দৃষ্টিপাত-ঢাকা বিভক্তির পেছনের রাজনীতি by আরিফ জেবতিক
কোনো ধরনের সত্যিকারের প্রয়োজন ছাড়াই শেষ পর্যন্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো। এই বিভক্তির বিরুদ্ধে জনমত প্রবল, কিন্তু সরকার সেই জনমতের তোয়াক্কা করছে বলে মনে হচ্ছে না। সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, নগরবাসীর জন্য উন্নততর সেবা নিশ্চিত করতেই সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়েছে। এমন এক সময় সরকার এ বক্তব্য দিচ্ছে, যখন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নিয়ে ছেলেখেলা করা হচ্ছে খোদ সরকারের
উদ্যোগেই। উপজেলাব্যবস্থা এর সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে। সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের আইন-কানুন সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে সংসদ সদস্যরা উপদেষ্টা হিসেবে আছেন, চেয়ারম্যানেরও সান্ত্বনাসূচক কিছু ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে আমলার হাতেও অনেক ক্ষমতা রাখা হয়েছে। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় উপজেলা প্রশাসন যে আরো স্থবির একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
উপজেলা নিয়ে কথা শেষ করে খুব তাড়াহুড়া করে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে ফেলেছে। অনেকেই বলছেন, মাত্র কয়েক মিনিটে এই বিল সংসদে পাস হওয়া ঠিক হয়নি। তাঁরা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ বলে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এই অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই কোনো সংসদ সদস্যের। সুতরাং সরকার নীতিগতভাবে যে বিলে অনুমোদন দিয়ে দেয়, সংসদের গিয়ে সেটি চার মিনিটে পাস হলো নাকি চার মাস আলোচনা হলো, তাতে তেমন কোনো পার্থক্য হয় না; কারণ এই বিল পাস না হওয়ার কোনো উপায় আলোচনা থেকে আসবে না।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য আসলে কী, সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। কয়েক দিন আগে এই রাজনীতি ম্যাগাজিনেই এ নিয়ে প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ হয়েছে। একটা বড় অংশের জনগণের ধারণা, সাদেক হোসেন খোকাকে জব্দ করার জন্যই ডিসিসিকে দুই ভাগ করা হয়েছে। আমার এ রকমটা মনে হয় না। সাদেক হোসেন খোকাকে জব্দ করার জন্য এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, সরকার চাইলে আরো অনেক উপায়েই সেটি করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক খ্যাতি, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সর্বোপরি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিও ড. ইউনূসের কোনো কাজে আসেনি, সে ক্ষেত্রে সাদেক হোসেন খোকা জনপ্রতিনিধি হলেও সরকার চাইলে তাঁকে আরো অনেক কম আয়াসেই জব্দ করতে পারত।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা যে একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ, সেটি আমরা আগেই বলেছি। অপ্রয়োজনীয় কাজের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের মাঝেমধ্যেই প্রবল উৎসাহ দেখা যায়। সরকারে আসার পর পরই তারা ঘড়ির কাঁটাকে আগু-পিছু করে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিল। মাঝখানে হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আড়িয়ল বিলে নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে। এ ধরনের অনেক নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের তালিকা করা যাবে।
ডিসিসির বিভক্তি এ রকমই একটি কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ। সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে একটি সিটি করপোরেশন থাকার কারণেই ঢাকাবাসীর নাগরিকসুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর সত্যিই যদি এমনটা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের জনবল বৃদ্ধি করে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যেত।
এত পথ থাকার পরও সরকার এই কাজটি করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের বিভক্তিকে আমি সমর্থন করি না, কিন্তু এ কথাও সত্য যে এই বিভক্তি এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়, যার জন্য বিএনপিকে হরতাল ডেকে বসতে হবে এবং এক শ্রেণীর নব্য রাজনীতিবিদ সুশীল শ্রেণীর প্রতিনিধিদের পত্রিকায় কলাম লিখে সেই হরতাল সমর্থন করতে হবে।
সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা মানেই ঢাকাকে বিভক্ত করা নয়। দুটি সিটি করপোরেশনের কারণে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে এবং কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হবে, কিন্তু যেভাবে 'ঢাকা ভাগ হচ্ছে' বলে চেঁচামেচি চলছে, সে ধরনের কিছু হবে না। ঢাকার বৃদ্ধি এবং অখণ্ডতা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না। ঢাকা এমনিতেই অনেক সংসদীয় আসনে বিভক্ত। সেই বিভক্তি যদি ঢাকাকে টুকরো টুকরো করতে না পারে, তাহলে স্থানীয় সরকারের একটি অঙ্গও সেই বিভক্তি তৈরি করতে পারবে না।
বিএনপি তবু এই ইস্যু নিয়ে একটি হরতাল ডেকেছে। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত হরতাল বেশ জোরেশোরেই পালিত হচ্ছে। মিডিয়া এই হরতালের খবর জোগাড়ে ব্যস্ত, সুশীল সমাজ হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলতে ব্যস্ত আর সরকার ও বিরোধী দল রাজপথে পরস্পরকে প্রতিরোধের পথ খুঁজতে ব্যস্ত সময় পার করছে। আর এখানেই রাজনীতির মূল খেলাটি আমার চোখে ফুটে ওঠে। ডিসিসি বিভক্তির মূল কারণটি আমি ধরতে পারি। সরকার কখনোই অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলো অপ্রয়োজনে নেয় না। সেটি তারা নেয় তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে। দেশে এখন অনেক সমস্যা দানা বাঁধছে। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষও নাড়াচাড়া দিয়ে বসছে। এর বাইরে ভারতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়েও জোর কথা উঠেছে।
এই সময় আমাদের চোখের সামনে আবারও খবর হয়ে এসেছে টিপাইমুখ বাঁধ। ভারত আমাদের কাছ থেকে কয়েক বছর ধরে অতি উষ্ণ আপ্যায়ন আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পাওয়ার পরও আমাদের সরকারকে এমনকি অবহিত না করেই টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।
এই টিপাইমুখ নিয়ে তাই আমাদের সরকারকে বড় আকারের জনমতের চাপ সামলাতে হবে। এই সময়ে এসে সরকার তাই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে দিয়েছে, আর আমাদের বিরোধী দলও এই কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে আঁকড়ে ধরে হরতালে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর পেছনে আপাত আড়ালে পড়ে গেল ভারতের সঙ্গে সরকারের একতরফা মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল সম্পর্কের কথা। আড়ালে চলে গেল অর্থনীতির নাজুক গতি-প্রকৃতির আলোচনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও শেয়ারবাজার যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না, সে আলোচনাও চাপা পড়ে গেল ডিসিসি বিভক্তির আলোচনা আর আন্দোলনের নিচে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে এটাই সরকারের কৌশল। তারা বড় ইস্যু চাপা দেওয়ার জন্যই এসব ছোট ইস্যু তৈরি করে। আর আমাদের বিরোধী দল আগ-পিছ না ভেবে সেই ছোট ইস্যুর পেছনে ছুটে বড় ইস্যুগুলোকে দুর্বল করে ফেলে। রাজনীতির এই জটিল খেলায় বিরোধী দল এখনো যে সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, ডিসিসিকে ঘিরে বিরোধী দলের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা সে কথাই আবার প্রমাণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
No comments