যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেওয়ায় বিএনপির ভেতরে-বাইরে ক্ষোভ by লোটন একরাম

বিএনপি প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের 'পক্ষে অবস্থান' নেওয়ায় দলের ভেতর ও বাইরে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ। দলের হাইকমান্ড মুখে বিএনপিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দল দাবি করে আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের ঘোষণায় 'বিস্ময়' প্রকাশ করেছেন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, সারাদেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সোচ্চার; ঠিক সে সময় এ বিচার বন্ধের দাবি একটি


গণবিরোধী সিদ্ধান্ত ও দুর্ভাগ্যজনক। জামায়াতে ইসলামীকে খুশি করতে বিএনপির এই অবস্থানে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করছেন দলের উদারপন্থি নেতারা। আগামীতে বিএনপির রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করেন তারা। ইতিমধ্যে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে
'কৌশলী' ভূমিকা নিয়েছিল বিএনপি। সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি জানায়নি দলটি। বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন দলের শীর্ষ নেতারা। তবে আকস্মিকভাবে শনিবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাতিলের দাবি জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল। দলের পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখিত বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালকে 'আজ্ঞাবাহী রাবার স্ট্যাম্প' সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, বিচার কার্যক্রমের ওপর তাদের আস্থা নেই। তাই এর কার্যক্রম বাতিল করে মার্কিন অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ স্টিফেন র‌্যাপের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হোক।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বিএনপির এই আনুষ্ঠানিক অবস্থান ব্যক্ত করার পর দলের ভেতর ও বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরোধিতা করলেও দলের 'চেইন অব কমান্ড' রক্ষার্থে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তবে দলীয় নেতাদের কাছে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকদের কাছেও অনেকে তাদের ক্ষোভের বিষয়টি জানান।
বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, জামায়াতের বক্তব্যই বিএনপি বলেছে। বিএনপির এ প্রশ্ন তোলা একদম সাজে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করা মানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে বৈরিতা করা।
এ পরিস্থিতিতে গতকাল বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে কিছু 'ভুল' ছাপার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। দলের দফতর সম্পাদক রিজভী আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনে কিছু অপঠিত শব্দ সাংবাদিকদের মধ্যে বিলিকৃত লিখিত বক্তব্যে ভুলক্রমে ছাপানো হয়েছে বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বলা হয়, 'বিএনপি বিশ্বাস করে বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ট্রাইব্যুনাল একটি আজ্ঞাবাহী রাবার স্ট্যাম্প সংগঠন ছাড়া আর কিছু নয়।' কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যা বলেছেন তা হলো- 'বিএনপি বিশ্বাস করে বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে এই ট্রাইব্যুনালকে দেশের মানুষ একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে না। '
দুর্ভাগ্যজনক মনে করে সুশীল সমাজ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সমকালকে বলেছেন, বিএনপির মতো একটি বড় দলের এ ধরনের ভূমিকা সত্যি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপির সামগ্রিক ভূমিকা দেখে মনে হয় তারা যুদ্ধাপরাধীদের দল। যেখানে পুরো জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করছে সেখানে বিএনপি এ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কারও কাম্য হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, তাদের এ অবস্থান দেশের অস্তিত্বের বিপরীতে দাঁড়ানো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। সভ্য সমাজের দাবি।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ বলেন, জামায়াতকে রক্ষা করতেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। তাদের এ বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কার্যত জামায়াতের বক্তব্য দিয়েছে তারা। তাছাড়া বিএনপির বক্তব্যে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তাদের এই অবস্থান ও বক্তব্য মোটেই নতুন কিছু নয়। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তারাই আইন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের দাবি কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি এ ধরনের দাবি জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ও আইনের শাসনের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়েছে। এ বিচারকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রয়াস। তাদের যে আইনের প্রতি যে শ্রদ্ধা নেই, এটাই প্রমাণ হয়েছে। এটা আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞার শামিল।
ক্ষুব্ধ বিএনপির নেতাকর্মীরা : বিএনপির বেশ কয়েকজন ক্ষুব্ধ নেতা সমকালকে বলেছেন, দলের হাইকমান্ড একটি গুরুতর 'ভুল' সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মুহূর্তে প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বিচার বন্ধের দাবি তোলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল বিএনপির। এ সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিযোগটিই প্রমাণ হলো যে, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না।
বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতারা আরও বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ হয় বিএনপি জামায়াতের কাছে 'নতি স্বীকার' করতে বাধ্য হয়েছে। কার্যত জামায়াতের 'ফাঁদে' পা দিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। এ জন্য বিএনপিকে অনেক 'মাশুল' দিতে হতে পারে।
দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর মতামত উপেক্ষা করেই জামায়াতে ইসলামীর চাপের কাছে হার মেনে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিল বিএনপি হাইকমান্ড। অবশ্য হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানায়, জামায়াতকে হাতে রাখতে আপাতত কৌশলগত কারণে কিছুটা পিছু হটেছে দলের হাইকমান্ড। মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। সেখানে জামায়াতের মতো দলকে হাতছাড়া করতে রাজি নন তারা।
এছাড়া আগামী নির্বাচনে জামায়াতের 'ভোট ব্যাংকের' প্রতি সুনজর রয়েছে বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বের। এসব কারণে দল ও দলের বাইরে বিরোধিতা সত্ত্বেও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর মহাজোট সরকারের আমলে প্রথম জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চ থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি পালন শুরু করে বিএনপি।

No comments

Powered by Blogger.