এক হিমাগারে ‘জিম্মি’ ৩০০ আমদানিকারক
চট্টগ্রামে একটি কোল্ড স্টোরেজ (হিমাগার) মালিকের হাতে ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩০০ ফল আমদানিকারক। হিমাগার সংকটকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা ভাড়া’ আদায় করা হচ্ছে। এ কারণে আমদানিকারকরা ফল আমদানি করে বিপাকে পড়ছেন। বিশেষ করে আগামী রমজানের জন্য আমদানি করা খেজুর নিয়ে তারা আছেন উৎকণ্ঠায়। ঢাকার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে চট্টগ্রামে। তাই প্রায় সময় লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরও পড়ছে। ফলমূলের দাম হাঁকা হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সূত্র জানায়, ঢাকায় বিভিন্ন হিমাগারে ১০ কেজির প্রতিটি খেজুরের কার্টন রাখার জন্য ৬ মাসে ভাড়া আদায় করা হয় ২০ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজারের চৈতন্যগলি এলাকার ইএটিসি হিমাগার কর্তৃপক্ষ ৬ মাসের ভাড়া আদায় করছে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০ টাকা।। এ ছাড়া ১৫ কেজি মাল্টার কার্টনের ভাড়া ঢাকায় প্রতি মাসে ১৩ টাকা, চট্টগ্রামে সেটা ৪০ টাকা। একইভাবে ২০ কেজি আপেলের প্রতি কার্টনের ভাড়া ঢাকায় যেখানে ১৫ টাকা, সেখানে চট্টগ্রামে ৪০ টাকা। এ ছাড়া পণ্য সংরক্ষণে প্রচলিত নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করছে এই হিমাগার কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে- ভালো পণ্যের সঙ্গে খারাপ পণ্য রাখা হয়। দীর্ঘদিনের পুরনো মেশিন যুগোপযোগী না করার কারণে অনেক সময় পণ্য পচে নষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এ হিমাগারে অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার কার্টন নষ্ট খেজুর উদ্ধার করে। এ ঘটনায় হিমাগারের ম্যানেজার গোপাল দাশকে ৬ মাসের কারাদণ্ডও দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায় ও দীর্ঘদিনের পুরনো হিমাগার হওয়ার কারণে এ হিমাগারের পেছনেই বছরে ব্যবসায়ীদের শত কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ ভোক্তাদের। তিনি এ জন্য ইএটিসি হিমাগার কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন। তিনি আরও বলেন, যেহেতু ফল পচনশীল পণ্য। তাই আমদানির পর এগুলো হিমাগারেই ঢোকাতে হয়। চট্টগ্রামে হিমাগার সংকটের কারণে মনোপলি ব্যবসা চলছে। ফলমন্ডির (চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ফলের আড়ত, যা ফলমন্ডির নামে পরিচিত) আরেক বড় আমদানিকারক শহীদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, মান্ধাতা আমলের হিমাগারের কারণে বছরের পর বছর আমদানি করা ফল-ফলারির পেছনে যে শত কোটি টাকা অপচয় বা নষ্ট হচ্ছে সেই টাকায় একাধিক হিমাগার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আমদানিকারকরা সরকারকে কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স-ভ্যাট দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা সরকার বিবেচনায় নিচ্ছে না। আমদানিকারকদের সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ফল ও ফলজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক রয়েছেন প্রায় ৩০০। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে এসব আমদানিকারকের ৬০-৭০ কনটেইনার ফলমূল খালাস হয়। শনিবারও চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় ছিল প্রায় ৩০০ কনটেইনার। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে রয়েছে ফলের বিশাল আড়ত।
এই আড়তের একটু দূরেই রিয়াজুদ্দিন বাজারে অবস্থিত ইএটিসি কোল্ড স্টোরেজ। চট্টগ্রামে বড় আকারের তিনটি হিমাগার থাকলেও মনোপলি ব্যবসা করছে ইএটিসি। কারণ অপর দুটির একটি মাঝির ঘাট এলাকার কর্ণফুলী কোল্ড স্টোরেজ, যেটা মাছের জন্য বিশেষায়িত। তবে এটি বেশ আধুনিক। এখানে কিছু ফলমূল রাখা যায়। অন্যদিকে আরেকটি কালুরঘাট কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড যেটি ততটা আধুনিক নয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সেখানে ব্যবসায়ীরা খুব একটা যান না। তাই রিয়াজুদ্দিন বাজারের সর্ববৃহৎ হিমাগারটি (ইএটিসি) আমদানিকারকদের একমাত্র ভরসা। তাই জিম্মি পরিস্থিতিতেও আমদানিকারকরা বাধ্য হয়ে ইএটিসি হিমাগারের দ্বারস্থ হন। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। ইএটিসি কোল্ড স্টোরেজের মালিক রওনক জাহান। তার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির ইনচার্জ মো. আলী হোসেন ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি ভাড়া আদায়ের কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করেন। তিনি শনিবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কোল্ড স্টোরেজের ধারণক্ষমতা এক হাজার টন। ঢাকায় বিশাল বিশাল কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। সেখানে কোল্ড স্টোরেজে যে পরিমাণ ধারণক্ষমতা রয়েছে সে তুলনায় পণ্য অনেক কম। এ কারণে ভাড়াও কম। চট্টগ্রামে যেভাবে কোল্ড স্টোরেজে পণ্য নিয়ে আসা হয় সব পণ্য আমরা রাখতে পারি না ধারণক্ষমতা নেই বলে। সে কারণে বাড়তি ভাড়া আদায় করি। চাহিদার কারণেই এটি করা হয়। হিমাগারটি পুরনো ও খারাপ পণ্যের সঙ্গে ভালো পণ্য রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, জোর করে কারও পণ্য এখানে রাখা হয় না। কারও কাছ থেকে ভাড়াও বেশি আদায় করা হচ্ছে না। কথাবার্তার মাধ্যমেই আদায় করা হচ্ছে।
No comments