স্মরণ-বি রায়চৌধুরী : কীর্তিমানের মুখচ্ছবি
ভূপেন্দ্র রায়চৌধুরী, যিনি উপমহাদেশের ফুটবল অঙ্গনে বি রায়চৌধুরী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর বীরত্বগাথার কথা আজও অনেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ১৯৩৯ সালের ভাদ্র মাসের কোনো এক শুক্রবার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামের রঘুচৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী স্বর্গীয় তারিণী চরণ চৌধুরী। হবিগঞ্জ হাই স্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯৩১ সালে কংগ্রেসি আন্দোলনে যোগ
দেন। হবিগঞ্জে নেতাজি সুভাষ বসুর সফরকালে তিনি জিওসির দায়িত্ব পালন করেন। তিন বন্ধুকে নিয়ে তিনি ওই সালেই হবিগঞ্জ মহকুমা ট্রেজারি অফিসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলে সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে এসডিও কোর্টে হাজির করে। মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে এসডিও নবীব আলী তাঁদের ১৫ মাসের জেলদণ্ড প্রদান করে শিলচর কারাগারে প্রেরণ করেন। শিলচর জেলে ১১ মাস কারাভোগের পর সিলেট কারাগারে স্থানান্তর করেন। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে চার মাসের মাথায় পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা পাস করেন। পরে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হন। ঢাকার মাঠে নেমে খেলার নৈপুণ্য প্রদর্শন করে কলেজের উপাধ্যক্ষ ও স্পোর্টস ইনচার্জ এ পি গুপ্তের মন জয় করতে সক্ষম হন। তখন থেকেই কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর অধ্যয়নসহ বিনা পয়সায় থাকার ব্যবস্থা করে। ১৯৩৪ সালে তিনি আইকম পাস করেন এবং ওই সালেই তাঁর নেতৃত্বে কলেজ টিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিল্ড জিতে নেয়। তখন থেকেই উপমহাদেশের ফুটবল অঙ্গনে বি চৌধুরীর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় শুরু। তাঁকে দলে নিতে ক্লাবগুলোর মধ্যে টানাটানি পড়ে যেত। পরে তিনি প্রথম সারির মোহনবাগান ক্লাবে যোগদান করে টানা চার বছর খেলেন। কর্নার শট থেকে প্রায়ই গোল পেয়ে তিনি কর্নার শট স্পেশালিস্টের আখ্যা পেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ ভারত ছাড় আন্দোলনের ডাক দিলে গান্ধী গ্রেপ্তার হন। তখন দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বি রায়চৌধুরী হবিগঞ্জ ফিরে এসে সিলেটের শশীভূষণ রায়, দুর্গাকুমার ভট্টাচার্য্য, শচীন্দ্র মোহন দত্ত, নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী প্রমুখ নেতার সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আন্দোলনে হবিগঞ্জ থেকে ৭২ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল। তিরিশের দশকে শিলচরে প্রথম ডিভিশন ফুটবল লীগ শুরু হয়। শুরু থেকেই অবিভক্ত ভারতের সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ থেকে ফুটবল ক্লাব এই লীগে অংশগ্রহণ করত। চলি্লশের দশকে বি রায়চৌধুরী এশিয়াটিক ব্যাংকের ম্যানেজার পদে চাকরি নিয়ে শিলচরে যান। কিংবদন্তি ফুটবলার হিসেবে সেখানে বরণীয় ও সমাদৃত হয়ে ওঠেন এবং সংগঠক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইন্ডিয়া ক্লাব শিলচরের পৃষ্ঠপোষকতায় মনোনিবেশ করেন। পরে তিনি এ ক্লাবের সম্পাদক নির্বাচিত হন। একপর্যায়ে তিনি এ ক্লাবের আজীবন সদস্য পদ লাভ করেন। পরে তিনি অল ইন্ডিয়া ফেডারেশনের প্রেরণায় ১৯৪৬ সালে আসাম ফুটবল সংস্থা গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সভাপতি ছিলেন আসামের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ, যিনি পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশ বিভাগের পর বি রায়চৌধুরী গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে এসে বসবাস শুরু করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হোমিও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। কংগ্রেসি স্বদেশি আন্দোলনের ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে ভারত সরকার কর্তৃক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছিলেন। ভারতে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মহাসম্মেলনে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক তাম্রমুকুট লাভ করেন। ১৯৯২ সালের ২১ নভেম্বর নিজ বাড়িতে ৮০ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আখলাক হুসেইন খান
আখলাক হুসেইন খান
No comments