চিন্তাচর্চার মহান পথিক by এম.এ. আজিজ মিয়া

বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে যারা চিন্তাচর্চার অনুশীলন করেছেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন (১৯৩৬-২০১০) তাদের অন্যতম। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান অর্থাৎ জীবনচর্চার নানা দিক নিয়ে ভেবেছেন এবং অনেকটা নিভৃতে লেখালেখি করেছেন। ঘনিষ্ঠজনদের প্রচেষ্টায় তার জীবনকালে কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও তার অনেক লেখা এখনও অপ্রকাশিত।


প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ 'মার্কসবাদ ও কবিতা' (১৯৮৬)। এ অনুবাদ গ্রন্থটির মূল লেখক জর্জ টমসন। গ্রন্থটির নাম ছিল 'মার্কসইজম অ্যান্ড পোয়েট্রি'। তারপর আলফ্রেড গিয়োমের 'ইসলাম' (১৯৯৭), টমাস হার্ডির উপন্যাস 'দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ' (২০০৩) প্রকাশিত হয়। তাছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের অভিভাষণ 'কধুর ঘধুৎঁষ ওংষধস : ঝঢ়ববপযবং' (২০০৫), ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস 'পরবাস' (২০০৯) যুগ্মভাবে অনুবাদ করেন অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাসের সঙ্গে। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে 'গ্রিক দর্শনের রূপরেখা' (২০০৭), 'আরো কয়েকজন সক্রেটিস' (২০০৯) এবং আত্মজৈবনিক 'পাতা উল্টাই' (২০১০) অন্যতম। সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও চিন্তামূলক এসব লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৬ সালের ২০ মে এবং মারা যান ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর।
বিজ্ঞানের প্রতি অনাবিল আস্থাশীল অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন তার নৈতিকতা, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচেতনা নামক ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লিখেছেন, "ইতোমধ্যে বিজ্ঞান পৃথিবী নামক গ্রহটাকে ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে দূর-দূরান্তের গ্রহলোকে। 'মানুষ মরণশীল' এই প্রাকৃতিক সত্যটিকে মানলেও বিজ্ঞান মানুষকে করেছে দীর্ঘায়ু। রোগ, ব্যাধি, জরা, বার্ধক্যকে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহত করে ইতোমধ্যেই সে বলতে শুরু করেছে অনেক বিস্ময়কর কথা। যথা রোগ-ব্যাধিতে মানুষ হয়তো আর বেশিদিন মরবে না। মরবে শুধু দুর্ঘটনায়, মৃত্যু ঠেকানো না গেলেও মানুষের স্বাভাবিক আয়ু বলে আর কোনো কথা থাকবে না। সে বাঁচবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। হৃদযন্ত্র সংযোজন বিদ্যা এই সম্ভাবনা দেখাচ্ছে যে, কোনো কারণে মানুষের কোনো অঙ্গহানি ঘটলে মোটর গাড়ি বা সাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশের মতোই তা দোকান (হাসপাতাল) থেকে লাগিয়ে নেয়া যাবে। বিজ্ঞান পরিণত হবে আজকের চাইতেও আরো বেশি নিত্য সহচরে।"
রম্য রচনায় সিদ্ধহস্তের নিদর্শন আমরা পাই তার 'মেয়েদের সৌন্দর্যচর্চা' প্রবন্ধে। তার ব্যঙ্গাত্মক লেখার ধারও ছিল খুব তীক্ষষ্ট এবং অর্থবহ। 'একটি প্রার্থনার খসড়া' নিবন্ধটিতে তিনি লিখেছেন, 'সামনে ভোটপর্ব। পক্ষ বিপক্ষ মিলিয়া না হয় আরো পাঁচটি বছর ইহারা খাউক। খাউক আর মরুক। যদি শেষে শান্তি আসে। উহারা খাইয়া শেষ করিলে এবং উহারা শেষ হইলে আমরা যাহা থাকে সকলে ভাগ করিয়া খাইব।' এমনিভাবে সব লেখাতেই তিনি পরিপকস্ফতা ও মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। অধ্যাপক হোসেন লেখালেখির পাশাপাশি সামাজিক দায়বোধ থেকে বেশ কিছু সাহিত্য ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ এবং বিএলআরসির আজীবন সভাপতি ছিলেন। বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ দর্শন সমিতিসহ বেশ কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। পক্ষান্তরে সমাজ বা রাষ্ট্র এ মহান কল্যাণব্রতী মানুষটিকে পুরস্কৃত বা সম্মাননা দানের তেমন কোনো আয়োজন করেনি। এ জন্য তার মধ্যে কোনো নিরাশা বা হতাশার ছাপ দেখা যায়নি। মৃত্যুর পূর্বেকার দিনগুলোতেও তিনি মৃত্যুচিন্তার কোনো কাতরতা প্রকাশ করেননি। কেননা তিনি যথার্থই বিশ্বাস করতেন যে, অনিত্যতাই জীবনের নিত্য সত্য।
তার পুণ্যস্মৃতি মলিন হওয়ার নয়।

No comments

Powered by Blogger.