গৌরবের চার দশক-সশস্ত্র বাহিনী দিবস by আকরাম হোসেন

জ ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গৌরবের পথচলার চার দশক পূর্ণ করেছে। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আক্রমণের সূচনা করে। এ আক্রমণের সাফল্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তিতে তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।


ওইদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে সারাবিশ্বের রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়েছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। এই অভিযানের ফলে স্পষ্ট বার্তা পেঁৗছে গিয়েছিল বিশ্বের সব মহলের কাছে; বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজেরাই চালাতে সক্ষম এবং তার সেনাবাহিনী পৃথিবীর যে কোনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে একই মর্যাদাপ্রাপ্তির যোগ্য। এই সম্মিলিত আক্রমণের ব্যাপক সাফল্য ওই সময়ে বিরাজমান চরম অনিশ্চয়তার পরিবেশে জনগণের নৈতিক মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছিল মোক্ষম দাওয়াই, বিশেষ করে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের জন্য। তারা ২৫ মার্চের পর থেকেই অমিত বিক্রমে লড়ছিল বাংলাদেশের সর্বত্র। জনগণের পূর্ণ সমর্থন ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রতি। ফলে হানাদার বাহিনী এবং তাদের বাংলাদেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদররা ক্রমেই হয়ে পড়ছিল কোণঠাসা। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ছিল এরই ধারাবাহিকতা। আর ২১ নভেম্বরের কয়েক দিনের মধ্যেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী বা যৌথবাহিনী। বিরাজমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারত কর্তৃক এমন সামরিক স্বীকৃতি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে যে গভীর আত্মবিশ্বাস ও বন্ধন সৃষ্টি করেছিল তার গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় অতিসত্বর একটি নতুন স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। মিত্রবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারত আশ্বস্ত করেছিল যে, রাজনৈতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র; যে স্বীকৃতি ভারত প্রদান করেছিল ৬ ডিসেম্বর। যৌথবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চতুর্দিকের সীমান্ত দিয়ে আনুষ্ঠানিক আক্রমণ শুরু করেছিল ৩ ডিসেম্বর। মাত্র ১৩ দিনের মাথায়, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এখন পেশাগত উৎকর্ষতায় বিশ্বের যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। সেনাবাহিনী তার নিজস্ব সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ; নিজস্ব এভিয়েশন শাখার রয়েছে হেলিকপ্টারসহ সীমিত আকারের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ছোট বিমান। নৌবাহিনীর রয়েছে আধুনিক ফ্রিগেট বা যুদ্ধজাহাজ। মিগ-২৯ এখন বিমানবাহিনীর আধুনিক সংযোজন।
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে একটি ছিল তিন বাহিনীর জন্যই মহিলা অফিসারদের কমিশন প্রদান; যা কতিপয় উন্নত দেশের সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কোনো দেশে এখনও শুরু হয়নি। মহিলা অফিসাররা পুরুষ অফিসারদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলছেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে জাতিসংঘের শান্তি মিশনেও দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ এখন বিশ্বের সর্বত্র আলোচিত বিষয়। ১৯৯১ সালে কুয়েত পুনর্দখল অভিযানে বহুজাতিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশন 'ডেজার্ট স্টর্মে' অংশগ্রহণের ফলে বিশ্বব্যাপী শান্তি মিশনে মোতায়েনের জন্য জাতিসংঘ থেকে অনবরত ডাক আসতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বিশ্বের এক নম্বর দেশের মর্যাদা অর্জন করে। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এমন সম্মানজনক অর্জন এবং বহির্বিশ্বে তার প্রচার নিঃসন্দেহে জাতিসংঘের ১৯৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন বাংলাদেশকে শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকার অদূরে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে ২০০০ সালে স্থাপিত ট্রেনিং সেন্টারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেনাসদস্যরা এসে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাচ্ছেন। এটা একদিকে যেমন দেশের পরিচিতি ও আমাদের সেনাসদস্যদের পেশাগত উৎকর্ষতা বিদেশে প্রচার পাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের সেনাসদস্যরাও এখানে এসে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়া ও অনুশীলনে অংশ নিচ্ছেন। তৈরি পোশাক ও বিদেশে কর্মরত বেসামরিক জনবল খাতের পর, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। প্রায় অর্ধশত মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছে, তার মধ্যে কয়েকটি মিশনে ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের ৫ জুন সোমালিয়ার বিদ্রোহী নেতা জেনারেল ফারাহ মুহাম্মদ আইদিদের বিদ্রোহী সেনাদল শান্তি মিশনে নিয়োজিত পাকিস্তানের ২৪ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ জন সেনাসদস্যকে এক ভয়াবহ আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করতে সক্ষম হয়। শান্তি মিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতসংখ্যক সেনাসদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। ঘটনার জের ধরে জাতিসংঘ সোমালিয়ার শান্তি মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সব দেশের ফোর্স যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাহারের আদেশ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের ফোর্সের প্রত্যাহারকালীন সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়েছিল সেখানে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাদলের ওপর। নিজেদের কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতি ব্যতিরেকে সেদিন বাংলাদেশ সেনাদল ওই দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করতে পারায় বিশ্ব দরবারে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল তারা। ১৯৯৯ সালে আফ্রিকার আরেক দেশ সিয়েরালিওনেও প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে। সিয়েরালিওনের বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করে, যা এক সময় সেখানে নিয়োজিত জাতিসংঘের ফোর্সের আওতার বাইরে চলে যায়। এক সময় দেখা গেল বিবদমান দলগুলো সবাই জাতিসংঘের ম্যান্ডেট উপেক্ষা করে সেখানে নিয়োজিত জাতিসংঘ বাহিনীর ওপরই ব্যাপক আক্রমণ শুরু করল। এমতাবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত, পাকিস্তানসহ প্রায় সব দেশের সেনাসদস্য জাতিসংঘের সম্মতি ব্যতিরেকেই সিয়েরালিওন থেকে পশ্চাদপসরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাদল সেদিন সব প্রতিকূলতার মুখে দেশ এবং জাতিসংঘের মর্যাদা রক্ষাকল্পে অদম্য সাহস ও কৌশলের মাধ্যমে সেখানে টিকে থাকতে সক্ষম হয়।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এই যে এত বড় অর্জন, তা একদিনে হয়ে যায়নি। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মিশনে নিয়োজিত সেনাসদস্যদের প্রমাণ করতে হয়েছে তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ থেকে পিছিয়ে নেই। এই কষ্টার্জিত অর্জন যেমন আমাদের ধরে রাখতে হবে, তেমনি দেশের নাগরিক হিসেবে সবার কাম্য হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাগত উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্তি্বকতা এবং দর্শনেও সমগ্র জাতির প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে।

আকরাম হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.