চার জয়িতার গল্প by তৌহিদুল ইসলাম লায়ন



দৈন্য, অবহেলা, বঞ্চনা আর নির্যাতনের করালগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা চার জয়িতার  সাফল্যের গল্পটা ঈর্ষণীয়। জীবনযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস, সততা আর আপন কর্মের মাধ্যমে তারা এলাকায় হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তারা হলেন, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের হাজিপুর গ্রামের জয়িতা সালেহা খাতুন, মাত্রাই ইউনিয়নের বলিগ্রাম পূর্বপাড়ার জয়িতা কৃষ্ণা রানী, আহম্মেদবাদ ইউনিয়নের খোশালপুর নওপাড়া গ্রামের জয়িতা সুলতানা বেগম এবং কালাই পৌরসভার পূর্ব সড়াইল গ্রামের জয়িতা হেলেনা বেগম। আজ তারা জীবনের শত প্রতিকূলতাকে দূরে  ঠেলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
ওই চার জয়িতা নারী জীবনের ফেলে আসা বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। গত ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করার পর সালেহা বেগমের সচ্ছল পরিবারে বিয়ে হয়। সুখের সংসার যখন চলছিল, ঠিক তখনই হঠাৎ করে বিদ্যুতায়িত হয়ে স্বামীর মৃত্যুর ঘটনা তার জীবনে নেমে আসে অমানিশা। স্বামীর বাড়ির অনাদর, অবহেলা আর বঞ্চনার এক পর্যায়ে তার গর্ভে থাকা ৯ মাসের সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি আসেন। সেখানে মায়ের পরিকল্পনা মতো তার অজান্তে পেটের সন্তানকে গর্ভপাত করানোর জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য ভাইয়ের বাড়িতে ঝি এর কাজ নেন। ইতিমধ্যেই তিনি ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের ৯ মাস বয়সে চাকরি নেন ব্র্যাক স্কুলে। পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন আর এটা-ওটা করে টাকা জমাতে থাকেন। বর্তমানে সালেহা ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত এবং তার ছেলে মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে বলে এখন তিনি অসহায়, বঞ্চিত মানুষের মানবিক ও আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। আজ তিনি শুধু একজন সফল জননী নন, তিনি উপজেলা জিন্দারপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনের একজন সদস্যও বটে।
আরেক জয়িতা কৃষ্ণা রানী। দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকা অবস্থায় বেকারের সঙ্গে জয়িতা কৃষ্ণা রানীর বিয়ে হওয়ায় সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। তাই বলে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তার কমেনি। শত কষ্টের মাঝেও লেখাপড়া চালিয়ে যান। বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত। পিছিয়ে পড়া সমাজে কৃষ্ণার এই শিক্ষার অগ্রগতি তাকে সম্মানিত করে। ফলে নানান সামাজিক কর্মকাণ্ড, বিচার সালিশ, সমস্যা নিরসনে ডাক পড়ে কৃষ্ণা রানীর। উৎসাহিত হয়ে তিনি তার ভূমিকা রাখতে শুরু করেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন বন্ধসহ বিভিন্ন সামাজিক অনাচার নির্মূলে। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা এবং আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ানোকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করেন। গর্ভবতী মায়েদের প্রতি রয়েছে তার মমত্ববোধ। ব্র্যাক থেকে মা ও শিশু বিষয়ক ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রসূতি মায়ের সেবা দিয়ে থাকেন। এলাকার একজন আদিবাসী মহিলার পঞ্চমবারের মতো পেটের সন্তান নষ্ট হয়ে যাবার পর যখন পারিবারিক জীবনে অশান্তি নেমে আসে, তখন তার সেবা ও পরামর্শ কৃষ্ণাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। সন্তান প্রসব কালীন সময় কৃষ্ণা রানীকে নিজের ঘাড়ে চেপে নিয়ে পানি উৎরিয়ে হাসপাতলে নেয়ার জন্য যানবাহনে তুলে দেয়ার দৃশ্য সবার মনকে আন্দোলিত করেছিল। আদিবাসী মহিলার সন্তানের বয়স এখন সাত বছর। তাই বলে সেখানেই থেমে থাকেনি কৃষ্ণা রানীর মানবসেবা। ২০০৯ সালে তিনি মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখছেন।
আরেক জয়িতা সুলতানা বেগম। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী অবস্থায় তার বিয়ে হয়। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিয়ের ১ মাসের মধ্যেই তাকে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে হয়। পরে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেও স্বামীর পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত হতে হয়েছে বহুবার। নিজের চেষ্টায় আবার পড়াশোনা শুরু করে এস.এস.সি পাস করেন। বয়স্ক বাবার অসচ্ছল পরিবারে মাকে নিয়ে সংসার চালানোর হাল ধরেন। এক পর্যায়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে উক্ত দপ্তর থেকে সেলাই মেশিন পেলে কাজ শুরু করে দেন।  কাজের আগ্রহ দেখে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে তাকে ঋণ প্রদানসহ আর্থিক সাহায্যের কার্ডও করে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে দ্বিতীয় বিয়ে হলে, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মহিলা সুলতানা আর্থিক সাহায্যের কার্ড প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু বিধি বাম। কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর খারাপ চারিত্রিক দিকগুলো তার সামনে ফুটে ওঠে। মাদকাসক্ত ও জুয়ারি স্বামী যৌতুকের কারণে নির্যাতন চালাতে থাকে তার উপর। সবশেষে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের দেয়া সেলাই মেশিনটি গোপনে বিক্রি করে দেয় তার স্বামী। ফলে, দ্বিতীয়বারের মতো তার সংসার ভাঙে। আবার শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। পুনরায় ফিরে আসে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে। পুনরায় ঋণ নিয়ে শুরু করেন গাভী পালন, হাঁস-মুরগি পালন। চেষ্টা করেন ঘুরে দাঁড়ানোর, সফলও হন। বর্তমানে স্থানীয় স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। এখন ৫ বিঘা বর্গা জমি, ১২ শতকের উপর তার বাড়ি,  ৮টি গরু, ২০টি হাঁস, ৫০টি মুরগি রয়েছে তার। তিনি নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা কাটিয়ে তিনি এখন উন্নয়নের স্বপ্ন  দেখেন।
দিনমজুর পিতার কন্যা জয়িতা হেলেনা বেগম ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় পাশের গ্রামের আরেক দিনমজুরের সঙ্গে। স্বামীর সম্বল ছিল এক শতাংশ বাড়ির জায়গা। একদিন একটি মুরগি কেনাই ছিল যার অসাধ্য, সেই মহিলাই এখন একটি মুরগির খামারের মালিক। বিয়ের পর এক বছর পর এক সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানে বয়স যখন ২ বছর, তখন স্বামী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বল ১ শতক জমিও বিক্রি করতে হয়। স্বামী-সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। কিন্তু দমে যাবার পাত্রী নন হেলেনা। উপজেলাতে স্থানীয় এক কোল্ড স্টোরেজে আলু বাছাইয়ের কাজ নেন, বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজ শুরু করেন। এক সময় ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে পরবর্তীতে ২ শতাংশ বাড়ির জায়গা কেনেন। ব্র্যাক থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি পঞ্চমবারের মতো ঋণ নেন এবং এরই মধ্যে গাভী পালন, হাঁস মুরগি পালন করে আবারো দশ শতাংশ জমি কেনেন। নিজে আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। তার মনোবল আরো বেড়ে যায়। মাঝখানে আরো একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। বাড়িতে মুদির দোকানের পাশাপাশি করেছেন একটি মুরগির খামার। বড় ছেলে ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করছে। হেলেনা বেগম আর আগের অবস্থানে নেই। তিনি এখন এলাকার অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী একজন নারী।
এ ব্যাপারে কালাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা নাসরীন জাহান বলেন, নারীরা ও শত বাধা পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। জয়িতা সেই সকল সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে সমাজের মাঠ পর্যায়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী নারীদের জয়কে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার একটি প্লাটফর্ম জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রম। নির্বাচিত জয়িতাদের সম্মাননা তাদের এবং এলাকার অন্যদের এগিয়ে যাবার পথকে আরো উৎসাহিত করছে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আফাজ উদ্দিন বলেন, জীবনের বাধা বিপত্তিকে ঠেলে দৃঢ় মনোবল আর কর্মস্পৃহা নিয়ে কাজ করলে সফলতা অবশ্যই আসবে। জয়িতা সালেহা খাতুন, কৃষ্ণা রানী, সুলতানা বেগম আর হেলেনা বেগম সেটাই প্রমাণ করেছেন। তাদের আজকের এ সাফল্য সমাজে অন্য নারীদের উৎসাহী করবে বলে আমার বিশ্বাস।

No comments

Powered by Blogger.