স্মৃতিতে ভাস্বর নোবেলজয়ী পদার্থবিদ by এম শামসুর রহমান
আজ ২১ নভেম্বর। এ উপমহাদেশের অসাধারণ প্রতিভা নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালামের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রফেসর সালামের মৃত্যুদিবস তাই বিজ্ঞান জগতের এক দেবনাবিধুর দিন।আবদুস সালাম ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি, যিনি নোবেল জয়ের খ্যাতি অর্জন করেন। বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আদমস পুরস্কারসহ তিনি বহু পুরস্কারের গৌরবে মণ্ডিত হন।
১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারি আবদুস সালাম তৎকালীন ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪৬ সালে গণিতে এমএ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে র্যাংলার (wrangler) হওয়ার দুর্লভ কৃতিত্বেরও অধিকারী তিনি। এ সূত্রে প্রফেসর সালাম গণিত শিক্ষায় রেখেছেন সৃজনশীল মেধার স্বাক্ষর। গণিত চর্চায় ছিলেন শতাব্দীর অন্যতম প্রধান পুরুষ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। আবদুস সালাম লাহোর সরকারি কলেজ ও কেমব্রিজে অধ্যাপনা করেন। এরপর লন্ডন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ৩১ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে তিনি তাত্তি্বক পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে তারই নিরলস প্রচেষ্টায় ইতালির ত্রিয়েস্তে আন্তর্জাতিক তাত্তি্বক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন পরিচালক পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরে সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। তার মৃত্যুর পর এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে The Abdus Salam International Centre for Theoretical Physics. বাংলাদেশে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে আবদুস সালাম দৃষ্টিগ্রাহ্য অবদান রাখেন। এ বিশ্ববরণ্যে বিজ্ঞানীর অকৃপণ সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে (১৯৮৮)। পদার্থবিজ্ঞানে অসামান্য ও অনন্যপূর্ব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ওই বছরই ছিল প্রফেসর সালামের শেষ বাংলাদেশ সফর। ত্রিয়েস্তের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে বহুবিধ কর্মশালায় আমি অংশগ্রহণ করি। অধিকন্তু Long-term Visiting Mathematician(১৯৯০) ও Associate member (১৯৯০-৯৫) হিসেবেও সেখানে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এভাবেই ওই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় দেড় দশক কালের আমার নিবিড় যোগসূত্র।
এক সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রফেসর সালামের মানসিকতা ও মহত্ত্বের যে লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এখানে তা তুলে না ধরা থেকে বিরত থাকতে পারছি না। ১৯৮৩ সালের আগস্ট। ত্রিয়েস্তের এক কর্মসূচিতে আমি যোগদান করেছি। আমার সঙ্গে সে সময় ছিলেন আমার সহকর্মী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের সহকারী প্রফেসর সত্রাজিৎ কুমার সাহা। প্রফেসর সালাম এক মনোরম অপরাহ্নে যোগদানকারী বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। আমিও সে আমন্ত্রণ রক্ষা করি। আমাদের একজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে একটি প্রশ্ন করেন। তিনি স্মিতহাস্যে ও অসংকোচে বলেন, Sorry, I do not know this thing কেউ সর্ববিদ্যা বিশারদ নন। তাই প্রকৃত জ্ঞানতাপসের মধ্যেই এ ধরনের অকপট স্বীকৃতি সম্ভব। বিদেশে কয়েকবার প্রফেসর সালামের সাহচর্যে এসেছি। আজও মনে পড়ে, আমি ও কয়েকজন বিজ্ঞানী তার অফিসকক্ষে ১৯৯০ সালের এপ্রিলে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছুকাল অক্সফোর্ডে বসবাস করতেন। ১৯৯৩ সালের আগস্টে আবদুস সালাম অক্সফোর্ড থেকে দু'চারদিনের জন্য ত্রিয়েস্তে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানে এলেন। জাহাঙ্গীরনগরের গণিতের আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন শিক্ষক তার সঙ্গে কোনোভাবে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করি। সে সময় তিনি প্রায় বাকশক্তিহীন ও চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। তার মায়াবী মুখটির দিকে তাকিয়ে আমারও মন বিষণ্নতায় ভরে উঠল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতি আয়োজিত পঞ্চম গণিত সম্মেলনের (২৭-২৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৬) প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে ও সম্মেলনের সাফল্য কামনায় প্রফেসর সালাম সমিতির তদানীন্তন সভাপতি প্রফেসর এসএম শরফুদ্দিনের কাছে তার পত্রের উত্তর পাঠান ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ সালে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর ওই প্রেরণাদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক পত্রটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পঠিত হয়। উল্লেখ্য, ওই গণিত সম্মেলনের আমি ছিলাম সাংগঠনিক সম্পাদক। গণিত সমিতির সঙ্গে যোগ সম্পর্কের স্মারক হিসেবে প্রফেসর সালামের পত্র আমাদের কাছে এক অতি মূল্যবান সম্পদ। আমার সম্পাদনাকালে সমিতির মুখপত্র 'গণিত পরিক্রমা' সপ্তম খণ্ড ১৯৯৭ এবং ১৬শ' খণ্ড ২০০৬ সালে পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডে প্রফেসর সালাম ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে আমি একটি বার্তা প্রেরণ করি। আবদুস সালামতনয় আহমেদ সালাম লন্ডন থেকে সে শোকবার্তার প্রত্যুত্তর দেন ১০ ডিসেম্বর, ১৯৯৬। শোকে মুহ্যমান সন্তানের নিজস্ব মননে লেখা এ চিঠি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাই সম্পাদক হিসেবে ২০০৫ গণিত পরিক্রমা ১৫শ' খণ্ডে ওই চিঠিও পত্রস্থ করেছি।
সুঠামদেহী শ্মশ্রুমণ্ডিত পুরুষ আবদুস সালাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। এ ইতিহাসখ্যাত বিজ্ঞানী, মনস্বী শিক্ষাবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্ম ও জীবন দর্শন আমাদের কাছে উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞান চর্চায় ও শিক্ষার মহান ব্রতে উৎসর্গীকৃত মনীষীর ২০০৯ সালের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি হিসেবে আমার কার্যকালে (২০০৮-০৯) এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশের স্বনামখ্যাত কিছু গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী ওই অনুষ্ঠানে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। আবদুস সালামকে আজ আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি এবং নিবেদন করছি তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এম শামসুর রহমান :ফেলো, ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ গণিত সমিতি
এক সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রফেসর সালামের মানসিকতা ও মহত্ত্বের যে লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এখানে তা তুলে না ধরা থেকে বিরত থাকতে পারছি না। ১৯৮৩ সালের আগস্ট। ত্রিয়েস্তের এক কর্মসূচিতে আমি যোগদান করেছি। আমার সঙ্গে সে সময় ছিলেন আমার সহকর্মী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের সহকারী প্রফেসর সত্রাজিৎ কুমার সাহা। প্রফেসর সালাম এক মনোরম অপরাহ্নে যোগদানকারী বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। আমিও সে আমন্ত্রণ রক্ষা করি। আমাদের একজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে একটি প্রশ্ন করেন। তিনি স্মিতহাস্যে ও অসংকোচে বলেন, Sorry, I do not know this thing কেউ সর্ববিদ্যা বিশারদ নন। তাই প্রকৃত জ্ঞানতাপসের মধ্যেই এ ধরনের অকপট স্বীকৃতি সম্ভব। বিদেশে কয়েকবার প্রফেসর সালামের সাহচর্যে এসেছি। আজও মনে পড়ে, আমি ও কয়েকজন বিজ্ঞানী তার অফিসকক্ষে ১৯৯০ সালের এপ্রিলে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছুকাল অক্সফোর্ডে বসবাস করতেন। ১৯৯৩ সালের আগস্টে আবদুস সালাম অক্সফোর্ড থেকে দু'চারদিনের জন্য ত্রিয়েস্তে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানে এলেন। জাহাঙ্গীরনগরের গণিতের আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন শিক্ষক তার সঙ্গে কোনোভাবে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করি। সে সময় তিনি প্রায় বাকশক্তিহীন ও চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। তার মায়াবী মুখটির দিকে তাকিয়ে আমারও মন বিষণ্নতায় ভরে উঠল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতি আয়োজিত পঞ্চম গণিত সম্মেলনের (২৭-২৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৬) প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে ও সম্মেলনের সাফল্য কামনায় প্রফেসর সালাম সমিতির তদানীন্তন সভাপতি প্রফেসর এসএম শরফুদ্দিনের কাছে তার পত্রের উত্তর পাঠান ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬ সালে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর ওই প্রেরণাদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক পত্রটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পঠিত হয়। উল্লেখ্য, ওই গণিত সম্মেলনের আমি ছিলাম সাংগঠনিক সম্পাদক। গণিত সমিতির সঙ্গে যোগ সম্পর্কের স্মারক হিসেবে প্রফেসর সালামের পত্র আমাদের কাছে এক অতি মূল্যবান সম্পদ। আমার সম্পাদনাকালে সমিতির মুখপত্র 'গণিত পরিক্রমা' সপ্তম খণ্ড ১৯৯৭ এবং ১৬শ' খণ্ড ২০০৬ সালে পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডে প্রফেসর সালাম ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে আমি একটি বার্তা প্রেরণ করি। আবদুস সালামতনয় আহমেদ সালাম লন্ডন থেকে সে শোকবার্তার প্রত্যুত্তর দেন ১০ ডিসেম্বর, ১৯৯৬। শোকে মুহ্যমান সন্তানের নিজস্ব মননে লেখা এ চিঠি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাই সম্পাদক হিসেবে ২০০৫ গণিত পরিক্রমা ১৫শ' খণ্ডে ওই চিঠিও পত্রস্থ করেছি।
সুঠামদেহী শ্মশ্রুমণ্ডিত পুরুষ আবদুস সালাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। এ ইতিহাসখ্যাত বিজ্ঞানী, মনস্বী শিক্ষাবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্ম ও জীবন দর্শন আমাদের কাছে উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞান চর্চায় ও শিক্ষার মহান ব্রতে উৎসর্গীকৃত মনীষীর ২০০৯ সালের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ গণিত সমিতির সভাপতি হিসেবে আমার কার্যকালে (২০০৮-০৯) এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশের স্বনামখ্যাত কিছু গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী ওই অনুষ্ঠানে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। আবদুস সালামকে আজ আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি এবং নিবেদন করছি তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এম শামসুর রহমান :ফেলো, ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ গণিত সমিতি
No comments