হালদায় ১৬ শ’ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ রুই-কাতলার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে রুই জাতীয় মা মাছ। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকেল ৫টায় ‘নমুনা ডিম’ ছাড়ার পর রাত ১টা থেকে শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলাসংলগ্ন নদীর বিস্তীর্ণ অংশে মা মাছ ডিম ছাড়ে। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেন প্রায় এক হাজার সংগ্রহকারী। বিশিষ্ট নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী নয়া দিগন্তকে বলেন, নাপিতের ঘোনা এলাকায় রাতে মা-মাছের ডিম দেখতে পান ডিম সংগ্রহকারীরা। এরপর ক্রমে খলিফার ঘোনা, রামদাশ মুন্সিরহাট, ছয়াস্তর ও মদুনাঘাট পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেন তারা। একেকটি নৌকা এক থেকে তিন বালতি করে ডিম সংগ্রহ করে। তারা গড়ে দুই বালতি করে ডিম আহরণ করতে পেরেছেন। নদীর উজান ও ভাটিতে দেড় থেকে ২০০ নৌকা থাকলেও ভাটি অঞ্চলের প্রায় ৮০টি নৌকা ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছে। প্রতি বালতিতে ১০ কেজি ডিম হয়। সে হিসাবে ডিম হয়েছে প্রায় প্রায় ১৬ শ’ কজি। ওখান থেকে রেণু উৎপাদন হবে ৪০ কেজির মতো। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মে মাসের ৭ থেকে ১২ তারিখে অথবা ২১ তারিখ থেকে ২৭ তারিখের ভেতর আরেকবার মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী জানান, আকাশের গর্জন আর প্রবল বর্ষণে উজান থেকে পাহাড়ি পানির স্্েরাত নামার কারণে অমাবস্যার তিথির আগেই হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। তিনি বলেন, এবার উজানে ডিম সংগ্রহ করতে পারেনি সংগ্রহকারীরা। নাপিতের ঘাট থেকে বারি ঘোনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ করেছে তারা।
প্রত্যদর্শীরা জানান, কয়েক শ’ নৌকা-সাম্পান নিয়ে মিহি জাল দিয়ে ডিম সংগ্রহ করেন ডিম আহরণকারীরা। প্রাকৃতিক বৈরিতা উপো করে মৎস্যজীবীরাও তরী ভাসিয়েছেন হালদার বুকে। আগামী ২৫-২৬ এপ্রিলের দিকে হালদা পাড়ে রেণুপোনা বিক্রি শুরু হবে। এ বিষয়ে হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, বিকেল থেকে নমুনা পাওয়া গেলেও গভীর রাতে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকায় গভীর রাতেও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ডিম সংগ্রহ করেন। তবে গতকাল সকালে ডিম সংগ্রহ কমে আসে। এরই মধ্যে সংগৃহীত ডিম মৎস্য অফিসের বিভিন্ন হ্যাচারিতে জমা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ডিমের পাশাপাশি অল্প পরিমাণে হলেও রেণু সংগ্রহ করা হয়েছে। হালদাসংশ্লিষ্টরা জানান, নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য ভারী বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। পাহাড়ি এলাকা ও নদীর উৎপত্তিস্থলে বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ি ঢলের মাধ্যমে আসা ঘোলা পানিতে ডিম ছাড়ে মা মাছ। বৃষ্টিপাতের ফলে আসা পাহাড়ি ঢলের ঘোলা পানিতে পানির পিএইচ মাত্রা, মিশ্রিত অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, টারবিডিটি (পানির ঘোলাত্ব) ও প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা প্রজননের উপযোগী হওয়ায় হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে মা মাছ। হালদায় প্রতি বছর রুই, কালিবাউশ, কাতলা ও মৃগেল মাছ ডিম ছাড়ে। রাউজান উপজেলার উরকিরচর, মইশকরম, বাড়িঘোনা, রামদাশ, মুন্সিরহাট, আজিমেরঘাট, কাগতিয়া, বিনাজুরী, দণি গহিরা, অঙ্কুরীঘোনা এবং হাটহাজারী উপজেলার মাদর্শা, মাছুয়াঘোনা, আমতুয়া, গড়দুয়ারা, পোরলীর মুখ এলাকায় শত শত নৌকা নিয়ে অভিজ্ঞ জেলেরা মাছের ডিম সংগ্রহের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেন। হালদার পোনা দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় প্রতি বছর এসব পোনা কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সংগ্রহ করা ডিম কয়েক দিন হ্যাচারিতে রাখার পর রেণু সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। উল্লেখ্য, এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় থানার বদনাতলী পাহাড় থেকে সৃষ্ট হয়ে ফটিকছড়ির রাউজান, হাটহাজারীর কালুরঘাট স্থান অতিক্রম করে কর্ণফুলী নদীতে মিশে গেছে। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে দেশের মোট মৎস্য চাহিদার ৭০ ভাগ পূরণ করতো হালদা নদীর পোনা।
কিন্তু রাষ্ট্্েরর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক পদেেপর অভাব, মা মাছ শিকার, নদীর বাঁক কাটাসহ বিভিন্ন কারণে হালদা নদীর ঐতিহ্য আজ ধ্বংসপ্রায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হালদা নদীর চারটি বাঁক কেটে ফেলা, অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণ, মা মাছ নিধন, হালদাসংলগ্ন এলাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠাই এ নদীতে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে। রাউজানের জেলেদের মুখে হাসি রাউজান (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রস্থল হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে রুইজাতীয় মা মাছ। গত শুক্রবার রাত আনুমানিক ২টায় মা মাছ ডিম ছাড়ে বলে জানান স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা। গত কয়েক দিন হালদা পাড়ে নৌকা নিয়ে অপেক্ষারত জেলেরা মা মাছেরা ডিম ছাড়ার পর পরই ডিম সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে রাউজান-হাটহাজারীর প্রায় সাড়ে চার শতাধিক জেলে সারা রাত হালদা নদীতে মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেন। ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, গতবারের তুলনায় এবার আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করা গেছে। চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী সীমান্তবর্তী আমতুয়া, নাপিতের ঘাট, আজিমারঘাট, সোনাইর মুখ, অংকুরিঘোনার ডিম সংগ্রহকারীরা সাড়ে চার শতাধিক নৌকায় কয়েক দিন ধরে হালদা নদীর বিভিন্ন বাঁকে অবস্থান নেন। গত শুক্রবারের টানা বর্ষণ আর বজ্রপাতের ফলে ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা উঁকি দেয়। মধ্য রাতে মা মাছ ডিম ছাড়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা উৎসবমুখর পরিবেশেই সারা রাত হালদা নদীর কয়েকটি ডিম ছাড়ার পয়েন্টে ডিম সংগ্রহ করে। গতকাল শনিবার ভোরে চট্টগ্রাম উপজেলার রাউজানের হালদা পাড়ের আজিমারঘাটে গিয়ে দেখা গেছে সারা রাত নদীতে ডিম সংগ্রহ শেষে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা সংগৃহীত ডিম নিয়ে হালদা পাড়ে নৌকা নোঙর করেছেন। তাদের কেউ কেউ হালদা পাড়ের সনাতন পদ্ধতিতে ডিম নিষিক্তকরণের জন্য খননকৃত অগভীর কূপে ডিম রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার রাত থেকেই উপজেলার প্রায় সাড়ে চার শতাধিক নৌকায় স্থানীয় জেলেরা ডিম সংগ্রহ করেন। সারা রাত ধরে নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে জাল ফেলে ডিম সংগ্রহ করেন তারা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আনুমানিক তিন হাজার কেজি মাছের ডিম সংগৃহীত হয়েছে।
No comments