রাজনীতিতে রং বদল by শামীমুল হক
রাজনীতিতে
রং বদল নতুন কিছু নয়। কিন্তু কিছু কিছু রং বদল ইতিহাস হয়ে যায়। যুগ যুগ
ধরে মানুষ মনে রাখে। রং বদলের ঘটনায় একেবারে বিপরীত আদর্শের রাজনীতিকেও
আঁকড়ে ধরার নজির দেশে বহু। এ যাবৎকালের আলোচিত দল বদলের ঘটনা ঘটান রাজশাহীর
পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলাউদ্দিন। যার শরীরে জন্ম থেকেই আওয়ামী
লীগের রক্ত। যার ধ্যান-জ্ঞানে আওয়ামী লীগ। সে সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের
প্রেসিডিয়াম সদস্য। সেই আলাউদ্দিন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে
বিএনপিতে যোগ দেন। হয়ে যান জাতীয়তাবাদী সৈনিক। উপহার হিসেবে পান
বাঘা-চারঘাট মিলে রাজশাহী-৫ আসন থেকে বিএনপির টিকিট। আর সে নির্বাচনে জীবনে
প্রথম বারের মতো ধানের শীষ প্রতীকই তাকে জয় এনে দেয়। নামের পাশে সংসদ
সদস্য শব্দ বসানোর অধিকার পান। বিএনপির এমপি হয়ে সংসদে যান। বিএনপির পক্ষে
সরব সংসদে। কিন্তু সরকারে তখন আওয়ামী লীগ। দুই বছর না পেরুতেই ১৯৯৮ সালে
ফের আলাউদ্দিন যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ থেকে উপহারস্বরূপ তাকে দেয়া
হয় প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পদ। কিন্তু আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ
চলে যায়। ফের উপনির্বাচনে ডা. আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা প্রতীক
নিয়ে জয়ী হন। ধানের শীষের এমপি হন নৌকার এমপি। একই সময় ঘটে আরেক ঘটনা।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনও বদলান। একসময় জাসদের
ডাকসাইটে নেতা স্বপন বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। পরে তিনিও যোগ দেন আওয়ামী
লীগে। উপহার হিসেবে পান শিল্প উপমন্ত্রীর পদ। তার বেলায়ও ঘটে একই ঘটনা।
সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। তিনিও উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে লড়াই
করে জয়ী হয়ে আসেন। আলোচিত এমন বদলের ঘটনা বহু। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের টিকিট না পেয়ে সাবেক এমপি নড়াইলের ধীরেন্দ্রনাথ সাহা যোগ দেন
বিএনপিতে। লড়াই করেন ধানের শীষ নিয়ে সরাসরি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সে সময়
শেখ হাসিনা তিন আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। নিয়ম অনুযায়ী গোপালগঞ্জের আসনটি
রেখে নড়াইলের দুটি আসন ছেড়ে দেন। উপনির্বাচনেও ধীরেন্দ্রনাথ ধানের শীষ নিয়ে
লড়াই করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দেয়ায় তিনি বিএনপির হয়ে জয়ী হন। এক সময়
আওয়ামী লীগের পক্ষে সংসদে যে ধীরেন্দ্রনাথ সরব ছিলেন, সেই ধীরেন্দ্র নাথ
বিএনপির পক্ষে সংসদে বক্তব্য রাখেন। এখনো তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়।
খুলনার বিএনপি নেতা কাজী সেকান্দার ডালিম ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে
এমপি নির্বাচিত হন। পরে তিনিও বিএনপিতে ফিরে যান। এক সময় স্বৈরাচারী এরশাদ
সরকারের প্রভাবশালী ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এখন বিএনপির
প্রভাবশালী নেতা। সে সময়ের আরেক প্রভাবশালী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন
এরশাদের এক জনসভায় বিতর্কিত ভাষণ দিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। তিনি
এখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে যে
দলের সৃষ্টি, যারা তখন আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় রাজপথ উত্তপ্ত রাখতেন, সেই
নেতাদের অনেকেই এখন রং বদলে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। কেউ কেউ আওয়ামী লীগ
সরকারের মন্ত্রীও হয়েছেন। এক সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের দাপুটে সভাপতি নূহ আলম
লেনিনও হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। বর্তমানে আওয়ামী লীগের
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নজিবুল বাশার
মাইজভান্ডারী এক সময় যোগ দেন বিএনপিতে। পরে বিএনপি ছেড়ে নিজেই তরিকুল
ফেডারেশন নামে দল গঠন করেন। বর্তমানে ওই দলের এমপি তিনি। বদলের ঘটনায় আরেক
নাম ফখরুল ইসলাম মুন্সী। তিনি মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর শীর্ষ
নেতা ছিলেন। এরশাদ আমলে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। এরশাদ
পতনের পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। টাঙ্গাইলের মাহমুদুল হাসান এরশাদ আমলে
ঢাকার মেয়র ছিলেন। ছিলেন প্রভাবশালী মন্ত্রীও। এরশাদ পতনের পর তিনি
বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। আরেক আলোচিত নাম মোস্তফা মহসিন মন্টু। ১৯৮৬
সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। ছিলেন যুবলীগের
চেয়ারম্যান। পরে ড. কামালের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যোগ দেন গণ ফোরামে। এক
সময়ের সাড়া জাগানো ছাত্রলীগ নেতা কিশোরগঞ্জের ফজলুর রহমান ১৯৮৬ সালে সংসদ
সদস্য নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীকে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে তিনি এমপি
নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে গড়ে তুলেন কৃষক শ্রমিক জনতা
লীগ। এ দলের সেক্রেটারিও ছিলেন। বর্তমানে ফজলুর রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনের
উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব ১৯৯১ সালে
আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করেন পাবনার ঈশ্বরদী থেকে। পরের নির্বাচনে
মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। কিন্তু সে নির্বাচনেও তিনি জয়ী হতে
পারেননি।
ঢাকা
মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি রহমতউল্লাহ ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির
এমপি ছিলেন। তিনিও ৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ওই সালের
নির্বাচনের নৌকা প্রতীকে লড়াই করে এমপি নির্বাচিত হন। মৌলভীবাজারের এবাদুর
রহমান চৌধুরী জাপার এমপি ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। বিএনপি
সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন ভোলা থেকে
জাপার এমপি ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লড়াই
করে জয়ী হন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। মন্ত্রীও হন। রং বদলের এসব ঘটনার তালিকা
দীর্ঘ। রাজনীতিতে রং বদল ইতিহাসের জন্ম দিলেও এ ঘটনা স্বাভাবিক বলেই মনে
করেন রাজনীতিকরা।
No comments