ভিন্নমত-সংকট মোকাবিলার পথ হলো ব্যয় কমানো by আবু আহমেদ
বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতি প্রায় এক যুগ ঋণ করে ঘি খেয়েছে। আমেরিকানদের এ ধারণা দেওয়া হয়েছে যে তাদের জীবনযাত্রার মান শুধু বাড়বেই, তাদের আয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। শুরু হয়ে গেল ঋণ বিক্রির মহোৎসব। আয় যা-ই থাকুক না কেন, বলা হলো, তোমরা শুধু ব্যয় করো। তোমরা ঋণ করে বাড়ি কেনো, ঋণ করে মূল্যবান ভোগ্যপণ্য কেনো, তোমরা ঋণ করে বাইরে বেড়াতে যাও।
কিছুদিন তো ভালোই গেল। ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তাদের শেয়ারবাজার একটানা বেড়ে গড়ে শেয়ার মূল্য তিন গুণ হলো। বাড়িঘরের বাজারও রমরমা থাকল। বাড়ি কিনলে বছর ঘুরতে বর্ধিত মূল্য তবে ঋণের অর্থ ফেরত দিয়ে ক্রেতার আরো অনেক লাভ হতো। কিন্তু এসব অর্থনৈতিক উৎসব তখনই সংঘটিত হচ্ছিল, যখন তাদের সরকারও বড় রকমের ঋণের জালে আবদ্ধ হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক সঞ্চয় ঋণাত্মক হলো। এর অর্থ হলো, বিদেশিরা তাদের অর্থনৈতিক চাকা ঘোরানোতে তেলের জোগান দিচ্ছিল। সেই বিদেশিরা হলো ওরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য বেচে যথেষ্ট মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছিল। ডলার ছাপানোতে লেগে গেল মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে দেশে ডলারের বিরাট রিজার্ভ গড়ে উঠতে লাগল। কিন্তু বেশির ভাগ সেই অতিরিক্ত ডলার ঋণ হিসেবে আবার মার্কিন সরকার ও জনগণের কাছে বিক্রি করা হলো। এই বিক্রেতা দেশগুলো হলো চীন, ভারত, সিরিয়া ও সৌদি আরব। কিন্তু এসব দেশের মনের মধ্যে একটা শঙ্কা বরাবরই কাজ করছিল, সেটা হলো মার্কিন ডলারের মূল্য শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকবে তো! সত্যি আজকে মার্কিন ডলারের মূল্যের পতন হচ্ছে এবং তার মূলে হলো তাদের অর্থনীতির পতন। ওদিকে ইউরোপেও ঋণের ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রিস, পর্তুগাল ও ইতালি ঋণে জর্জরিত। ফ্রান্স ও জার্মানি ওদের ঋণ দিয়ে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে বটে, তবে সেই পুনরুদ্ধার প্যাকেজ জনগণের জন্য অনেক ব্যয়বহুল হবে। বলা হচ্ছে, ঘাটতি কমাও, ব্যয় কম করো, আর ট্যাঙ্ বেশি দাও। আজকে ইউরোপীয় মুদ্রা ইউরোও দুর্বল হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডলার-ইউরোর ওপর বিদ্যমান আস্থা উঠে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্রাইসিসকে সামাল দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে। ইতালির সরকারও বিদায়ের পথে। ভবিষ্যতে 'ইউরো' নামের কোনো মুদ্রা পাবে কি না, সেটা নিয়েই এখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবার বাংলাদেশের কথায় আসি। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটা স্বপ্ন দেখে আসছে যে তারা শুধু ধনীই হবে। এক বছর ধরে তাদের সেই স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে। এখন দেখছে তারা শুধু দরিদ্রই হচ্ছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। যেসব দ্রব্য ও পণ্য তারা দুই বছর আগে যে মূল্যে কিনেছিল, এখন ৫০ শতাংশ বেশি মূল্যে সেসব কিনতে হচ্ছে। অথচ তাদের আয় বাড়েনি। অন্যদিকে তারা আগের তুলনায় ট্যাঙ্ও বেশি দিচ্ছে। অথচ সরকারের ঋণ অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে।
চার মাসেই সরকার বাজেটে উলি্লখিত প্রাক্কলিত ঋণের ৬০ শতাংশ ঋণ করে ফেলেছে। প্রতিদিন ১০০ কোটিরও বেশি টাকার ঋণ করা হচ্ছে। লোকজন আগের থেকে বেশি ট্যাঙ্ দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের ঋণ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এর ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা একটি, সরকার বেশি ব্যয় করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রাপ্যতা কঠিন করে তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের জন্য যেন ঋণের দরজা খোলা। এটাই বিপজ্জনক। সরকারি ব্যয় কি ব্যক্তি খাতের ব্যয় অপেক্ষা দক্ষ। আর এখানেই আমাদের যত উৎকণ্ঠা। একদিকে সরকার গ্যাস-বিদ্যুৎ-পেট্রলের মূল্য বারবার বৃদ্ধিই করে চলেছে, অন্যদিকে আরো অনেক খাতে ভর্তুকির মাত্রাটা শুধুই বাড়ানো হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি, দুর্নীতি, অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় আমাদের অর্থনীতিকে বড় রকমের মূল্যস্ফীতির মধ্যে ফেলে দেবে। সেই সময় বেশি দূরে নয়, অতি নিকটে। এভাবে চললে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই অর্থনীতিকে চালানো যে কত কঠিন হবে, তা যারা চিন্তা করে তাদের বোঝার কথা। বলা হচ্ছে, জিডিপি ৬.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে?
সস্তায় ভোগ্যপণ্য পাওয়ার আশায় যারা সরকারকে ভোট দিয়েছিল তাদের অবস্থাটা কী! মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলো যেকোনো অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তারা ভোগ করে, তারা সঞ্চয় করে। এখন তাদের ভোগও কমে যাচ্ছে। আর সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। বরং অনেকেই অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। সর্বত্রই যেন আস্থার অভাব। আর এটাই হলো অর্থনীতির জন্য এক নম্বরের শত্রু। ম্যাক্রো অর্থনৈতিক সূচকগুলো আমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কেউ আমাদের ঋণ দিতে চাইবে না। আইএমএফ এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিলেও সেই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। বাংলাদেশ গ্রিস নয় যে বিপদে পড়লে অন্য ইউরোপীয় দেশ এগিয়ে আসবে। বিপদে উদ্ধার করার মতো বন্ধু আমাদের বেশি নেই। যে প্রতিবেশীকে শুধু বন্ধু বানানো হয়েছে, সে বন্ধু সহায়তার ক্ষেত্রে অতি কৃপণ। তাহলে এ দেশের সামনে বিকল্প কী? বিকল্প একটাই_ব্যয় কমানো। কিন্তু সরকার কি সেই পথে যাচ্ছে? অর্থনীতির সেনাপতি অর্থমন্ত্রীকে অনেক অপ্রিয় হতে হবে। কিন্তু তিনি কি সেই অপ্রিয় হতে রাজি আছেন? দেশের অর্থমন্ত্রীকে প্রিয় হতে হলে সে দেশের কপালে দুঃখ আছে। ভবিষ্যতের বড় বিপদের কথা চিন্তা করে আজকে উচিত হবে আয়ের মধ্যে থেকে ব্যয় করুন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে দেশে ডলারের বিরাট রিজার্ভ গড়ে উঠতে লাগল। কিন্তু বেশির ভাগ সেই অতিরিক্ত ডলার ঋণ হিসেবে আবার মার্কিন সরকার ও জনগণের কাছে বিক্রি করা হলো। এই বিক্রেতা দেশগুলো হলো চীন, ভারত, সিরিয়া ও সৌদি আরব। কিন্তু এসব দেশের মনের মধ্যে একটা শঙ্কা বরাবরই কাজ করছিল, সেটা হলো মার্কিন ডলারের মূল্য শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকবে তো! সত্যি আজকে মার্কিন ডলারের মূল্যের পতন হচ্ছে এবং তার মূলে হলো তাদের অর্থনীতির পতন। ওদিকে ইউরোপেও ঋণের ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রিস, পর্তুগাল ও ইতালি ঋণে জর্জরিত। ফ্রান্স ও জার্মানি ওদের ঋণ দিয়ে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে বটে, তবে সেই পুনরুদ্ধার প্যাকেজ জনগণের জন্য অনেক ব্যয়বহুল হবে। বলা হচ্ছে, ঘাটতি কমাও, ব্যয় কম করো, আর ট্যাঙ্ বেশি দাও। আজকে ইউরোপীয় মুদ্রা ইউরোও দুর্বল হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডলার-ইউরোর ওপর বিদ্যমান আস্থা উঠে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্রাইসিসকে সামাল দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে। ইতালির সরকারও বিদায়ের পথে। ভবিষ্যতে 'ইউরো' নামের কোনো মুদ্রা পাবে কি না, সেটা নিয়েই এখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবার বাংলাদেশের কথায় আসি। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটা স্বপ্ন দেখে আসছে যে তারা শুধু ধনীই হবে। এক বছর ধরে তাদের সেই স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে। এখন দেখছে তারা শুধু দরিদ্রই হচ্ছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। যেসব দ্রব্য ও পণ্য তারা দুই বছর আগে যে মূল্যে কিনেছিল, এখন ৫০ শতাংশ বেশি মূল্যে সেসব কিনতে হচ্ছে। অথচ তাদের আয় বাড়েনি। অন্যদিকে তারা আগের তুলনায় ট্যাঙ্ও বেশি দিচ্ছে। অথচ সরকারের ঋণ অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে।
চার মাসেই সরকার বাজেটে উলি্লখিত প্রাক্কলিত ঋণের ৬০ শতাংশ ঋণ করে ফেলেছে। প্রতিদিন ১০০ কোটিরও বেশি টাকার ঋণ করা হচ্ছে। লোকজন আগের থেকে বেশি ট্যাঙ্ দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের ঋণ জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এর ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা একটি, সরকার বেশি ব্যয় করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রাপ্যতা কঠিন করে তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের জন্য যেন ঋণের দরজা খোলা। এটাই বিপজ্জনক। সরকারি ব্যয় কি ব্যক্তি খাতের ব্যয় অপেক্ষা দক্ষ। আর এখানেই আমাদের যত উৎকণ্ঠা। একদিকে সরকার গ্যাস-বিদ্যুৎ-পেট্রলের মূল্য বারবার বৃদ্ধিই করে চলেছে, অন্যদিকে আরো অনেক খাতে ভর্তুকির মাত্রাটা শুধুই বাড়ানো হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি, দুর্নীতি, অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় আমাদের অর্থনীতিকে বড় রকমের মূল্যস্ফীতির মধ্যে ফেলে দেবে। সেই সময় বেশি দূরে নয়, অতি নিকটে। এভাবে চললে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই অর্থনীতিকে চালানো যে কত কঠিন হবে, তা যারা চিন্তা করে তাদের বোঝার কথা। বলা হচ্ছে, জিডিপি ৬.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে?
সস্তায় ভোগ্যপণ্য পাওয়ার আশায় যারা সরকারকে ভোট দিয়েছিল তাদের অবস্থাটা কী! মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলো যেকোনো অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তারা ভোগ করে, তারা সঞ্চয় করে। এখন তাদের ভোগও কমে যাচ্ছে। আর সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। বরং অনেকেই অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। সর্বত্রই যেন আস্থার অভাব। আর এটাই হলো অর্থনীতির জন্য এক নম্বরের শত্রু। ম্যাক্রো অর্থনৈতিক সূচকগুলো আমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কেউ আমাদের ঋণ দিতে চাইবে না। আইএমএফ এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিলেও সেই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। বাংলাদেশ গ্রিস নয় যে বিপদে পড়লে অন্য ইউরোপীয় দেশ এগিয়ে আসবে। বিপদে উদ্ধার করার মতো বন্ধু আমাদের বেশি নেই। যে প্রতিবেশীকে শুধু বন্ধু বানানো হয়েছে, সে বন্ধু সহায়তার ক্ষেত্রে অতি কৃপণ। তাহলে এ দেশের সামনে বিকল্প কী? বিকল্প একটাই_ব্যয় কমানো। কিন্তু সরকার কি সেই পথে যাচ্ছে? অর্থনীতির সেনাপতি অর্থমন্ত্রীকে অনেক অপ্রিয় হতে হবে। কিন্তু তিনি কি সেই অপ্রিয় হতে রাজি আছেন? দেশের অর্থমন্ত্রীকে প্রিয় হতে হলে সে দেশের কপালে দুঃখ আছে। ভবিষ্যতের বড় বিপদের কথা চিন্তা করে আজকে উচিত হবে আয়ের মধ্যে থেকে ব্যয় করুন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments