মিথ্যাচার করে নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন-'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় টি-শার্ট বানাচ্ছিলাম' by মেহেদী হাসান
কানাডায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছিলেন আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর (অব.) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী। এই নূর চৌধুরীই বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি চালিয়েছিলেন। অথচ কানাডার রিফিউজি বোর্ডের কাছে তিনি দাবি করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অন্যত্র বসে বঙ্গবন্ধুর শোকযাত্রার জন্য টি-শার্ট বানাচ্ছিলেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (সিবিসি)
রেডিওর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধানকে নূর চৌধুরীর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। সিবিসি রেডিওর ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারটি এখনো সংরক্ষিত আছে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনা করেছেন উল্লেখ করে সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনাও তাঁর বাবার কায়দায় দেশ চালাচ্ছেন। ফলে তিনি বাংলাদেশে এখন আর ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারছেন না।
এদিকে গতকাল সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। ঢাকায় কানাডার নতুন হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানো হবে না বলে সাংবাদিকদের জানানোর এক দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কথা জানাল।
খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থানের কারণ সম্পর্কে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আমি কানাডা সরকারের সাহায্য চেয়েছি। কারণ আমি নির্দোষ। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করিনি। আর সে জন্য আমি আজ এখানে। আমাকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আমি নির্দোষ। তাই আমি কানাডা সরকারের সাহায্য চেয়েছি।'
নূর চৌধুরীর গুলিতেই বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার বিষয়ে আদালতে সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যর বিষয়টি সিবিসি রেডিও তাঁকে বললে নূর চৌধুরী দাবি করেন, এমন সাক্ষ্য সত্য নয়। তিনি বলেন, 'অন্য কোথাও ছিলাম আমি। আর অনেকেই এটি জানে। কিন্তু তারা সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে। তারা মুখ খুলছে না।'
খুনি না হলে কেন খুনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে_সিবিসি রেডিওর এ প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার কারণ আমি ওই ক্যু (অভ্যুত্থান) সমর্থন করেছিলাম। এ জন্য জেনারেল ওসমানী ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাকে সাম্মানিক করেছিলেন। এ ছাড়া আমার ইউনিট সে সময় রাজধানী ঢাকায় ছিল।'
'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় কোথায় ছিলেন?' জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি বলেছি, আমি সে সময় সেখানে ছিলাম না। আমার কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অন্য কোথাও ছিলাম। অন্য কিছু করছিলাম।'
সিবিসি রেডিও আবারও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে নূর চৌধুরীর অবস্থান জানতে চায়। জবাবে তিনি তাঁর স্বজনদের নিরাপত্তার কথা তুলে ওই বিষয়ে আর কোনো আলোচনা না করার অনুরোধ জানান। নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। আমি তাদের সঙ্গে একটি কাজ করছিলাম।'
সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে নূর চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়, 'ডিপোর্টেশন রিমুভাল ফাইলের আবেদনে আপনি বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপনি টি-শার্ট বানাচ্ছিলেন। সত্যিই কি তাই?' জবাবে নূর চৌধুরী টি-শার্ট বানানোর বিষয়টিকেই সত্য বলে দাবি করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকে আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে টি-শার্ট বানানোর বিষয়টি লুকানোর কারণ সম্পর্কে সিবিসি রেডিও জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, এ ব্যাপারটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হলে বিস্তারিত অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।
নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি চাইনি এটা প্রকাশ হোক। যখন আমি রিফিউজি বোর্ডের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছি, তখন আমি প্রত্যাশা করেছি, আমার এবং আমার সাক্ষীদের জীবনের নিরাপত্তার কারণে এটি একেবারেই গোপন থাকুক।'
সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আপনাদের বিচারকে সঠিক ও যথার্থ বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মন্তব্য করেছে।' এর প্রতিক্রিয়ায় নূর চৌধুরী বলেন, 'তারা (অ্যামনেস্টি) সেটা মনে করতে পারে। কিন্তু আমি আসলে জানি না তারা মামলাটির কত গভীরে গিয়েছিল। আমি যতটুকু জেনেছি, সাক্ষী ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিদের কথার ভিত্তিতে এটি হয়েছে এবং তাঁদের ওপর অনেক অত্যাচার চালানো হয়েছিল। আমি জানি, ওই বিচারে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব এবং উৎসাহ ছিল, যা লজ্জাজনক।'
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে কূটনৈতিক মিশনে সেক্রেটারি পদে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, হত্যার পরপরই নয়, বেশ পরে তিনি ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ পান। আর ২৫ বছর বয়সে ওই পদে নিয়োগ পাওয়াকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে দাবি করেন।
ওই নিয়োগ পুরস্কার ছিল কি না জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, তিনি নিশ্চিত যে তা পুরস্কার ছিল না। কারণ তাঁর চেয়ে কম বয়সী অনেকে আরো বড় পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
খুনি না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্যদের মতো তাঁকেও কেন আইন করে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) দেওয়া হয়েছিল_এ প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, 'এর উত্তর রাষ্ট্রপতিই (খন্দকার মোশতাক) দিতে পারবেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সব কর্মকাণ্ডকেই দায়মুক্তির আওতায় আনা হয়েছিল।'
এ প্রসঙ্গে নূর চৌধুরী আরো বলেন, 'আমি দায়মুক্তি পাইনি। আইনটিতে বলা হয়েছিল, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ওই দিনের সব কর্মকাণ্ডই দায়মুক্তির আওতায় পড়বে।'
কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে সিবিসি রেডিও জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, 'ক্যু (অভ্যুত্থান)... যারা ওই দিন ক্যুতে অংশ নিয়েছিলেন। হত্যার সঙ্গে আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম না।'
কানাডায় আসার কারণ সম্পর্কে নূর চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর অন্যত্র যাওয়া উচিত বলে তাঁর মনে হয়েছে।
নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি খুনি নই, নির্দোষ। আইনগতভাবে কানাডায় বসবাসের অধিকার আমার আছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, সে ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।'
সাক্ষাৎকারের সময় নূর চৌধুরীর পাশে তাঁর আইনজীবী জ্যাক উপস্থিত ছিলেন। তিনিও নূর চৌধুরীর বিষয়ে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাব দেন। সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের শিশুপুত্র রাসেলকে হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জ্যাক বলেন, একটা বাচ্চাকে এভাবে মেরে ফেলার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু নূর চৌধুরী বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন কি না। বাংলাদেশে ফিরলে নূর চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ কানাডাকে অনুরোধ করে আসছে। গত রবিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেনের সাক্ষাতেও বিষয়টি আলোচিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে ফেরত পাঠানোর প্রসঙ্গ তোলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কানাডা ও বাংলাদেশ অভিন্ন আইন (সিভিল ল) অনুসরণ করে। কানাডা এ দেশে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত খুনির নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে না।
ডা. দীপু মনি বলেন, কানাডায় আইনি জটিলতা সম্পর্কে বাংলাদেশ অবগত। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কানাডার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায়।
কানাডার হাইকমিশনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। তিনি এ বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কানাডার হাইকমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশ থাকায় নূর চৌধুরীকে ফেরত দেবে না কানাডা সরকার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কার ইস্যুতে ৪ ডিসেম্বর (গতকাল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেনের মন্তব্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বাস করে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কানাডার হাইকমিশনের আলোচনার বিষয়টি প্রতিবেদনে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'বাংলাদেশ সরকার কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে বহিষ্কার ইস্যুতে দেশটির সরকারের সঙ্গে নিয়মিত ও গভীর যোগাযোগ বজায় রাখছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কানাডার আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বাংলাদেশ অবগত। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি চলমান এবং এটির অগ্রগতি হচ্ছে। উপরন্তু এটি অনুধাবন করা উচিত যে, নূর চৌধুরীকে কানাডার আদালত বহিষ্কারাদেশ দিয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।'
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, 'কানাডায় হাইকমিশনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। তিনি এ বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন।'
এদিকে গতকাল সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। ঢাকায় কানাডার নতুন হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানো হবে না বলে সাংবাদিকদের জানানোর এক দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কথা জানাল।
খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থানের কারণ সম্পর্কে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আমি কানাডা সরকারের সাহায্য চেয়েছি। কারণ আমি নির্দোষ। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করিনি। আর সে জন্য আমি আজ এখানে। আমাকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আমি নির্দোষ। তাই আমি কানাডা সরকারের সাহায্য চেয়েছি।'
নূর চৌধুরীর গুলিতেই বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার বিষয়ে আদালতে সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যর বিষয়টি সিবিসি রেডিও তাঁকে বললে নূর চৌধুরী দাবি করেন, এমন সাক্ষ্য সত্য নয়। তিনি বলেন, 'অন্য কোথাও ছিলাম আমি। আর অনেকেই এটি জানে। কিন্তু তারা সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে। তারা মুখ খুলছে না।'
খুনি না হলে কেন খুনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে_সিবিসি রেডিওর এ প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার কারণ আমি ওই ক্যু (অভ্যুত্থান) সমর্থন করেছিলাম। এ জন্য জেনারেল ওসমানী ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাকে সাম্মানিক করেছিলেন। এ ছাড়া আমার ইউনিট সে সময় রাজধানী ঢাকায় ছিল।'
'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় কোথায় ছিলেন?' জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি বলেছি, আমি সে সময় সেখানে ছিলাম না। আমার কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অন্য কোথাও ছিলাম। অন্য কিছু করছিলাম।'
সিবিসি রেডিও আবারও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে নূর চৌধুরীর অবস্থান জানতে চায়। জবাবে তিনি তাঁর স্বজনদের নিরাপত্তার কথা তুলে ওই বিষয়ে আর কোনো আলোচনা না করার অনুরোধ জানান। নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। আমি তাদের সঙ্গে একটি কাজ করছিলাম।'
সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে নূর চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়, 'ডিপোর্টেশন রিমুভাল ফাইলের আবেদনে আপনি বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপনি টি-শার্ট বানাচ্ছিলেন। সত্যিই কি তাই?' জবাবে নূর চৌধুরী টি-শার্ট বানানোর বিষয়টিকেই সত্য বলে দাবি করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকে আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে টি-শার্ট বানানোর বিষয়টি লুকানোর কারণ সম্পর্কে সিবিসি রেডিও জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, এ ব্যাপারটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হলে বিস্তারিত অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।
নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি চাইনি এটা প্রকাশ হোক। যখন আমি রিফিউজি বোর্ডের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছি, তখন আমি প্রত্যাশা করেছি, আমার এবং আমার সাক্ষীদের জীবনের নিরাপত্তার কারণে এটি একেবারেই গোপন থাকুক।'
সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আপনাদের বিচারকে সঠিক ও যথার্থ বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মন্তব্য করেছে।' এর প্রতিক্রিয়ায় নূর চৌধুরী বলেন, 'তারা (অ্যামনেস্টি) সেটা মনে করতে পারে। কিন্তু আমি আসলে জানি না তারা মামলাটির কত গভীরে গিয়েছিল। আমি যতটুকু জেনেছি, সাক্ষী ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিদের কথার ভিত্তিতে এটি হয়েছে এবং তাঁদের ওপর অনেক অত্যাচার চালানো হয়েছিল। আমি জানি, ওই বিচারে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব এবং উৎসাহ ছিল, যা লজ্জাজনক।'
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে কূটনৈতিক মিশনে সেক্রেটারি পদে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, হত্যার পরপরই নয়, বেশ পরে তিনি ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ পান। আর ২৫ বছর বয়সে ওই পদে নিয়োগ পাওয়াকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে দাবি করেন।
ওই নিয়োগ পুরস্কার ছিল কি না জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, তিনি নিশ্চিত যে তা পুরস্কার ছিল না। কারণ তাঁর চেয়ে কম বয়সী অনেকে আরো বড় পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
খুনি না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্যদের মতো তাঁকেও কেন আইন করে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) দেওয়া হয়েছিল_এ প্রশ্নের জবাবে নূর চৌধুরী বলেন, 'এর উত্তর রাষ্ট্রপতিই (খন্দকার মোশতাক) দিতে পারবেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সব কর্মকাণ্ডকেই দায়মুক্তির আওতায় আনা হয়েছিল।'
এ প্রসঙ্গে নূর চৌধুরী আরো বলেন, 'আমি দায়মুক্তি পাইনি। আইনটিতে বলা হয়েছিল, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ওই দিনের সব কর্মকাণ্ডই দায়মুক্তির আওতায় পড়বে।'
কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে সিবিসি রেডিও জানতে চাইলে নূর চৌধুরী বলেন, 'ক্যু (অভ্যুত্থান)... যারা ওই দিন ক্যুতে অংশ নিয়েছিলেন। হত্যার সঙ্গে আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম না।'
কানাডায় আসার কারণ সম্পর্কে নূর চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর অন্যত্র যাওয়া উচিত বলে তাঁর মনে হয়েছে।
নূর চৌধুরী বলেন, 'আমি খুনি নই, নির্দোষ। আইনগতভাবে কানাডায় বসবাসের অধিকার আমার আছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, সে ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।'
সাক্ষাৎকারের সময় নূর চৌধুরীর পাশে তাঁর আইনজীবী জ্যাক উপস্থিত ছিলেন। তিনিও নূর চৌধুরীর বিষয়ে সিবিসি রেডিওর প্রশ্নের জবাব দেন। সিবিসি রেডিওর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের শিশুপুত্র রাসেলকে হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জ্যাক বলেন, একটা বাচ্চাকে এভাবে মেরে ফেলার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু নূর চৌধুরী বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন কি না। বাংলাদেশে ফিরলে নূর চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ কানাডাকে অনুরোধ করে আসছে। গত রবিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেনের সাক্ষাতেও বিষয়টি আলোচিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে ফেরত পাঠানোর প্রসঙ্গ তোলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কানাডা ও বাংলাদেশ অভিন্ন আইন (সিভিল ল) অনুসরণ করে। কানাডা এ দেশে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত খুনির নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে না।
ডা. দীপু মনি বলেন, কানাডায় আইনি জটিলতা সম্পর্কে বাংলাদেশ অবগত। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কানাডার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায়।
কানাডার হাইকমিশনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। তিনি এ বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কানাডার হাইকমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশ থাকায় নূর চৌধুরীকে ফেরত দেবে না কানাডা সরকার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কার ইস্যুতে ৪ ডিসেম্বর (গতকাল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেনের মন্তব্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্বাস করে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কানাডার হাইকমিশনের আলোচনার বিষয়টি প্রতিবেদনে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'বাংলাদেশ সরকার কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে বহিষ্কার ইস্যুতে দেশটির সরকারের সঙ্গে নিয়মিত ও গভীর যোগাযোগ বজায় রাখছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কানাডার আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বাংলাদেশ অবগত। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি চলমান এবং এটির অগ্রগতি হচ্ছে। উপরন্তু এটি অনুধাবন করা উচিত যে, নূর চৌধুরীকে কানাডার আদালত বহিষ্কারাদেশ দিয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।'
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, 'কানাডায় হাইকমিশনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। তিনি এ বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন।'
No comments