো ‘চান্স এডিটরদের’ জীবন বিপন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। পুলিশের ছত্রছায়ায় চট্টগ্রামে কর্নেল (অব.) অলি এবং ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকার ওপর ছাত্রলীগের গুণ্ডা বাহিনীর হামলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিষাক্ত নখর দেশবাসী দেখতে পেয়েছে। পাঠককে আগাম সতর্ক করে রাখছি—এই আক্রমণ আরম্ভ মাত্র। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে যথেষ্ট সম্মান ও সফলতার সঙ্গে পার করতে পেরেছি। সুতরাং জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পক্ষে কলম চালানোর পরিণতিতে জালিমের হাতে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত ত্বরান্বিত হলে তাকেও সৃষ্টিকর্তার করুণা হিসেবেই বিবেচনা করব। এই বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণকে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে পুনরায় আহ্বান জানাই।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
No comments