অনন্য প্রতীক by অজয় দাশগুপ্ত
১৯৬৯ সালে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ির ২০৩ নম্বর কক্ষে অবস্থানকালে রেডিও শোনার সুযোগ ছিল পদার্থবিদ্যা বিভাগের কৃতী ছাত্র সঞ্জয় সরকারের সুবাদে। সে সময়ে একজন ছাত্রের জন্য রুমে রেডিও রাখা রীতিমতো বিলাসিতা। এক সন্ধ্যায় হলের এক তরুণ হাউস টিউটর এসে রেডিও কেন রুমে, তা নিয়ে রীতিমতো ধমক-শাসানি দিয়ে গেলেন। সঞ্জয়ের রেডিও রাখার আর্থিক সচ্ছলতা ছিল, তবে তার চেয়েও বেশি ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজন_ ক্রিকেট ধারাবিবরণী
এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত না শুনলে তার যে দিন চলে না! আমারও এ দুটি বিষয়ে আগ্রহ ছিল, তবে সঞ্জয়ের রেডিওর সুবাদে তা আরও বেড়ে যায়। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অলরাউন্ডার কৃষ্ণাঙ্গ বেসিল ডি অলিভেরার নাম প্রথম শুনি রুমের রেডিওতেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসকরা তাকে কোনোভাবেই ইংল্যান্ড দলের সদস্য হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে দেবে না। সে সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ক্রিকেটে বিশ্বসেরা। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দল তাদের কাছে পাত্তা পেত না। বেসিল ডি অলিভেরা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক। কিন্তু যোগ্যতা থাকার পরও গায়ের কালো রঙের কারণে জাতীয় দলে স্থান পাবেন না জেনে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সেখানে ১৯৬৬ সালে ৩৫ বছর বয়সে তার টেস্ট অভিষেক ঘটে। নতুন একটি দেশের হয়ে স্বদেশের বিরুদ্ধে খেলা নিঃসন্দেহে স্মরণীয় ঘটনা হতে পারত। কিন্তু বর্ণবাদী শাসকরা তাতে বাদ সাধে। মজার ব্যাপার যে, ব্রিটেনের সরকার সে সময়ে বর্ণবাদী শাসকদেরই পৃষ্ঠপোষকতা করত। যেমন করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও আরেকটি বর্ণবাদী দেশ ছিল সে সময়ে। তখন নাম ছিল রোডেশিয়া, এখন জিম্বাবুয়ে। কিন্তু ইংল্যান্ড ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ বেসিল ডি অলিভেলার পক্ষে সে সময়ে সাহসী অবস্থান নিয়েছিল। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়_ যে কোনো অবস্থাতেই তারা অলিভেরাকে দল থেকে বাদ দেবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের অবস্থানে অনড় থাকলে ইংল্যান্ডের সফর বাতিল হয়ে যায়। এ অবস্থায় ইংল্যান্ড দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের খ্যাতিমান খেলোয়াড় গ্যারি সোবার্সের নেতৃত্বে একটি বিশ্ব একাদশ গঠন করে তাদের সঙ্গে কয়েকটি ম্যাচ খেলে। সে খেলার ধারাবিবরণী রুমের রেডিওতেই শুনেছি। তখন বারবার উচ্চারিত হতো অলিভেরার নাম। বর্ণবাদী শাসকদের বর্ণবাদী নীতির কারণে বিশ্ব ক্রিকেট থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং তা চলে দুই দশকেরও বেশি। অন্যান্য খেলাতেও বর্ণবাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়। এর ফলে বর্ণবাদী শাসকদের ওপর চাপ বাড়ে। কিন্তু একই সঙ্গে ক্ষতি হয় অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের। ষাটের দশকের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার পিটার ও গ্রাহাম পোলক এবং ব্যারি রিচার্ডস ছিলেন বিশ্বমানের তিন ক্রিকেটার। কিন্তু বর্ণবাদী শাসকদের কারণে তাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। তারা তখন দুধের সাদ ঘোলে মেটাতেন ইংলিশ কাউন্টিতে খেলে।
পাকিস্তানি শাসকরাও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি বিদ্বেষী নীতি অনুসরণ করেছে। তাদের নীতির কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো ক্রিকেটারকেই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অন্যান্য খেলাধুুলাতেও বাঙালিদের বঞ্চিত রাখা হতো। একমাত্র স্বাধীনতা অর্জনের কারণেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পেরেছে। ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ অনেক ধরনের খেলায় বাংলাদেশ জাতীয় দল লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে হাজির হয়। এখন পর্যন্ত কোনো খেলাতেই বাংলাদেশ আহামরি কিছু খেলছে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কেউ অবদমিত রাখতে পারছে না বলেই ইতিমধ্যে যাদের সম্ভাবনা রয়েছে তারা ঠিকই মাথা তুলতে পারছে। ক্রিকেটে এখন সাকিব আল হাসান সেরাদের সারিতে স্থান করে নিয়েছেন। পাকিস্তানে থাকলে তো তার দলেই স্থান হতো না!
বেসিল ডি অলিভেরার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য। বর্ণবাদ অবসানের আন্দোলনে তিনি অনন্য প্রতীক।
পাকিস্তানি শাসকরাও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি বিদ্বেষী নীতি অনুসরণ করেছে। তাদের নীতির কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো ক্রিকেটারকেই পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অন্যান্য খেলাধুুলাতেও বাঙালিদের বঞ্চিত রাখা হতো। একমাত্র স্বাধীনতা অর্জনের কারণেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পেরেছে। ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ অনেক ধরনের খেলায় বাংলাদেশ জাতীয় দল লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে হাজির হয়। এখন পর্যন্ত কোনো খেলাতেই বাংলাদেশ আহামরি কিছু খেলছে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কেউ অবদমিত রাখতে পারছে না বলেই ইতিমধ্যে যাদের সম্ভাবনা রয়েছে তারা ঠিকই মাথা তুলতে পারছে। ক্রিকেটে এখন সাকিব আল হাসান সেরাদের সারিতে স্থান করে নিয়েছেন। পাকিস্তানে থাকলে তো তার দলেই স্থান হতো না!
বেসিল ডি অলিভেরার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য। বর্ণবাদ অবসানের আন্দোলনে তিনি অনন্য প্রতীক।
No comments