আন্তর্জাতিক-'সাদা-বীর' ব্রেইভিক!

রওয়ের হামলা কি বিচ্ছিন্ন? উন্মাদের কাণ্ড মাত্র?নাকি ইসলামবিদ্বেষী শক্তি-উত্থানের আভাস? আপাত শান্ত সমাজব্যবস্থার গভীরে কি প্রোথিত এর মূল? সেই বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখার বিস্তার কি এই দেশ এবং দেশ হয়ে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে, যার আক্রমণের হুমকিতে আস্ত একটা মহাদেশ, সভ্যতাশ্রাবণ সরকারএক লহমায় ৭৭ জনকে নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যার একমাত্র খলচরিত্র আন্দেয়ার্স বেইরিং ব্রেইভিক মানসিক


ভারসাম্যহীন! নরওয়ের আদালত-নিযুক্ত মনোরোগ চিকিৎসকরা এমনটাই দাবি করেছেন।\গত সপ্তাহে আদালতের এই ঘোষণায় দেশটির সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা যারপরনাই বিস্মিত। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী ব্রেইভিক নিজে কী বলছেন? তাঁর সাফ জবাব, এতে তিনি অপমানিত বোধ করছেন! এখানেই শেষ নয়, ব্রেইভিক বলছেন, শুরু থেকেই এমন রায়ের আশঙ্কা ছিল তাঁর। আটকের পর দেওয়া স্বীকারোক্তিতেও তিনি হামলার দায় স্বীকার করে পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি 'অনুতপ্ত' নন।
এহেন 'সুস্থ' চিন্তার সুস্থির এক আত্মস্বীকৃত খুনিকে বাঁচানোর কূটকৌশল কী এই ঘোষণা? প্রশ্ন না উঠে পারে না। উঠেছেও। খোদ নরওয়েজীয়রাই আশঙ্কা করছে, ব্রেইভিক 'হালকা' সাজা পেয়ে খালাস পেয়ে যেতে পারেন। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞও আদালতের বিরোধিতা করে বলছেন, ব্রেইভিক মোটেই অসুস্থ নন।

ব্রেইভিকের 'ব্রেইভনেস'!
আশঙ্কা ছিল না, তাই আগাম কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। গত ২২ জুলাই এমন নিরুদ্বিগ্ন এক দিনে জোড়া হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয় নরওয়ে। কয়েক মিনিটেই নিভে যায় ৭৭টি প্রাণপ্রদীপ! দুটি হামলারই 'নায়ক' ৩২ বছর বয়সী ব্রেইভিক_জাতিগতভাবে সাদা নরওয়েজীয়।
স্বাচ্ছন্দ্য, অধিকার, নিরাপত্তা, স্থিতি_সব মিলিয়ে নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বসতভূমি। ষাটের দশকে বিপুল পরিমাণ তেল আবিষ্কার এবং দ্রুত শিল্পোন্নয়নের ফলে অন্যতম ধনী দেশের তালিকায় থাকা নরওয়ের জনসংখ্যা অর্ধকোটিরও কম। ইউরোপের দ্বিতীয় কম জনঘনত্বপূর্ণ চার লাখ বর্গকিলোমিটারের দেশটিতে অভাব-বঞ্চনা-অস্থিতি ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। তেল থেকেই বার্ষিক আয় চার হাজার কোটি ডলার।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের সম্মাননা জানাতে ফি বছর শান্তির আসর বসে তিলোত্তমা নগরী রাজধানী অসলোতে। কৃতীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার। এমন শান্তি ও সমৃদ্ধির রাজযোটক বুঝি শুধু নরওয়ের ঠিকুজিতেই লেখা! স্ক্যান্ডেনেভিয়ান এ দেশটিতে তাই 'অন্ধকার' ছিল না কোনো! অথচ ব্রেইভিকের 'সাহসিকতাপূর্ণ' হামলা সব কিছু ওলটপালট করে দিল!

'দারোয়ান ব্যাটা চোর'!
হামলার প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতেই নরওয়েবাসী 'নিশ্চিতভাবে' ধরে নেয়, ইসলামী জঙ্গিদের কাজ এটা। গণমাধ্যমের সন্দেহও অভিন্ন। ততক্ষণে খবর বেরোয় : হামলাকারী একজন নরডিক। গোষ্ঠী বা দল নয়, একা, একজনই কেড়ে নিয়েছে এত নিরীহ প্রাণ।
হামলার চেয়ে এ খবরেই যেন জেগে ওঠে বেশি বিস্ময়-বিভ্রম! জনমনে গুঞ্জন ওঠে_ব্রেইভিক কি তাহলে উন্মাদ? খ্যাপা পাগল? নইলে কিভাবে এমন দুষ্কর্ম করবেন? সেই থেকে ব্রেইভিক যে একজন মানসিক রোগী, তাঁর মনোবৈকল্য আছে_এই আলোচনা দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে।
ইউরোপজুড়ে বাম, ডান, মধ্য, মধ্য দক্ষিণ, মধ্য বাম_মোটামুটি সব পথের রাজনীতিকেরই বক্তব্য, এমন দানবীয় হিংস্রতা কেবল মানসিক রোগগ্রস্তের পক্ষেই দেখানো সম্ভব। অতএব ব্রেইভিক অসুস্থ!
বহু-সংস্কৃতির বহুবিধ মুক্ত মিলনে আস্থাশীল প্রচারমাধ্যমেরও একাংশের মত, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সুতরাং এ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না।
আত্মস্বীকৃত ঘাতক ব্রেইভিকের আইনজীবীও আদালতে বলেন, তাঁর মক্কেল মানসিকভাবে সুস্থ নন। এত মানুষকে একসঙ্গে মেরে তিনি নিজেকে যেভাবে দেশের 'রক্ষাকর্তা' ভাবছেন (ব্রেইভিক নিজেকে ক্রুসেডের একজন নাইটস টেম্পলার মনে করেন), অন্যের 'টনক' নড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন, নিজেকে 'ন্যায়যুদ্ধের' যোদ্ধা ভাবছেন, তাতে তাঁর মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত আদালতও তা-ই বললেন!

'শ্বেত মানব' বনাম 'কালা আদমি'
ব্রেইভিক অসুস্থ প্রমাণিত হলেই তাঁর অপরাধের দণ্ড কমবে, হলফ করে বলা যায় না। তথ্য-প্রমাণ, সাক্ষ্য-সাবুদের ভিত্তিতে আদালত রায় দেবে। তবে নরওয়ের ঘটনায় একটি প্রশ্ন বলক দিয়ে ওঠে, তা গুরুতর।
ব্রেইভিক যে মানসিকভাবে 'সম্পূর্ণ' সুস্থ নন, তা বলার জন্য ডাক্তার-মোক্তার, বৈদ্য-কবিরাজ বা আদালতের দরকার পড়ে না। মুহূর্তে ৭৭টি প্রাণ কেড়ে নেওয়ার যে প্রবণতা বা দৃষ্টিভঙ্গি, তা সুস্থ মানুষের থাকা সম্ভব নয়। প্রশ্নটি সেখানেও নয়। প্রশ্নটি হলো, যদি নরওয়েজীয়দের প্রাথমিক 'সুনিশ্চিত' ধারণাটা না ভাঙত, যদি জানা না যেত শ্বেতাঙ্গ নরডিক নন, এক 'কালা' মুসলিম হত্যাযজ্ঞের নীলনকশাকারী, তাহলে কি অপরাধীর মানসিক অসুস্থতার প্রশ্নটা দানা বাঁধত? বিক্ষিপ্ত ঘটনা, বিচ্ছিন্ন হামলা, বদ্ধ উন্মাদ, পুরো অসুস্থ, আস্ত পাগল ইত্যাদি শোনা যেত?
যে উগ্রপন্থী বা সন্ত্রাসবাদীরা হত্যাকাণ্ড বা ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটন করে থাকে, তাদের সবার মধ্যেই বোধ করি সুস্থতার বিচ্যুতি থাকে। কোনো না কোনোভাবে এই প্রাণ-প্রাচুর্যময় জগতের রং-রূপ-বর্ণ-গন্ধের সমাহার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার না করলে নিরীহ-নিরপরাধ প্রাণ ধ্বংস করা কি সম্ভব?
তবে কোনটা মানসিক সুস্থতা বা অসুস্থতা, কোনটা মানবিক দৈন্য অথবা স্বার্থপরতা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সব শ্রেণীর সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও বিবেচ্য, এটুকু কবুল করা দরকার। সন্ত্রাসকারী 'সাদা' হলে প্রশ্নটা উঠবে, 'কালা' হলে উঠবে না, এমন ভাবনা সভ্যতার পরিপন্থী, একপেশে এবং বিপজ্জনক!

'ব্রেইভিকরা যুগে যুগে'
১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরে ট্রাকবোমা দিয়ে ১৬৮ জনকে নির্বিচারে হত্যা করে উগ্রবাদী খ্রিস্টানরা। সেই হত্যাযজ্ঞের 'নায়ক' টিমোথি ম্যাকভিও ছিলেন ইসলামবিদ্বেষী। অভ্যন্তর থেকে উদ্ভূত এমন অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী যুক্তরাষ্ট্র। এমন অঘটন ঘটেছে ব্রিটেন, স্পেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, এমনকি বাংলাদেশেও।
প্রতিটি বর্বরোচিত ঘটনাই ঘটিয়েছে চরমপন্থী বা উগ্রমতবাদীরা। দুর্ভাগ্যবশত এসব সন্ত্রাসীকাণ্ডে কখনো স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র অথবা দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা বা রাজনৈতিক সংগঠনও জড়িত ছিল। দেখা গেছে, কখনো কখনো রাষ্ট্রচালকরা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃত সত্য বা ঘটনার মূল উদ্ঘাটনে অনাগ্রহী। বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত একটি একপেশে ধারণা প্রতিষ্ঠায় তারা উদ্যোগী; এবং তা মূলত 'ইসলামবিদ্বেষী'।

'উন্মাদের' পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ
বহু-সংস্কৃতিবাদ এবং ইসলাম সম্প্রসারণের বিরোধী ভিয়েনা স্কুল অব থটের অনুসারী ব্রেইভিক নিজের উগ্রপন্থী খ্রিস্টান পরিচয়ে দারুণ তৃপ্ত। ডানপন্থী রক্ষণশীল দল প্রোগ্রেস পার্টির সমর্থক এবং সাবেক এই সদস্য নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিবিদ গিয়ার্ট ওয়াইল্ডার্সের দারুণ ভক্ত।
হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে একটি কৃষি খামার করেন ব্রেইভিক। কেনেন ছয় টন সার। উদ্দেশ্য_বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার। সুতরাং হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি বহুদিন ধরেই। আকস্মিক উন্মাদনা নয়, 'সুস্থ' ব্রেইভিকের 'সুস্থ' পরিকল্পনার ফসল এই হত্যাযজ্ঞ।

'অনুতপ্তহীন' ডানপন্থীদের উত্থান
টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত 'সন্ত্রাসবাদবিরোধী' যুদ্ধে সমান তালে যোগ দেয় পশ্চিমা গণমাধ্যমও। 'হা-রে-রে-রে' ডাক ছেড়ে ইসলামপন্থী জঙ্গি নির্মূলে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে দোর্দণ্ড পশ্চিমা সেনাশক্তি। আর গণমাধ্যম ছড়াতে থাকে 'বিদ্বেষ'! বিশ্লেষকরাও দিন দিন জঙ্গিবাদের নিত্যনতুন মাপ-পরিমাপ হাজির করতে থাকেন জনসমক্ষে। তবে নরওয়ের ঘটনায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে 'টনক' নড়েছে তাঁদের। এখন 'উল্টো গীত' গাইছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নরওয়ের ঘটনা নতুন ধরনের সন্ত্রাসবাদের সতর্কবার্তা। ইসলামপন্থীদের ওপর বেশিমাত্রায় নজর দেওয়ার ফাঁকে অভ্যন্তরীণ হুমকি গেছে চোখ এড়িয়ে। এরই মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় উগ্র ডানপন্থী এবং জাতীয়তাবাদীরা তাদের অবস্থান শক্তপোক্ত করেছে। ইসলামী কট্টরপন্থীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত 'ফোকাস' অন্যান্য উগ্রপন্থী মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড প্রসারে সহায়তা করছে।

'টনকের' খতিয়ান
২০০৫ সালে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ১২টি ব্যঙ্গচিত্র ছাপে ডেনমার্কের 'জিল্যান্ডস-পোস্টেন' পত্রিকা। বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় তোলা ওই ঘটনার ফল কী দাঁড়ায়? কার্টুনিস্টের পক্ষ নেওয়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পিপলস পার্টি। রক্ষণশীল এই দলটি ইসলামবিরোধী। শুরু হয় 'মত প্রকাশের অধিকার ডেনিশ উত্তরাধিকার' আন্দোলন। কেবল সাধারণ ডেনিশরাই ইসলামবিরোধিতার জ্বরে আক্রান্ত নয়, ডেনিশ রানি দ্বিতীয় মার্গারেট স্বয়ং ঘোষণা করেন_'ডব যধাব ঃড় ংযড় িড়ঁৎ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ ঃড় ওংষধস ধহফ বি যধাব ঃড়, ধঃ ঃরসবং, ৎঁহ ঃযব ৎরংশ ড়ভ যধারহম ঁহভষধঃঃবৎরহম ষধনবষং ঢ়ষধপবফ ড়হ ঁং নবপধঁংব ঃযবৎব ধৎব ংড়সব ঃযরহমং ভড়ৎ যিরপয বি ংযড়ঁষফ ফরংঢ়ষধু হড় ঃড়ষবৎধহপব.'
সুইডেনে গত সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে বিপুলভাবে জিতেছে দক্ষিণপন্থীরা। তাদের জয়ের অন্যতম নিয়ামকও ইসলামবিরোধিতা। বর্তমানে দেশটিতে ৫ শতাংশের মতো মুসলমান বাস করে।
ইসলামবিরোধী হাওয়া বেশ জোরালো নেদারল্যান্ডসে। দেশটির অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক এবং ব্রেইভিকের 'ভাবগুরু' ওয়াইল্ডার্সের প্রচার-প্রসারেরও পুঁজি ইসলামবিরোধিতা। পার্টি ফর ফ্রিডমের এই নেতা 'ইসলামাইজেশন'-এর বিরুদ্ধে বলেছিলেন, কোরআনের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় অ্যাডলফ হিটলারের 'মেইন কাম্প্ফ' (গু ঝঃৎঁমমষব)। তাঁর এই বক্তব্যের জেরে মামলা হলেও তাতে তিনি জেতেন এবং দেশের অন্যতম 'নায়ক' হিসেবে অভিনন্দিত হন। অথচ নেদারল্যান্ডসে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ। এই ক্ষুদ্র সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়েই ইউরোপের মধ্যে ইসলামবিরোধিতার 'কেন্দ্রবিন্দু' এখন নেদারল্যান্ডস!

ব্যতিক্রম নরওয়ে
তুলনামূলক প্রতিবেশীদের চেয়ে নরওয়েতে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি_মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই বর্ধিষ্ণু সেখানে। গত ১৫ বছরে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ। এই সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নাগরিক ক্ষোভও!
নরওয়ে বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য দেশ হলেও আরো স্বাচ্ছন্দ্যের, আরো অধিকার ভোগের দাবি তো থাকতেই পারে। বরং জীবন যেখানে শান্ত, নিস্তরঙ্গ, বেঁচে থাকার কঠিনতর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কমজোরি, সেখানে অভিবাসী সমস্যার মতো তুলনামূলক নিরীহ ব্যাপারে 'কল্পিত ভয়' বাসা বাঁধতে পারে বৈকি। তবে রাষ্ট্রীয় স্তরে সুইডেন, ডেনমার্ক বা নেদারল্যান্ডসের মতো পোক্ত অভিবাসীবিরোধিতার পথে হাঁটেনি নরওয়ে।

বহু-সংস্কৃতির কুফল!
জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সিনেটর থিলো সারাজিন 'জার্মানি ডাজ অ্যাওয়ে উইথ ইটসেল্ফ' নামে একটি বই লিখেছেন। ২০১০ সালের আগস্টে প্রকাশিত বইটির বিষয়বস্তু : মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি জার্মান রাষ্ট্রের 'অতি-সদয়' আচরণ। বহু-সংস্কৃতিতে বীতশ্রদ্ধ সারাজিনের মতে, সরকারের এই অবস্থান আত্মহননের তুল্য। এ ঘটনায় বিব্রত জার্মান সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই দুই-তিন সপ্তাহে বইটির ১২ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়।
কয়েক মাস আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি_প্রত্যেককেই তাঁদের আলাদা ভাষায় এই একই কথা বলেন। তাঁদের ভাষ্য, বহু-সংস্কৃতির নীতি ব্যর্থ।
এখন প্রশ্ন হলো, বহু-সংস্কৃতি নিয়ে ভাবিত এসব রাষ্ট্রনেতা ব্রেইভিকের মতো চরিত্র দেখে কি অবাক হচ্ছেন? তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন, বহু-সংস্কৃতিবাদের যে ব্যর্থতা তাঁদের পীড়িত করছে, ভাবিত করেছে, সেই ব্যর্থতার দায় কেবল অভিবাসী সংস্কৃতির কাঁধে চাপিয়ে দিলে চলছে না, সেই ব্যর্থতার সুলুক সন্ধানে কেবল অন্যের দিকে তাকালেই চলবে না। তাঁদের নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতির আপাত সুস্থিতির গভীরে লুক্কায়িত রয়েছে গভীরতর অসুখ, অন্ধ উন্মাদনা। এসব প্রবণতা সন্ত্রাসের, হিংসা বেড়ে ওঠায় উর্বরাশক্তি জোগায়।
সুতরাং ক্যামেরনদের মনে রাখতে হবে, বোমা-বন্দুক-বিস্ফোরণ হোক আর অসহিষ্ণুতা-হিংসা-অনুদারতাই হোক, এ কেবল 'আমাদের' বা 'তোমাদের' ব্যাপার নয়, এই সংকটের শিকড় গভীরে প্রোথিত, অনেক ছড়েবড়ে বিস্তৃত। সর্বদিকব্যাপ্ত এই সংকট থেকে উত্তরণ কিভাবে সম্ভব? অভিবাসীদের জন্য দেশের দরজা বন্ধ করে? বাইরের আলো-হাওয়া ছাড়া উদার গণতন্ত্রের উন্নত আদর্শ আগলবন্দি অবস্থায় বাঁচবে তো?

শেষ কথা
ব্রেইভিক যদি পাগলও হন, তাঁর অবস্থান সম্পর্কে তিনি নিজে যা লিখেছেন, বলেছেন, তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট_একটি রাজনৈতিক 'দর্শন' বা বক্তব্য আছে তাঁর এবং তিনি একাই তা নিয়ে ভাবছেন না, আরো অনেকেই ভাবছেন। এই অন্য অনেকে হয়তো ছড়িয়ে আছেন সুইডেনে, ডেনমার্কে, নেদারল্যান্ডসে, জার্মানিতে, ফ্রান্সে, ব্রিটেনে, নরওয়েতেও, হয়তো ইউরোপজুড়ে। তবু ব্রেইভিকের হামলাকে বিক্ষিপ্ত পাগলামি বলে দেখে, তাঁকে মানসিক রোগী 'সাজিয়ে' সমস্যার মূল পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টাই দৃশ্যমান হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.