স্মরণ-হাছন রাজা : মরমি সাধক
গাছ লাগালেই যে ফল হয় তা নয়। কিছু গাছে ফল হয়। মাঝেমধ্যে ফলের নামে গাছের পরিচয় হয়। যেমন তেঁতুল গাছ। আবার কিছু গাছের নাম হয় ঠিকই; কিন্তু তার ফলের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও হয়। যেমন মেহগনি গাছ। আজ এমন একজন রাজার কথা বলছি, যিনি তাঁর বিচিত্র জীবন যাপনের গাছ লাগিয়েছিলেন। ওই গাছে ফল ধরল। মানুষের মুখে মুখে তাঁর জীবনযাপনের গল্প ও গল্পের ফল প্রচারিত হতে থাকল এবং ওই রাজা সময়ের স্রোতে হারিয়ে না
গিয়ে অমর হয়ে রইলেন। বলছি হাছন রাজার কথা। তাঁর প্রকৃত নাম দেওয়ান হাছন রাজা। সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের কাছে সুরমা নদীর পারে লক্ষ্মণঝিরি পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। হাছন রাজা তাঁর জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন প্রচণ্ড ভোগবিলাসী ও শৌখিন। রমণী সম্ভোগে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন, 'সর্ব লোকে বলে হাছন রাজা লম্পটিয়া।' প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে তিনি নৃত্যগীতের আয়োজন করে নৌকা নিয়ে হাওরে চলে যেতেন। সেই নৌকায় থাকত ভোগবিলাসের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। এ সময়টায় বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তিনি গান রচনা করতেন। বাদ্যযন্ত্র-সহকারে এই গান সঙ্গে সঙ্গে গাওয়া হতো। এভাবেই জীবন চলতে লাগল তাঁর। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশাল সম্পদের অধিকারী হাছন রাজা ধীরে ধীরে তাঁর প্রজাদের কাছে হয়ে উঠলেন ভীষণ অত্যাচারী ও ভয়ংকর ভীতির কারণ। লোকমুখে প্রচার হতে থাকল, হাছন রাজার সামনে কোনো নারী পড়লেই আর রক্ষা নেই। এমনকি তিনি হাওরের পারে বসে থাকা অবস্থায় যদি কোনো নৌকা দিয়ে কোনো নতুন বউ বা যুবতী যেত তাদেরও পাকড়াও করা হতো হাছন রাজার আনন্দভোগের জন্য। আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে চলত গান রচনা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব গানে থাকত জীবনের অনিত্যতার কথা, ভোগবিলাসের সীমাবদ্ধতার কথা। জীবনের এমন সব নিগূঢ় সত্য উপলব্ধি এসব গানে থাকত, যা বহুকাল ধরে মানুষ বলার মতো সহজ ভাষা হয়তো পায়নি। খোদ রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে ভারতে ও ১৯৩০ সালে অঙ্ফোর্ডে তাঁর ভাষণে হাছন রাজার গানের উদাহরণ দিয়ে দর্শনের তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। বাংলার জগতে ফকির লালন শাহ হচ্ছেন বাউল শিরমণিখ্যাত। এর পরই যে নামটি আসে তা হলো হাছন রাজা। সব ভোগবিলাস ত্যাগ করে তিনি একপর্যায়ে হয়ে গেলেন বাউল। তিনি প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। তখন তাঁর গানগুলো হয়ে পড়ল ঈশ্বরকে সন্ধান করার সেই আদি অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে। তখন তিনি গাইলেন 'গুড্ডি উড়াইল মোর, মৌলার হাতের ডুরি/হাছন রাজারে যেমনি ফিরায়, তেমনি দিয়া ফিরি।' সেই ঈশ্বরের প্রেমে পড়ে তিনি ঈশ্বরকে কল্পনা করতে শুরু করলেন বন্ধু হিসেবে। লিখলেন 'আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে/আরে দিলের চক্ষে চাইয়া দেখো বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।' আর বন্ধুর প্রেমের বাঁধা হিসেবে তাঁর মনে হলো আপন স্ত্রী, সন্তান। তিনি গাইলেন 'স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল/কেমনে করিবে হাছন বন্ধের সনে মিল।' স্রষ্টাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি দেখলেন আল্লাহ, হরি সবই এক। গাইলেন 'আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি/আমি কি তোর যমরে ভয় করি।' সিলেটের অঞ্চলিক ভাষায় খুব সহজ-সরল করেই তিনি বাঁধতে পারতেন গান। তিনি আরো লিখেছিলেন, 'লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি বালা না আমার।' তাঁর লেখা একটি গান হলো_'আমি যাইমু রে যাইমু আল্লার সঙ্গে/হাছন রাজা আল্লা বিনে কিছুই নাহি মাঙ্গে।' আজ ৬ ডিসেম্বর। ১৯২২ সালের এই দিনে হয়তো তিনি তাঁর বন্ধের কাছেই চলে গিয়েছিলেন আমাদের ছেড়ে। আমরা সেই গুণী মরমি সাধককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
No comments